দুর্গাপূজা – বাংলা রচনা, Durga puja essay in Bengali

দুর্গাপূজা - বাংলা রচনা

বাঙ্গালীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব দুর্গাপূজা। ভারতের বিভিন্ন অংশে বাঙালি জাতি ছড়িয়ে আছে, কেউ কেউ কর্ম সূত্রে নিজের বাড়ি থেকে দূরে থাকলেও পুজোর সময় ঠিক নিজের বাড়িতে আসেন দুর্গা পূজা দেখতে, কারণ সারা বছর যে যেখানেই থাক না কেনো, পুজোর ক’দিন নিজের বাড়িতে থাকার যে আনন্দ সেটা অন্য কোথাও থেকে পাওয়া যায় না।

দুর্গাপূজা বাঙালিদের মধ্যে শারদীয়া উৎসব নামে পরিচিত। বাঙালিরা সারাবছর ধরে এই একটি উৎসবের অপেক্ষায় পথ চেয়ে থাকে। প্রতিবছর আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে প্রতিপদ তিথি থেকে দশমী পর্যন্ত পালিত হয় বাঙালির জনপ্রিয় উৎসব দুর্গাপূজা।

দুর্গাপূজার পটভূমি, Background of Durga Puja

বহুকাল ধরে বছরে দু’বার হয় দুর্গাপূজা; বসন্তকালে ও শরৎকালে। বসন্তকালে অনুষ্ঠিত দূর্গা পূজা কে বলা হয় বাসন্তী পূজা এবং শরৎকালে আয়োজিত দুর্গাপূজাকে বলা হয় শারদীয় দুর্গাপূজা। পুরা কালে রাজা সুরত নিজের হারিয়ে যাওয়া সম্রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য দেবী দুর্গার আরাধনা করেন বসন্তকালে, সেই থেকেই বাসন্তী দুর্গাপূজা শুরু হয়।

অন্যদিকে রামায়ণ অনুসারে শ্রী রামচন্দ্র বনবাসে থাকাকালীন সীতা উদ্ধারের নিমিত্ত শরৎকালে লঙ্কাধিপতি রাবনের সাথে যুদ্ধের পূর্বে ১০৮ টি নীল পদ্ম সহযোগে দেবী দুর্গার অকাল বোধন করেছিলেন। এই পুজো শরৎকালে হয়েছিল বলে একে শারদীয়া দুর্গাপূজা বলা হয়। একসময় গ্রামে গঞ্জে তথা সকল স্থানেই বাঙালিদের মধ্যে বাসন্তী পূজার প্রচলন ছিল বেশি, কিন্তু ক্রমে শ্রীরামচন্দ্রের শারদীয় দুর্গাপূজা নিয়ে সকলে আনন্দে মেতে উঠেছেন।

তবে এখনও বেশ কিছু বনেদি পরিবারে বাসন্তী পূজার আয়োজন সাড়ম্বরে করা হয়। কিন্তু শরৎকাল এলেই মনে হয় যেন, “ঢাকের কাঠি বাজিয়ে শরৎ আসছে মোদের ঘরে, মন্ডপে যাওয়ার জন্য মনটা কেমন করে; মা দুর্গার আগমন আর নেইতো দেরি মোটে, আনন্দে মন মাতোয়ারা হয় পাগল হয়ে ছুটে।”

দুর্গাপূজার পটভূমি

শারদীয়া দুর্গাপূজার আগমনী আভাস, Arrival glimpse of Durga Puja

শরৎ কালের শুরুর সময় থেকেই প্রকৃতি যেন দেবীর আগমনের আভাস দিতে শুরু করে। ভোরে কুয়াশায় ভরে থাকে চারপাশ, আর দিনে নীল আকাশে থোকা থোকা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ায়, সন্ধ্যে বেলায় শিউলি ফুলের গন্ধে ভরে ওঠে মন। সকালে দেখা যায় শিশির ভেজা দূর্বা ঘাসে ঝরে পড়া শিউলি ফুল, আর তুলোর মতো কাশফুলের দোলা মাঠ ,ঘাট ,নদী ,প্রান্ত সবাইকে যেন জানিয়ে দেয়, মায়ের আগমনী বার্তা। বাঙালির দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটে মহালয়ার শুভ বন্দনাতে, আর মাত্র ক’দিনের অপেক্ষা। এসব দেখে শিশুদের মন যেন গেয়ে ওঠে,

