বসন্ত উৎসব, হোলি বা দোল হল হিন্দুদের এক ঐতিহ্যবাহী ও সাংস্কৃতিক উৎসব। তবে বর্তমানে এই উৎসব শুধু হিন্দুদের উৎসব নয়, বরং এটি এখন একটি সর্বজনীন উৎসব হয়ে উঠছে, যেখানে সকল ধর্মের মানুষই এই উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। বহু প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই হোলি বঙ্গের উৎসব হিসেবে পালিত হচ্ছে। তবে হোলি শুধু রং নয়, বরং এটি প্রেমের উৎসব হিসেবেও পরিচিত। বসন্ত উৎসব বাঙালিদের একটি আনন্দময় উৎসব। প্রতিবছর ফাল্গুনী পূর্ণিমায় এই উৎসবটির উদযাপন হয়। পশ্চিমবঙ্গ ও বাঙালি অধ্যুষিত অন্যান্য ভারতীয় রাজ্যে উৎসবের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়; শান্তিনিকেতনে উৎসবের সবচেয়ে বৃহৎ আয়োজন পরিলক্ষিত হয়। এই উৎসবটির বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে সূত্রপাত ঘটেছিল।
হোলি বা দোল-উৎসবের ইতিহাস, History of Dol Utsav/Holi
দোল-উৎসবের ইতিহাস এবং এই উৎসব উদযাপন করার কারণ অনেকেই হয়তো জানেন। তবে যারা যারা জানেন না তাদের জেনে নেওয়া উচিত। পুরাণ অনুসারে, মহর্ষি কশ্যপ এবং দিতির ছেলে ছিলেন হিরণ্যকশিপু এবং তাঁর বোন ছিল হোলিকা। হিরণ্যকশিপুরের একটি ছেলে ছিল যার নাম ছিল প্রহ্লাদ।
প্রহ্লাদ অসুরবংশে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও ছিলেন প্রভু বিষ্ণুর ভক্ত। এর জন্য পিতা তার উপর ক্রুদ্ধ ছিলেন। বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের প্রতি ক্রুদ্ধতার বশে পিতা হিরণ্যকশিপু নিজ পুত্রকেই হত্যার পরিকল্পনা করেন। সেই ষড়যন্ত্রে হিরণ্যকশিপুকে সহায়তা করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন তাঁর বোন হোলিকা, কারণ হোলিকা বর পেয়েছিলেন যে তার আগুনে কোন দিন ক্ষতি হবে না।
পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে প্রহ্লাদকে ব্রহ্মার বর স্বরূপ প্রাপ্ত বস্ত্র পরিধান করিয়ে বোন হোলিকার কোলে বসিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারার অভিপ্রায় ছিল পিতা হিরণ্যকশিপুর। কিন্তু ভগবান বিষ্ণুর মহিমার কারণে সেই কাপড়টি প্রহ্লাদকে বাঁচিয়ে দেয় এবং আগুনে হোলিকা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। বিশ্বাস করা হয় যে বরের অপব্যবহার করায় আগুনে পুড়ে যায় হোলিকা।
এই ঘটনার আনন্দে দ্বিতীয় দিনে নগরবাসী হোলি উদযাপন করে। সেই থেকে বছর বছর ধরে হোলিকা দহন ও হোলি পালিত হয়ে আসছে। এছাড়াও দোল পূর্ণিমা বহু পৌরাণিক ঘটনার সাথে জড়িত। অনেকের মতে এই তিথিতে ভগবান শ্রী কৃষ্ণ বৃন্দাবনে আবির ও গুলাল নিয়ে, রাধা এবং তার গোপীগনের সঙ্গে হোলি খেলেছিলেন। সেই ঘটনা থেকে উৎপত্তি হয় দোল খেলা।
দোল পূর্ণিমার বা হোলি উৎসবের গুরুত্ব, Importance of Holi festival
দোল উৎসব পালনের নিয়মাদী বিভিন্ন অঞ্চলভেদে ভিন্নভাবে পালিত হয়। কোথাও এই দোল পূর্ণিমাকে দোল যাত্রা বলে। আবার ফাল্গুনী পূর্ণিমাকেও দোল পূর্ণিমা বলা হয়ে থাকে। মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যের জন্ম হয়েছিল এই পূর্ণিমার তিথিতে, তাই দোল পূর্ণিমাকে গৌরী পূর্ণিমা বলা হয়। এই বিশেষ উৎসবের সাথে যুক্ত হোলিকা দহনের দিন, তাই কিছু কিছু অঞ্চলে সেদিন পরিবারের সকল সদস্যরা স্নানের আগে উবটান (হলুদ, সরিষা এবং দইয়ের একটি পেস্ট) প্রয়োগ করেন।
