ভূমিকম্প রচনা, Earthquake essay  in Bengali 

ভূমিকম্প রচনা

প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে অন্যতম হল ভূমিকম্প, কারণ একটা ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প নিমেষে ধ্বংস করে দিতে পারে সবকিছু। ভূমিকম্পের ফলে ভূমিরূপের পরিবর্তন সাধিত হয়, ভূপৃষ্ঠে থাকা সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং মানুষ তথা অন্যান্য জীবের প্রানহানী ঘটে।

সারা পৃথিবীব্যাপী রোজই হয়তো অসংখ্য ভূমিকম্প সংঘটিত হয়ে থাকে, কখনো হালকা কম্পন কখনও বা ভয়ঙ্কর। তবে ভূমিকম্প কিভাবে এবং কেন হয় তা হয়তো অনেকেই জানেন না। এটা মূলত ভূ- অভ্যন্তরে শিলাস্তরের স্থিতিশীলতার বা অভিকর্ষীয় ভারসাম্যের বিঘ্ন ঘটার ফলে ভূপৃষ্ঠে সৃষ্ট কম্পন।

ভূমিকম্প কি ? What is earthquake?

ভূ-অভ্যন্তরে কখন কি হচ্ছে তা আমরা কেউ জানিনা। তাই সর্বদা ভূমিকম্পের কারণ বুঝতে পারা যায় না। তবে ভূ-অভ্যন্তরে শিলাস্তরের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ফলেই সাধারণত ভূমিকম্প হয়। এক কথায় ভূগর্ভে সৃষ্ট কোন কারণ বশত ভূপৃষ্ঠের কোন স্থান যদি ক্ষনিকের জন্য কেঁপে ওঠে, তখন তাকে ভূমিকম্প বলা হয়। 

ভূমিকম্প কি

ভূমিকম্পের কেন্দ্র, source of earthquake

ভূ-অভ্যন্তরের যে স্থানটিতে প্রথম ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়, তাকে বলা হয় ভূমিকম্পের কেন্দ্র। এই কেন্দ্র থেকেই ভূমিকম্প তরঙ্গের আকারে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তাই একটি নির্দিষ্ট স্থানে ভূমিকম্প শুরু হলেও বেশ দূর অবধি কম্পন অনুভূত হয়। ভূপৃষ্ঠ থেকে সাধারণত ১৬ কিলোমিটারের মধ্যেই পৃথিবীর অধিকাংশ ভূমিকম্প কেন্দ্রের অবস্থান থাকে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ভূমিকম্প কেন্দ্রের গভীরতা অনুযায়ী ভূমিকম্পকে তিনভাগে ভাগ করা হয়। যথা :

  • ১) অগভীর কেন্দ্র বিশিষ্ট ভূমিকম্প – এই ধরণের ভূমিকম্পের কেন্দ্র ভূপৃষ্ঠ থেকে খুব বেশি হলে ৭০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থান করে। তবে সাধারণত এই গভীরতা ৩০-৪০ কিলোমিটার থাকে।
  • ২) মাঝারি কেন্দ্র বিশিষ্ট ভূমিকম্প – এই ধরণের ভূমিকম্প কেন্দ্রের গভীরতা থাকে ৭০ কিমি থেকে ৩০০ কিমি পর্যন্ত।
  • গ) গভীর কেন্দ্র বিশিষ্ট ভূমিকম্প – এক্ষেত্রে গভীরতা ৩০০ থেকে ৭০০ কিমি হয়। 
ভূমিকম্পের কেন্দ্র

ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র, Epicenter of the earthquake

ভূমিকম্পের উপকেন্দ্রটি ভূপৃষ্ঠে ভূমিকম্প কেন্দ্রের ঠিক সোজাসুজি অবস্থিত স্থানটি যেখানে সর্বপ্রথম ভূ-কম্পন অনুভূত হয়, তাকে বলা হয় ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র। ভূমিকম্প কেন্দ্রের সবচেয়ে নিকটে ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র অবস্থিত হওয়ায়, ওই স্থানেই ভূমিকম্পের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি হয়। তবে উপকেন্দ্র থেকে যত দূরে ভূমিকম্পের তরঙ্গ যায় তীব্রতা সেই দূরত্বের সাথে ততই হ্রাস পেতে থাকে। 

ভূমিকম্পের তীব্রতা পরিমাপ করার পদ্ধতি, Methods of measuring the intensity of earthquakes

ভূমিকম্পের তীব্রতা পরিমাপ করার জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রের নাম রিখটার স্কেল। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চার্লস রিক্টার, ১৯৩৫ সালে ভূকম্পন মাপার জন্য এই স্কেলটি আবিষ্কার করেন। ভূমিকম্পের তীব্রতা অনুসারে রিক্টার স্কেলে ১ থেকে ১০ পর্যন্ত পরিমাপ করা যায়।