“আয় রে ছুটে আয়
পুজোর গন্ধ এসেছে। 
ঢ্যাম্ কুড়কুড়, ঢ্যাম্ কুড়াকুড়
বাদ্যি বেজেছে।
গাছে শিউলি ফুটেছে
কালো ভোমরা জুটেছে।
গাছে শিউলি ফুটেছে
কালো ভোমরা জুটেছে।
আজ পাল্লা দিয়ে আকাশে মেঘেরা ছুটেছে।”

মহালয়া, Mahalaya

দুর্গাপুজোর পূর্বের আমাবস্যার দিনটিকে মহালয়া হিসেবে পালন করা হয়। মহালয়া থেকেই বাঙ্গালীদের মধ্যে দূর্গা পূজার আড়ম্বর প্রায় শুরু হয়ে যায় । মহালয়ার দিন হিন্দুরা শাস্ত্র অনুসারে পূর্ব পুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ করে থাকেন। তাছাড়াও ভোরে রেডিওতে সেকাল থেকে প্রচলিত দূরদর্শনের অনুষ্ঠানে বীরেন্দ্র কিশোর ভদ্রের গলায় ” আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর।

ধরণীর বহিরাকাশে অন্তর্হিত মেঘমালা। প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত জ্যোতির্ময়ী জগন্মাতার আগমনবার্তা। আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি অসীম-ছন্দে বেজে উঠে রূপলোক ও রসলোকে আনে নবভাবমাধুরীর সঞ্জীবন।

তাই আনন্দিতা শ্যামলী মাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আবাহন।” এই মহিষাসুরমর্দিনী পাঠ বাঙালির আবেগের সাথে জড়িত। প্রায় সকল বাঙ্গালী এইদিন ভোরে উঠে ধূপ ধুনা জ্বালিয়ে হাঁটতে বের হন, কিংবা মন্দিরে যান। সেদিন থেকেই যেন পূজোর আনন্দের শুরু হয়ে যায়। তাই কবি লিখেছেন, 

মহালয়ায় পুজোর শুরু সাজানো প্যান্ডেলে
দশমীতে সাঙ্গ পুজো, ঢ্যাম কুড়কুড় বোলে।
পুজোর বাজার চলছে তেড়ে, পুজোয় নতুন ড্রেস।
নতুন জামা, নতুন জুতোয় মনে খুশির রেশ!

মহালয়া

দুর্গাপূজার সময়, Timing of Durgapuja

দূর্গা মায়ের আরাধনার সময় আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন পর্যন্ত। এই নির্দিষ্ট সময়ে শারদীয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। এই পাঁচটি বিশেষ দিন যথাক্রমে ষষ্ঠী, মহা সপ্তমী, মহা অষ্টমী, মহা নবমী এবং বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষটিকে দেবিপক্ষ বলা হয়। মহালয়ার দিন থেকে দেবীপক্ষের সূচনা হয় বলে বিশ্বাস করা হয়।

দেবী দুর্গা প্রতিমা বর্ণনা, Description of Goddess Durga idol

দেবী দুর্গার যখনই মর্তে আসেন, তিনি সপরিবার আসেন বলেই ধারণা করেন ভক্তরা, তাই দুর্গার মূর্তির মধ্যস্থলে থাকেন দেবী দুর্গা এবং সাথে মায়ের বাহন সিংহ, তাছাড়াও মায়ের ডান পাশে থাকে বাহন পেঁচা সহ মা লক্ষ্মী ও বাহন ইঁদুর সহ সিদ্ধিদাতা গণেশ এবং বাম পাশে ময়ূরের সাথে কার্তিক ও প্রিয় বাহন হাঁস সহ বিদ্যাদেবী সরস্বতী, মায়ের পদতলে ত্রিশূল বিদ্ধ অবস্থায় দেখা যায় মহিষাসুরকে।

মহিষাসুর মর্দিনী দেবী দুর্গার দশটি হাত এবং মায়ের মুকুটের উপর থাকে শিবের ছোট মুখ। মহিষাসুর বধের কাহিনী অনুযায়ী সকল দেবতা মিলে দেবীকে দশ রকম অস্ত্র দিয়েছিলেন, যেমন ইন্দ্র দেবীকে বজ্র দিয়েছিলেন, বরুণদেব শঙ্খ দিয়েছিলেন, অগ্নিদেব একটি ক্ষেপণাস্ত্র বা বর্শা দিয়েছিলেন, বায়ু একটি ধনুক এবং তীর দিয়েছিলেন, বিশ্বকর্মা দেবীকে নিজের কুঠার এবং একটি বর্ম দিয়েছিলেন এবং পাহাড়ের অধিপতি দেবীকে একটি সিংহ দিয়েছিলেন।