মনে করা হয়, ওই দিন এই উবটান লাগিয়ে স্নান করলে সমস্ত রোগ দূর হয়। এছাড়াও সেই এলাকার সমস্ত বাড়ি থেকে একটি করে কাঠ এনে একসাথে জমা করে হোলিকায় পোড়ানো হয়। বিশ্বাস অনুযায়ী আগুনে কাঠ পোড়ানোর পাশাপাশি মানুষের সব সমস্যাও পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। এই জ্বলন্ত কাঠের আশেপাশে সবাই মিলে গান নাচ ও বিভিন্ন খাবার খাওয়ার আয়োজন করেন।
হোলির দিন জানা অজানা সবাইকেই রং লাগানো হয়, এই কোলাহলে সবাই বড় মনে শত্রুকেও গলা জড়িয়ে ধরে এবং শত্রুতা ভুলে গিয়ে একসাথে রং খেলায় মত্ত হয়, তাইতো এ নিয়ে প্রচলিত একটি কথা উচ্চারণ করতে দেখা যায় “বুরা না মানো হোলি হ্যা”।
দোল পূর্ণিমার মূল আকর্ষণ, Main attractions of Dol Poornima
দোল পূর্ণিমার মূল আকর্ষণ হল আবির। এই দিনটি আবিরের রঙে সকলকে রাঙিয়ে দেওয়ার দিন। তাছাড়া এই দিনে হিন্দুদের ঘরে ঘরে পূজিত হন রাধা-কৃষ্ণ। অনেকে আবিরের আলপনা করে সাজিয়ে দেন ভগবানের সিংহাসন, আবার কোথাও রাধা কৃষ্ণের বিগ্রহকে রং দিয়ে স্নান করানোর নিয়মও পালন হতে দেখা যায়। এক কথা বলতে গেলে বেশিরভাগ হিন্দুর কাছে দোলযাত্রাটি রাধা কৃষ্ণকে ঘিরেই। ভগবানকে রাঙানোর পরদিন ছোটো থেকে বড় সকলেই মেতে ওঠেন আবির খেলায়, একে অপরকে রাঙিয়ে দেন ভিন্ন ভিন্ন রঙে।
মথুরা ও বৃন্দাবনে পালিত দোল-উৎসব, Dol festival celebrated in Mathura and Vrindavana
মথুরা এবং বৃন্দাবন শ্রী কৃষ্ণের সাথে জড়িত, তাই সেখানকার লোকজন আজও শ্রীকৃষ্ণের নাম করে দোল- উৎসব উদযাপন করে। এখানে হোলি বা দোল উদযাপন ১৬ দিন ধরে চলতে থাকে।
দোল পূর্ণিমায় ব্রজভূমির লাঠমার-উৎসব, Lathmar-festival of Brajabhumi on Dol Purnima
ব্রজের হোলি সমগ্র বিশ্ব থেকে অনন্য, এই বিশ্বাসেই ব্রজভূমিতে হোলি উৎযাপন করা হয়। ব্রজের গ্রাম বরসানায় ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে হোলি পালন করা হয়। নন্দগাঁওয়ের পুরুষ এবং বরসানার মহিলারা মিলে একসাথে হোলি খেলায় অংশগ্রহণ করেন, কারণ শ্রী কৃষ্ণ নন্দগাঁও এর বাসিন্দা ছিলেন এবং রাধা ছিলেন বারসানার বাসিন্দা। এই হোলি উৎসবে এক বিশেষ খেলা হয় যেখানে পুরুষরা মহিলাদের রঙে ভরিয়ে রাখার দিকে উদ্যত থাকেন, অন্যদিকে মহিলারা নিজেদের রং থেকে বাঁচাতে লাঠি দিয়ে পুরুষদের আঘাত করে তাদের রঙের প্রতিক্রিয়া জানায়।
পাঞ্জাবের “হোলা মহল্লা” উৎসব, Hola Mohalla” festival of Punjab
পাঞ্জাবে হোলি উৎসব মূলত দুই দিন উৎযাপিত হয়। প্রথম দিন হোলিকা দহন এর অনুষ্ঠান হয় এবং পরের দিন রং খেলায় মেতে ওঠেন সকলে। তবে পাঞ্জাবে হোলির উৎসব উপলক্ষে দ্বিতীয় দিন থেকে শিখদের পবিত্র উপাসনালয় “আনন্দপুর সাহেব”-এ ছয় দিনব্যাপী মেলা বসে। এই মেলায় ঘোড়ায় চড়া, তীরন্দাজের মতো বেশ কিছু স্টান্টও দেখা যায়।
হোলি বাংলার জন্য “দোল পূর্ণিমা”, “Dol Purnima” for Holi Bengali