ভূমিকম্পের তীব্রতা পরিমাপ করার জন্য ব্যবহৃত যন্ত্রের নাম রিখটার স্কেল

ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা পরিমাপক স্কেল, how to measure Earthquake damage scale

ভূমিকম্পের মাত্রা বা কম্পনের কারণে হওয়া ক্ষয়ক্ষতির পরিমান পরিমাপ করার জন্য ব্যবহৃত হয় মার্সেলি স্কেল। ইতালির ভূকম্প বিশরদ গিউসেপ মার্সেলি এই স্কেল আবিষ্কার করেন। মার্সেলি স্কেলের মান ১ থেকে ১২ পর্যন্ত হয়ে থাকে। কম্পনের কারণে হওয়া ক্ষয়ক্ষতির পরিমান এর উপর ভিত্তি করে ১ থেকে ১২ অবধি পরিমাপ করা হয়।

ভূমিকম্পের কারণ সমূহ, causes of earthquake 

ভূমিকম্পের কারণ কখনই নির্দিষ্ট থাকে না। বিভিন্ন কারণে ভূমিকম্প সৃষ্টি হতে পারে। তবে ভূমিকম্পের কারণগুলিকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। সেগুলি হল – প্রাকৃতিক কারণ ও কৃত্রিম কারণ। প্রাকৃতিক কারণ বলতে স্বাভাবিক ভাবে সৃষ্ট বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে সৃষ্ট কারণগুলোকে বোঝায়, আবার কৃত্রিম কারণগুলো প্রধানত মানবসৃষ্ট হয়।

ভূমিকম্পের কারণ সমূহ

ভূমিকম্পের প্রাকৃতিক কারণ সমূহ, natural causes of  earthquake

১] পাতের  চলন জনিত ভূমিকম্প –

আমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো জানেন যে পৃথিবীর ভূত্বক কতগুলি ছোটো বড়ো চলনশীল পাতের সমন্বয়ে  গঠিত হয়েছে। সেই পাতগুলোর মধ্যে কখনো দুটি পাতের পরস্পরের দিকে বা পরস্পরের বিপরীত দিকে চলনের ফলে পাত সীমান্ত বরাবর ভূমিকম্প হয়ে থাকে, অর্থাৎ বলা যেতে পারে যে, এই পাত চলন জনিত কারনেই ভূমিকম্পের সৃষ্ট হয়। 

২] স্থিতিস্থাপক প্রত্যাঘাত মতবাদ –

আমেরিকার বিখ্যাত সিসমোলজিস্ট H. F. Ried পৃথিবীর ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প গুলির কারণ হিসাবে ‘স্থিতিস্থাপক প্রত্যাঘাত’ মতবাদ প্রকাশ করেন। তার মতবাদ অনুসারে ভূ- আন্দোলনের ফলে ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরীণ শিলাস্তরে প্রবল পীড়নের ফলে চ্যুতিতল বরাবর শিলার ভাঙন ও স্খলন ঘটলে আকস্মিক ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। 

৩] অগ্ন্যুৎপাত এর কারণে ভূমিকম্প –

আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত হওয়ার সময়ও ভূমিকম্প সৃষ্টি হতে পারে। সাধারণত যে সব আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণ সহকারে অগ্ন্যুৎপাত ঘটায়, তার আশেপাশে থাকা অঞ্চলগুলিতে বেশিরভাগ সময়ই প্রবল ভূমিকম্প অনুভূত হয়। 

৪] ভূগর্ভস্থ বাষ্পরাশির চাপে সৃষ্ট ভূমিকম্প –

অনেক সময় ভূগর্ভের মধ্যে সঞ্চিত থাকা বাষ্পপুঞ্জের পরিমান অত্যাধিক হয়ে যায়, তখন তা শিলাস্তরে প্রবল বেগে ধাক্কা দেয়, যার ফলে ভূমিকম্প অনুভূত হয়। 

৫] তাপীয় সংকোচন এর কারণে সৃষ্ট ভূমিকম্প –

পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে তাপ বিকিরনের মাধ্যমে উতপ্ত অবস্থা থেকে ক্রমশ শীতল হয়ে চলেছে। তবে একটা কথা আমরা সকলেই জানি যে পৃথিবীর উপরিভাগ শীতল ও কঠিন হয়ে গেলেও অভ্যন্তরভাগ এখনো অত্যধিক উত্তপ্ত রয়েছে, এর ফলে উপরের ও নিচের স্তরের মধ্যে আয়তনেরও ভারসাম্য নষ্ট হয়, আর এই ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য ভূপৃষ্ঠের কিছু অংশ অবনমিত হয়ে গিয়ে ভাঁজের সৃষ্টি করে। এরূপ পুনর্বিন্যাস হওয়ার সময় মাঝে মাঝে ভূমিকম্প হতে পারে। 

৬] ধ্বস পড়ার কারণে ভূমিকম্প –

পার্বত্য অঞ্চলে বা ভূপৃষ্ঠের যেকোনো অঞ্চলে যখন ধ্বস নামে এবং তার ফলে খাড়া ঢাল বরাবর বিশাল পাথরের স্তূপ প্রবলবেগে নিচে পতিত হয়, তখন এই পতনের প্রভাবেও ভূকম্পন অনুভূত হয়। তাই এই পরিস্থিতিকেও ভূমিকম্পের একটি কারণ বলা যেতে পারে।

৭] হিমানি সম্প্রপাত এর ফলে সৃষ্ট ভূকম্পন-

শীতপ্রধান দেশে বা রাজ্যে সুউচ্চ পর্বতমালা যখন বরফাচ্ছন্ন হয়ে থাকে, তখন যদি পর্বতের শিখর থেকে বিশাল বরফের স্তূপ কোনোও কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রবল বেগে নিচে পতিত হয়, তাকে হিমানি সম্প্রপাত বলে। এমন পরিস্থিতিতেও মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়। 

ভূমিকম্পের মনুষ্য সৃষ্ট কারণ সমূহ, man made causes of earthquake 

১] ভূগর্ভে বিস্ফোরণ হওয়ার ফলে সৃষ্ট ভূকম্পন-

বিভিন্ন দেশ বর্তমান সময়ে প্রায়ই ভূগর্ভে পারমানবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে থাকে, যার কারণে সেই বিস্ফোরণ কেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে তীব্র ভূকম্পন অনুভূত হয়। 

২] কৃত্রিম জলাধার নির্মাণ –

নদীতে বাঁধ দিতে গিয়ে কৃত্রিম জলাধার নির্মাণ করার ফলে জলাধারে সঞ্চিত জলের প্রচন্ড চাপে তথা সেই স্থানের ভূ গঠন সুস্থিত না হলে ভূমিকম্প সৃষ্টি হতে পারে। 

ভূমিকম্পের ফলাফল, effects of earthquake

ভূমিকম্পের ফলস্বরূপ ভূপৃষ্ঠের নানা রূপ পরিবর্তন সাধিত হয়, তেমনি বহু প্রানহানি হয় ফলে জনপদও ধ্বংস হয়। ভূমিকম্পের ফলাফল গুলি হল –

  • ভূমিকম্পের ফলে ভূপৃষ্ঠে অসংখ্য ফাটল ও চ্যুতির সৃষ্টি হয়। চ্যুতির সৃষ্টি হলে ভূভাগ উপরে ওঠে বা নিচে নেমে স্তূপ পর্বত ও গ্রস্ত উপত্যকার সৃষ্টি করে। 
  • ধ্বস জনিত কারণে ভূমিকম্পের ফলে নদীর গতিপথ রুদ্ধ হলে নদী তার গতিপথ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়। 
  •  অনেক সময় সমুদ্র নিচে প্রবল ভূমিকম্প হলে সমুদ্র তলদেশের কোন অংশ উত্থিত হয়ে সামুদ্রিক দ্বীপ সৃষ্টি হয়, আবার অনেক সময় সমুদ্র মধ্যবর্তী অনেক দ্বীপ সমুদ্র তলদেশে অবনমিত হয়ে যায়। 
  •  সমুদ্র তলদেশে প্রবল ভূমিকম্প সংঘটিত হলে সমুদ্রের জল বিধবংসী তরঙ্গের আকারে উপকূলের দিকে এগিয়ে আসে। একে সুনামি বলে। 
ভূমিকম্পের ফলাফল

উপসংহার, Conclusion 

 ভূমিকম্প যেহেতু একটি আকস্মিক ঘটনা, তাই হঠাৎ করে যদি প্রবল ভূমিকম্প হয় তাহলে শহর ও নগর নিমেষে ধ্বংস স্তুপে পরিনত হয়ে যায়। পাশাপাশি অসংখ্য মানুষ, জীবজন্তু মৃত্যু মুখে পতিত হয়, বহু জীব বিলুপ্ত হয়ে যায়। রাস্তাঘাট, রেল, বাঁধ, সেতু ইত্যাদি অনেক কিছু ধ্বংস হয়ে যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে আমরা আটকাতে পারবো না কিন্তু মনুষ্য সৃষ্ট কারণ নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের হাতে। তাই আমাদের কারণে যেন প্রকৃতির কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

Contents show

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts