১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটিয়ে আমাদের ভারত এক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি পায়। ভারতমাতার বহু বীর সন্তান তাদের বিপ্লবী রক্তের বিনিময়ে দীর্ঘ সংগ্রাম করে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। তাই এই দিনটি আমাদের সকলের কাছে একটি গর্বের দিন। স্বাধীনতা আমাদের সকলের কাছেই এক পরম কাঙ্ক্ষিত বিষয়। তবে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস সম্পর্কে বহু তথ্য রয়েছে, যা আমাদের জেনে রাখা উচিত। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে আলোচনা করবো।
ভারতের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আসার ঘটনা, The incident of coming under the chain of subjugation of India
কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন,
“স্বাধীনতার-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
কে বাঁচিতে চায় ?
দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,
কে পরিবে পায় ।।“
স্বাধীনতা ছাড়া কোন জাতিই বিশ্ব দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। দীর্ঘ সময় ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে থাকার পর ভারত স্বাধীন হতে পেরেছিল। তবে ভারতের এই স্বাধীনতা একদিনে আসেনি কিংবা কোনো অনুনয়-বিনয়ের মাধ্যমে আসেনি, বরং বহু বিপ্লবীর রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এসেছিল এই স্বাধীনতা।
দেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির এত বছর পরও ভারত মাতার বীর সন্তানদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা অটুট। ভারতবর্ষে ইংরেজরা সপ্তদশ শতক থেকে বাণিজ্য করার জন্য বসতি স্থাপন করে। তারপর তারা ধীরে ধীরে হাত বাড়ায় ভারতবর্ষে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করার দিকে। অবশেষে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয় যখন ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ঘটে। এই পরাজয়ের মাধ্যমেই ভারতের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়।
তারপর থেকে শুরু হয় ভারতীয়দের উপর ইংরেজদের শোষণ এবং অত্যাচার। ক্রমে সমৃদ্ধ ভারতবর্ষ থেকে সম্পদ লুট করতে শুরু করে ইংরেজরা, এভাবে ব্রিটেন ফুলে-ফেঁপে উঠতে শুরু করে। সেই সময়কালে ভারতবর্ষে দেখা দিতে শুরু করে একের পর এক মহামারী, খাদ্যাভাব, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি। ইংরেজ শাসন আমলে যতদিন গেছে ভারত দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়েছে।
ভারতবাসীর স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, Indian people’s desire for freedom
ভারতবাসী জড়িয়ে পড়েছিল পরাধীনতার বেড়াজালে, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ভারতীয়দের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে উঠেছিল। ইংরেজরা ভারতীয়দের মধ্যে পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃতির বিস্তার শুরু করে, যার মাধ্যমে ভারতবাসী জানতে পেরেছে ফরাসি বিপ্লবের কথা; তখন দেশের লোকজন বুঝতে পারে সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার গুরুত্ব।
তারপর থেকেই দেশবাসী ইংরেজ শাসকদের কাছে নিজেদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া পেশ করতে শুরু করে দেয়। সেই দাবিদাওয়াগুলির অনাদায়ের ফলস্বরূপ বহুবার ভারতবাসী রাস্তায় নেমেছে, বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে, আন্দোলন করেছে শাসকের বিরুদ্ধে। এইভাবে ধীরে ধীরে ছোটো বড় বিক্ষোভ মিছিল তথা প্রতিবাদের মধ্য দিয়েই বিপ্লবীরা একসময় বৃহত্তর আন্দোলন এবং সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়েছে।