হোলি উৎসব বাংলা ও উড়িষ্যায় দোল পূর্ণিমা বা দোল উৎসব নামে পরিচিত। এই দিনে, বাংলার তথা ওড়িশার বেশ কিছু এলাকায় রাধা কৃষ্ণের মূর্তি নিয়ে পুরো গ্রামে একটি যাত্রা বের করা হয়, সাথে ভক্তরা ভজন কীর্তন পরিবেশন করেন এবং সকলে মিলে রং দিয়ে একসাথে হোলি খেলা হয়।
বসন্ত উৎসবে বাঙালি পরিবারেরা ঐতিহ্যবাহী খাবার উপভোগ করতে, উপহার বিনিময় করতে এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে একত্রিত হয় । লাল হল বসন্ত উৎসবের সময় ব্যবহৃত প্রভাবশালী রঙ, কারণ এটি সৌভাগ্য নিয়ে আসে এবং মন্দ আত্মাকে দূরে রাখে বলে বিশ্বাস করা হয়।
শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসবের ইতিহাস, History of Basantotsav
বসন্ত উৎসব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর 1907 সালে ‘ঋতু-উৎসব’ নামে শুরু করেছিলেন, কিন্তু দোল পূর্ণিমায় অনুষ্ঠিত হয়নি। পরবর্তীতে, 1923 সালে শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব শুরু হয় এবং ফাল্গুনী পূর্ণিমায় আশ্রম-সম্মিলনী অধিবেশনে আয়োজন করা হয়।
শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসব, Shantiniketan Spring Festival
বাংলাদেশে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্যাপন পরিষদ বসন্তকে বরণ করতে চারুকলার বকুলতলায় এবং ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবর উন্মুক্ত মঞ্চে প্রতিবছর জাতীয় বসন্ত উৎসব আয়োজন করে।
দোলযাত্রা উৎসব সারাদেশে হোলি বা রঙ খেলার উৎসব হিসেবে উৎযাপিত হলেও পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে এটি বসন্তোৎসব নামে পরিচিত। বসন্তের আগমন উপলক্ষে দোলের সময় শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে এক আনন্দঘন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই বসন্তোৎসব পালনের রীতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই চলে আসছে। এই অনুষ্ঠানটি বর্তমানে শান্তিনিকেতনের অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব।
ফাল্গুনী পূর্ণিমা অর্থাৎ দোলপূর্ণিমার দিনই শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসবের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের পূর্বরাত্রে বৈতালিক হয় এবং দোলের দিন সকালে ‘ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল’ গানটির অধ্য দিয়ে মূল অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। এই দিনে বাতাসে যেন একটাই সুর বয়ে চলে “রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে”, আর বাঙালির এই বসন্ত উৎসবকে স্বাগত জানাতে প্রকৃতি যেন এক বর্ণিল সাজে সেজে ওঠে এবং সকলকে মুখরিত করে তোলে।
শেষ কথা, Conclusion
বছর পর বছর ধরে হোলি না দোল উৎসব অতি উৎসাহের সাথে পালন হয় আসছে। আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি দোল পূর্ণিমার বাড়িতে ঠাকুরের চরণে রং দেওয়া হয় এবং পরের দিন পরিবার ও বন্ধুবান্ধব সকলে মিলে রং খেলা হয়। সবাই মিলে হাসি ঠাট্টা, মিষ্টি খাওয়া ইত্যাদি আরো কত কি করে এই উৎসব উদযাপিত হয়। আবিরের রং যেন রাঙিয়ে দিয়ে যায় সকলের মন, সকলে নিজের দুঃখ ভুলে, শত্রুতা ভুলে আনন্দে গা ভাসিয়ে দেয়। এই উৎসব নিয়ে সকলেরই যেন এক আলাদা আবেগ কাজ করে।