“বর্ষা শেষে রাণীর বেশে
এলো শরৎ এলো,
ধানের ক্ষেতে উঠলো মেতে
বাতাস এলোমেলো।
এলোমেলো তাইতো হলো সবার রাঙা মন,
রাঙা হলো গগনতল বন-উপবন।”
বর্ষণক্ষান্ত আকাশের পটভূমিকায় রৌদ্রবসন শরতের এই উদার আনন্দময় আবির্ভাব সত্যি নয়নাভিরাম। ঋতু-রঙ্গমঞ্চে যখন বর্ষার বিষণ্ণ-বিধুর নিঃসঙ্গতা আর নেই, তখনই নিঃশব্দ চরণ ফেলে শরতের আবির্ভাব। মুখে যেন থাকে তার প্রসন্ন হাসি। অঙ্গে তার স্বর্ণবরণ মোহন কান্তি। তার স্নিদ্ধ রূপ-মাধুর্য সহজেই আমাদের মনকে প্রসন্ন করে দিয়ে সকল ক্লান্তি যেন দূর করে দেয়। শরৎকাল জুড়ে সকলের মনই আনন্দের আতিশয্যে পরিপূর্ণ থাকে। উৎসব উদযাপন তথা প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ সবকিছু মিলিয়ে এই ঋতু হয়ে ওঠে সকলের প্রিয়।
শরতের রূপরাশি, Colourful autumn
শরৎ পূর্ণতার ঋতু! এই ঋতুর পদার্পণ হয় হালকা চপলা ছন্দে। শরৎ কালের শুভ্রতা গাছের পাতায় ঝকঝকে রোদের ঝিলিক দেখা দিতে শুরু করে, ভরা নদীর পূর্ণতা আসে, নদীতীরে ফুটে ওঠে অজস্র কাশফুল, গাছে ভরে থাকা শিউলি ফুলের বাহার ও সুগন্ধ, আর নীল আকাশ জুড়ে তুলোর মতো শুভ্র মেঘ ভেসে যাওয়া জানিয়ে দেয় শরৎ এসে গেছে। তাই রৌদ্রবরণ, শুভ্রতার প্রতীক শরৎই সকলের প্রিয় ঋতু।
শরৎ ঋতুর পর্যায়কাল ও বৈশিষ্ট্য, characteristics of autumn season
বর্ষার অবসান ঘটিয়ে ঋতুচক্রের তৃতীয় ঋতু শরৎ এক অপূর্ব শোভা ধারণ করে আবির্ভূত হয়। ভাদ্র ও আশ্বিন মিলে শরৎকাল। শরৎকালে বনে-উপবনে শিউলি ফুল ছাড়াও আরো বহু ফুল ফুটে থাকে, যেমন : গোলাপ, বকুল, মল্লিকা, কামিনী, মাধবী প্রভৃতি; যা প্রকৃতির রূপকে আরো মনোহর করে তুলে।
বিলে- ঝিলে ফোটে থাকে শাপলা। ভোরে উঠে দেখা যায় যে হালকা কুয়াশায় ঘেরা থাকে চারপাশ। ঘাসে ঘাসে শিশিরের বিন্দু সূর্যোদয়ের সাথে যেন ঝিকমিক করে ওঠে। গাছে গাছে, ডালে ডালে, দোয়েল পাপিয়ার প্রাণমাতানো সুরমূর্ছনা। নৈশ নীলাকাশে রজতশুভ্র জোছনার উদাস-করা হাতছানি। শারদ-লক্ষ্মীর এই অপরূপ রূপলাবণ্য মর্ত্যভূমিকে করেছে এক সৌন্দর্যের অমরাবতী। শরৎকাল নিয়ে কবিগুরু লিখেছেন,
” শরৎ, তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে-
বনের পথে লুটিয়ে-পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি।”
শরতের রাত, Autumn night