দেবী দুর্গা প্রতিমা বর্ণনা

তাই মূর্তিতেও দেবী দুর্গার ১০ হাতে থাকে দশ প্রকার অস্ত্র শক্তি। মূর্তিতে দেবীর মুখমণ্ডলের আদল রাখা হয় মায়ায় পরিপূর্ণ, কুমোরেরা যেন হাতের জাদুতে মায়ের মৃন্ময়ী রূপকে চিন্ময়ী করে তোলে। বিভিন্ন জায়গার ভিন্ন ভিন্ন ক্লাবের উদ্যোগে মা দুর্গার আরাধনার জন্য প্যান্ডেল তৈরি করে ষষ্ঠীর দিন প্রতিমা স্থাপন করা হয়, দশমীর দিন অবধি পুজো চলে, শেষে সিঁদুর খেলার পর প্রতিমার বিসর্জন দেওয়া হয়, ক্লাবের সকল সদস্য মিলে আনন্দ সহযোগে মায়ের প্রতিমা জলে ভাসিয়ে বিদায় দেন।

দূর্গাপূজার বিবরণ, Details of Durga Puja

দূর্গা পূজার চারটি দিন বাঙালিরা নিষ্ঠা ও শ্রদ্ধা পূর্বক পূজা সম্পন্ন করে। শাস্ত্র অনুসারে সকল রীতি নিয়ম সঠিকভাবে পালন করা হয়। পূজার দিনগুলিতে, চন্ডীপাঠ, মন্ত্রপাঠ, ধূপ, ধূনো, চন্দনের সুগন্ধীর সাথে ঢাকের এবং কাঁশির আওয়াজ যেন চারপাশ মাতিয়ে তোলে আনন্দের আবহে। বাঙালিদের মধ্যে দূর্গা পূজার অনুষ্ঠানাদি শুরু হয়ে যায় ষষ্ঠী থেকেই।

মহাষষ্ঠীর দিন দেবীর বোধন হয় ,সপ্তমীতে নবপত্রিকা স্নান, অষ্টমীতে কুমারী পূজা, শাস্ত্রমতে এই কুমারী পূজার উদ্ভব হয়েছিল বানাসুর বধ করার মধ্য দিয়ে। পুরাণে এক গল্পে বর্ণিত রয়েছে যে,  বানাসুর এক সময় স্বর্গ-মর্ত্য অধিকার করে নেওয়ায় বাকি সকল বিপন্ন দেবগণ মহাকালীর শরণাপন্ন হন। তখন দেবগণের আবেদনে সাড়া দিয়ে দেবী পুনর্জন্ম নিতে কুমারীরূপে বানাসুরকে বধ করেন।

দূর্গাপূজার বিবরণ

এরপর থেকেই মর্ত্যে কুমারী পূজার প্রচলন শুরু হয়। অষ্টমী ও নবমীর, সন্ধিক্ষণে হয় সন্ধিপূজো, নবমী দিন মহাপ্রসাদ আয়োজন এবং বিজয়া দশমীর দিন হয় দেবীর বিসর্জন। দশমীতে মাকে বিদায় জানতে সকলে মিলে সিঁদুর খেলায় অংশ নেন, সকলে মিলে মিষ্টিমুখ করেন, আর সাথে আশা করে থাকেন যে ‘ আসছে বছর আবার হবে ‘। 

 উপসংহার, Conclusion 

দুর্গাপূজা এমন এক উৎসব যেখানে ধনী-দরিদ্র, জাতি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল ভেদাভেদ দূরে সরিয়ে রেখে সবাই মিলেমিশে একসাথে পরমানন্দে সামিল হয়। এই উৎসবের সময় পরিবারের সকলে একসাথে অনেক আনন্দ করেন, নতুন জামা পরে ঠাকুর দেখতে যাওয়া থেকে নানা রকমের খাবার খাওয়া তথা আত্মীয়স্বজনের ও বন্ধু-বান্ধবের সাথে আনন্দ ও সকলের মঙ্গল কামনা করার মধ্য দিয়েই রয়েছে দুর্গাপূজার সার্থকতা।

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts