“পৃথিবীরই কোনো গভীর অরণ্যতে…
যেখানে এখনো অঝোরে বৃষ্টি নামে,
আপন মনেই বেড়ে ওঠে বুনো লতা-
আমিও সেখানে অরণ্য-তরু হয়ে
পালন করবো সীমাহীন নীরবতা…”
কথাগুলো পড়লে মনে যেন এক গভীর অরণ্যের চিত্র ভেসে ওঠে, কিন্তু পৃথিবীতে হয়তো এখন আর গভীর অরণ্য বলে কিছু নেই। অরণ্য সংরক্ষণ প্রয়োজনীয়, কারণ সারা বিশ্বব্যাপী প্রতিনিয়ত অবিবেচনা প্রসূত যে পরিমানে বৃক্ষ কাটা হচ্ছে, এর ফলে পরিবেশের উপর যে বিরূপ প্রভাব তা এখন সর্বস্তরের মানুষ বুঝতে পারছেন। তাই অরণ্য সংরক্ষণ করার পাশাপাশি বনসৃজন জরুরী। অরণ্য সংরক্ষণের বিভিন্ন উপায় রয়েছে যা অবলম্বন করে গাছপালা রক্ষা করা সম্ভব।
অরণ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা, Necessity of forest conservation
অরণ্য ধ্বংসের ফলে উষ্ণতার তীব্রতা দিন দিন বেড়ে চলছে, দেখা যাচ্ছে বৃষ্টিপাতের অনিয়ম, শীতের প্রভাব গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলগুলিতে কম হয়ে যাচ্ছে, মরুভূমির প্রসার ঘটছে এবং সর্বপরি জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে, যা মানুষকে সময়ের সাথে সাথে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। বনভূমির যথেচ্ছ ধ্বংসসাধনের ফলে পৃথিবীতে প্রয়োজনীয় কাঠের সরবরাহের অভাব ঘটছে; পাশাপাশি বায়ুদূষণ , অনাবৃষ্টি , বন্যা , ভূমিক্ষয় , জমির উর্বরতা হ্রাস প্রভৃতি নানা সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে।
তাই বর্তমানে মনুষ্য প্রজাতিকে রক্ষা করার জন্য বৃক্ষচ্ছেদন বন্ধ করে অরণ্য সম্পদের সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাছাড়া আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথেও অরণ্যের সম্পর্ক রয়েছে। গাছগুলো প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় জলীয়বাষ্প বাতাসে ছেড়ে বৃষ্টি ঘটাতে সাহায্য করে, আর গাছ কেটে অরণ্য ধ্বংসের ফলে বৃষ্টি কম হয়, ফলে খরা দেখা দিতে পারে। অন্যদিকে গাছের মূল মাটির কণাগুলোকে দৃঢ়ভাবে আটকে রেখে ভূমিক্ষয় রোধ করে ফলে বন্যার আশঙ্কা কম হয়ে যায়।
মাটিতে জৈব পদার্থ সংযোজন করে অরণ্য ভূমির উর্বরতা বাড়ায় । এছাড়া অরণ্যে প্রয়োজনীয় কাঠ ছাড়াও আরো বিভিন্ন উপজাত দ্রব্য যেমন — মধু , মোম , লাক্ষ , রবার ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়, ফলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সুবিধা হয়। এই সব কারণে অরণ্য সংরক্ষণ খুব প্রয়োজন।
অরণ্য সংরক্ষণের উপায় সমূহ, various ways to conserve forest
আমাদের অরণ্য সম্পদ তথা প্রাকৃতিক পরিবেশকে রক্ষা করতে গেলে অরণ্য সংরক্ষণ বা বন সংরক্ষণ অবশ্যই দরকার। বিভিন্ন উপায়ে অরণ্য সংরক্ষণ করা যায়। অরণ্য সংরক্ষণের পদ্ধতি গুলি হলো-
বনসৃজন
ধ্বংস হয়ে যাওয়া অরণ্য ফিরে পেতে নতুন করে বনভূমি সৃষ্টি করা যায়, এভাবে অরণ্য সংরক্ষণ সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন ফাঁকা জমি, পতিত জমি ও অলাভজনক কৃষিজমি, যেখানে নতুন নতুন গাছ লাগিয়ে বনভূমি গড়ে তোলা সম্ভব, ফলে গাছের সংখ্যা বেড়ে যাবে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সহজ হবে।
পরিণত বৃক্ষচ্ছেদন ও চারাগাছ প্রতিস্থাপন
বনভূমি থেকে অনেক সময় পরিণত গাছগুলি কাটা হয়, কিন্তু অনেক সময় গাছগুলো এমন ভাবে কাটা হয় যে আশে পাশের চারাগাছ নষ্ট হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে ওই পরিণত গাছগুলি এমনভাবে কাটতে হবে যাতে ছোটো গাছগুলি নষ্ট না হয় বা মারা না যায়, বড় গাছ কাটতে গিয়ে ছোটো গাছের যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা উচিত। পাশাপাশি কাটা গাছের জায়গায় নতুন চারাগাছ রোপণ করে বনভূমি সংরক্ষণ করা যায়।
উদ্ভিদের রক্ষণাবেক্ষণ
অনেক সময় পোকামাকড়ের আক্রমণে গাছ মরে যায়, এর থেকে গাছকে ওষুধ প্রয়োগ করে রক্ষা করা সম্ভব। রোগগ্রস্ত একটি উদ্ভিদ আশে পাশের অন্য গাছগুলির মধ্যেও রোগ ছড়াতে পারে। রোগগ্রস্ত উদ্ভিদকে চিহ্নিত করে তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, যাতে গাছ ধ্বংস রোধ করা যায়।
ঝুম চাষ বন্ধ
পাহাড়ি এলাকায় ঝুম চাষ খুব প্রসিদ্ধ, তবে এর জন্য বনভূমি পরিষ্কার করতে হয়, ফলে এই ঝুম চাষ করতে গিয়ে গাছপালা কাটতে হয়। এই চাষ পদ্ধতি বন্ধ করা জরুরি যাতে অরণ্য ধ্বংস রোধ করা যায়। গাছপালা রক্ষার্থে আইন করে ঝুম চাষ বন্ধ করা উচিত।
কাঠের বিকল্প দ্রব্যের ব্যবহার বৃদ্ধি
অনেকেই নিজের বাড়িতে বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাঠের আসবাবপত্র ব্যবহার করেন, সেক্ষেত্রে লোহা, স্টিল, অ্যালুমিনিয়াম, প্লাস্টিক ইত্যাদির তৈরি আসবাবপত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পেলে কাঠের চাহিদা কম হয়ে যাবে, ফলে কাঠ উৎপাদনের জন্য বনভূমি ধ্বংস হ্রাস পাবে।
কাঠ চুরি প্রতিরোধ করা
বনভূমি বা অরণ্য থেকে দিনের পর দিন প্রচুর পরিমাণে কাঠ চুরি হয়। এই সমস্যা রোধ করতে বনের গাছগুলো সংরক্ষণ করার জন্য রক্ষী নিয়োগ করে কিংবা বনভূমির আয়ের কিছু অংশ দিয়ে সরকার যদি স্থানীয় অধিবাসীদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেয় তবে কাঠ চুরি প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে এবং অরণ্যের গাছগুলো ধ্বংস হাওয়া থেকে রক্ষা পাবে।
দাবানল প্রতিরোধ
প্রাকৃতিক কারণেই হোক কিংবা মনুষ্যসৃষ্ট কারণেই হোক না কেনো, বনভূমিতে আগুন লেগে গিয়ে দাবানলের সৃষ্টি হয়, যার ফলে বনভূমির গাছপালা ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। দাবানল থেকে বনভূমিকে রক্ষা করার জন্য বনভূমির শুকনো ডালপালা, পাতা, আগাছা ইত্যাদি নিয়মিত পরিষ্কার করে রাখা জরুরি ও অরণ্যের স্থানে স্থানে সর্তকতা ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরী।
বনভূমিতে পশুপালন নিষিদ্ধকরণ
বনভূমিতে অনেকেই পশুচারণ করে থাকেন। এই পশুগুলো ঘাস খাওয়ার পাশাপাশি বনভূমির বহু চারা গাছ নষ্ট করে দেয়। অনেকেই চারা গাছ লাগিয়ে থাকেন বনায়নের উদ্দেশ্যে কিন্তু পশুগুলো সেই গাছ খেয়ে ফেলে যার ফলে বনসৃজনের প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে যায়। তাই বনসংরক্ষণ করতে হলে বনভূমিতে পশুচারন বন্ধ করতে হবে।
গাছ কাটার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার
বর্তমান প্রযুক্তি অনেক উন্নত, গাছ কাটার জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতি রয়েছে, যার সাহায্যে খুব সহজেই গাছ কেটে নেওয়া সম্ভব। কিন্তু এইসব আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে বনভূমি থেকে কাষ্ঠ আহরন করা উচিত না, কারণ এমনটা করার সময় আশেপাশের গাছেরও ক্ষতি হতে পারে, তাই গাছ এমনভাবে কাটা উচিত যাতে করে পাশাপাশি কোনো গাছের ক্ষতি না হয়।
বিকল্প জ্বালানীর ব্যবহার করা
জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করার জন্য কাঠ ব্যবহৃত হয়, কাঠের থেকে সহজলভ্য জ্বালানি হয়তো আর কিছুই নয়। অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলিতে মানুষ বনভূমি থেকে কাঠ সংগ্রহ করে এবং সেই কাঠ জ্বালানীরূপে ব্যবহার করে। এই সব দেশের অধিবাসীদেরকে যদি সস্তা দামে কোনো বিকল্প জ্বালানীর সন্ধান দেওয়া যায় তাহলে বনভূমি থেকে কাঠ আহরন করার পরিমান কম হবে এবং বনভূমি রক্ষিত হবে।
শেষ কথা, Conclusion
অরণ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা কি তা কাউকে বলে দিতে হয় না। সকলেই কম বেশি এর প্রয়োজনীয়তা কি তা জানেন। কিন্তু তবুও মানুষ বন ধ্বংস করেই চলেছে। এই ধ্বংসলীলা বন্ধ না করলে পরিবেশে ভারসাম্য বজায় রাখা কষ্টকর হয়ে উঠবে, আর এতে মানবজাতি বহু সমস্যার সম্মুখীন হবে। তাই নিজের স্বার্থেই আমাদের অরণ্য সম্পদ ধ্বংস না করে বরং তা রক্ষা করা উচিত। মনে রাখতে হবে “অরণ্য পরম বন্ধু, পৃথিবীর প্রাণ, আকাশে বাতাসে ভাসে অরণ্যের গান।” আর এই গানের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদেরকেই হয়ে উঠতে হবে বনভূমির রক্ষক।