শরতের রাত স্নিগ্ধতা আর কোমলতার এক অপূর্ব রূপ নিয়ে আসে। শরৎ-রাত্রির চাঁদ যেন সারা রাত ধরে মাটির শ্যামলিমায় ঢেলে দেয় জ্যোৎস্নাধারা। পরিবেশ থাকে নাতিশীতোষ্ণ। মাঝে মাঝে বয়ে যায় স্নিগ্ন বাতাস, আর এই হাওয়া যেন দূর থেকে বয়ে নিয়ে আসে শিউলির সুবাস।
তখন মন যেন কিছুতেই আর ঘরে আটকে থাকতে চায় না। কেবলই ছুটে যেতে চায় বাইরে। ঝকঝকে জোছনায় পাখিদের ভ্রম হয়। ভোর হয়ে গেছে ভেবে ডেকে ওঠে কাক। ভোর হতে না হতেই ডালে ডালে সেজে থাকা শিশিরসিক্ত শিউলি ঝরে পড়ে সবুজ ঘাসে। এসব দেখে কবি-হৃদয় চঞ্চল হয়ে ওঠে, আর তারা লেখতে শুরু করেন কবিতা কিংবা গান। শরতে কেবলি বর্ণের স্নিগ্ধতা আর উদারতা। সবুজ, নীল আর সাদার এমন অপূর্ব সমন্বয় আর কোনো ঋতুতে দেখা যায় না। প্রকৃতি যেন আপনার হৃদয় উজাড় করে মেলে ধরে এই শরতে।
শরতের উৎসব, festivals of Autumn season
শরতের মূর্তিতে নিহিত রয়েছে একটি পরিতৃপ্তির হাসি। বর্ষার আলো আঁধারি ক্রীড়ার সমাপ্তিতে শরতে আলোকের মেলা বসে। শরৎ তাই আলোর শিশু। তার আগমনে বিশ্ব চরাচরে মধুর আনন্দের সাড়া পড়ে যায়। সে আনন্দের অভিব্যক্তি ঘটে নানা উৎসব অনুষ্ঠানে। শরৎ কলে ধীরে ধীরে উৎসবের সাজে সেজে ওঠে শস্যবিচিত্রা ধরিত্রী।
আকাশে-বাতাসে ভেসে বেড়ায় মধুর আগমনী গান। মানুষের মনে লাগে উৎসবের রঙ। আনন্দের সঞ্চার হয় সকলের মধ্যে। আসন্ন উৎসবের আনন্দ-জোয়ারে প্লাবিত হয় সকলের হৃদয় ও মন। বাঙালির মধ্যে শ্রেষ্ঠ তথা প্রিয় উৎসব হল শারদ-উৎসব ওঠার দুর্গাপূজা, যার আয়োজনে মুখরিত হয় বাংলার গ্রাম-নগর।
দিকে দিকে যেন পুজোর আনন্দ-স্রোত, কলোচ্ছ্বাস বয়ে যায়। শরতের এই অনুপম রূপ-বৈভবের মাঝখানে বাঙালির মনে যেন বেজে ওঠে ছুটির বাঁশি। পুজোর সময় বেশ কিছুদিনের ছুটি পেয়ে অনেকেই গৃহবন্দী জীবনের ক্লান্তি ভুলতে দূর-দূরান্তরে বেরিয়ে পড়ে। তাইতো শরৎ ছুটির ঋতু, অবকাশের ঋতু, যা বাঙালির মনকে করেছে সৌন্দর্যের তীর্থাভিমুখী। তাই কবি লিখেছেন
‘শরতের রৌদ্রের দিকে তাকাইয়া মনটা কেবল চলি চলি করে- বর্ষার মতো সে অভিসারে চলা নয়, সে অভিমানের চলা।’
শারদীয় সাহিত্য, Sharodiyo sahityo
শারদীয় দুর্গোৎসব এর পূর্বে পত্রিকার সাথে শারদ সংখ্যা হিসেবে একটি বই প্রকাশিত হয়। এটা হয়তো সকল বাঙালি দেখে থাকবেন। রং-বেরংয়ের পাতায় ভিড়ে থাকে সেই বই। ছোটো বড় বিভিন্ন লেখকের লেখায় পরিপূর্ণ বইটি পাঠকদেরকে আনন্দ দেয়। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসবকে স্মরণীয় ও সার্থক করে তোলার জন্য বাঙালি কবি সাহিত্যিকের দল তাঁদের বরণীয় রচনা-সম্ভারে পরিপূর্ণ করে তোলেন সংবাদ-সাময়িকীর শারদ সংখ্যাগুলো।
লেখকগণ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে তুলে ধরেন তাঁদের নতুন নতুন সৃষ্টি। নব নব ভাবনাচিন্তার ফসল পেয়ে পাঠক-মনও পরিতৃপ্ত হয়। রূপে-রসে রঙে-বৈচিত্র্যে মাখামাখি শারদসংখ্যাগুলোর এই শরৎকালেরই আবির্ভাব। এগুলোও শারদ-উৎসবের এক অনন্য সম্পদ হিসেবেও বিবেচিত।
শরতের অর্থনৈতিক অবদান, Economic aspects of autumn season
মাঠে মাঠে নবজীবনের আশ্বাস। বর্ষায় যে বীজ বপন, হেমন্তে যে পাকা ফসলের পরিণত-প্রতিশ্রুতি, শরতে তারই পরিচর্যা। সেই আশ্বাসের নিবিড় স্পর্শে বাঙালির মুখে ফুটে ওঠে উৎসবের অমলিন হাসি। শরৎ আনন্দের অগ্রদূত, বাঙালির উৎসবের বার্তাবহ, তার সচ্ছলতার নিপুণ কারিগর। তাছাড়া এই ঋতুতেই বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপূজা উপলক্ষে মৃৎশিল্প, মণ্ডপ সজ্জার কারিগর, ঢাকি, কাপড় ব্যবসায়ী সহ আরো বহু ছোটো বড় ব্যবসার ক্ষেত্রে লাভের মুখ দেখেন ব্যবসায়ীরা।
উপসংহার, Conclusion
জগতে কোনো কিছুই স্থায়ী নয়। তাই শরতের প্রসন্নতাও একসময় স্তিমিত হয়ে পড়ে। অন্য ঋতুর আগমনে শরৎ বিদায় নেয়। সকলের মনে অপেক্ষা শুরু হয় পরের বছরে আবারও এই ঋতুর প্রকৃতিকে অনুভব করার। শরতের বিদায় আনন্দমুখর উৎসব-সমারোহ থেমে যায়। এ যেন কালচক্রের আবর্তনে শুধুই পট-পরিবর্তন।
শরৎ বিদায়ের লগ্নে পথে পথে রেখে যায় ম্লান, ঝরা শেফালি, বিষণ্ণ কাশের গুচ্ছ, আর মাঠভরা নতুন ধানের মঞ্জুরি সকলের মনের কোণে যেন জমে থাকে বিদায় মুহূর্তের বিষণ্ণতা।
সর্বত্রই বিরাজ করে উৎসব শেষের অশ্রুবিধুর আকুলতা। মনের এমন অবস্থা হবে নাই বা কেন ! শরৎ যে আমাদের প্রাণের ঋতু! আমার প্রিয় ঋতু। ষড়ঋতু নানা বর্ণ-গন্ধ গানের সমারোহে নিত্য-আবর্তিত হয়ে চলে প্রকৃতি। কিন্তু এই সমারোহ উপভোগ করা যায় মূলত গ্রামেগঞ্জেই, কারণ শরৎ ঋতুর মনোরম প্রকৃতির সাদর নিমন্ত্রণ শহরবাসী ও শহরমুখী বাঙালিরা আজ এসব আর অন্তরে অনুভব করে না।