বিপ্লবীদের আত্মবলিদান, Self-sacrifice of revolutionaries
অনুনয়-বিনয় এর মাধ্যমে বা দাবি-দাওয়া পেশ করে নয় বরং দীর্ঘ ১৯০ বছর ধরে স্বাধীনতালাভের চেষ্টায় বহু রক্ত ঝরেছে দেশজুড়ে। ব্রিটিশ শাসকদের শোষণের নাগপাশ দেশের উপর যখন তীব্র হয়ে চেপে বসেছিল তখন থেকেই ভারতবর্ষের মধ্যে ধীরে ধীরে ক্ষোভ দানা বেধেছে। এই ক্ষোভের প্রথম বহিঃপ্রকাশ দেখা দেয় ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের মাধ্যমে। মঙ্গল পান্ডে ব্যারাকপুর সেনাছাউনিতে বিদ্রোহের আগুন জ্বেলে দিয়েছিলেন।
তিনিই ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম শহীদ। তারপর থেকেই দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ধীরে ধীরে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। স্বাধীনতা লাভের আগে পর্যন্ত ইংরেজরা কোনোভাবেই আগুনকে নেভাতে পারেনি নি। দেশপ্রেমের এই আগুনে জাতিকে স্বাধীন করার আকাঙ্ক্ষায় একে একে আত্মাহুতি দিয়েছেন ক্ষুদিরাম বোস থেকে শুরু করে ভগৎ সিং অবধি বহু বিল্পবী।
স্বাধীনতার জন্য ব্যাপক গণ-আন্দোলন, Massive mass movement for independence
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে গান্ধীজীর হাত ধরে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সমগ্র দেশের মানুষ একযোগে আন্দোলনে শামিল হয়। গান্ধীজীর অহিংসা ও সত্যাগ্রহের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসেন অনেকেই। ক্রমে সমগ্র দেশ জুড়ে একের পর এক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে; যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল অসহযোগ, আইন অমান্য এবং ভারত ছাড়ো আন্দোলন।
উক্ত আন্দোলনগুলোতে ভারতবর্ষ হারিয়েছিল বহু বীর সন্তান। অন্যদিকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেন। দেশের মানুষজন দুই হাত তুলে স্বাধীনতার এই মহান সংগ্রামকে সমর্থন জানায়। দেখতে গেলে ১৮৫৭ সাল থেকে স্বাধীনতা লাভ অবধি চলেছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম।
১৮৫৭-র প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ, জালিয়াল ওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড (১৯১৯), অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০-২২), আইন অমান্য আন্দোলন (১৯৩০-৩৪), ভারত ছাড়ো আন্দোলন (১৯৪২-৪৪), কিষান আন্দোলন, আদিবাসী আন্দোলন, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (১৯৪৩-৪৫) প্রভৃতি বিদ্রোহী আন্দোলনের মাধ্যমে প্রাণ বলিদান দিতে হয়েছিল বহু দেশপ্রেমীকে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল কিছু মানুষের অব্যর্থ পরিশ্রম যার ফলেই ব্রিটিশদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল ভারতবাসী।
স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নাম হল : আবুল কালাম আজাদ, ময়না কুমারী, কমল নাথ তিওয়ারি, অরুণা আসফ আলি, অরবিন্দ ঘোষ, চন্দ্রশেখর আজাদ, অ্যানি বেসান্ত, রামপ্রসাদ বিসমিল, বিনায়ক দামোদর সাভারকর, মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবি, হরেকৃষ্ণ কোঙার, মাহমুদ হাসান দেওবন্দি, হুসাইন আহমদ মাদানি, উবায়দুল্লাহ সিন্ধি, যতীন্দ্র নাথ দাস, বটুকেশ্বর দত্ত, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, গোপালকৃষ্ণ গোখলে, হেমু কালানি, হাকিম আজমল খাঁ, মাওলানা শরিয়তুল্লাহ, মাওলানা আজাদ, মাওলানা আলাউদ্দিন, মাওলানা মহম্মদ আলি ও শওকত আলি, আব্দুল মজিদ, খান আব্দুল গফফার খান, নেতা আহমাদুল্লাহ, ওবায়দুল্লাহ সিঙ্গি, হাফেজ নিশার আলি বা তিতুমীর, বীরাপান্ডিয়া, কাট্টাবোমান, আসফাকউল্লা খান, সৈয়দ আহমদ খান, লক্ষ্মী বাঈ, ভি. ও. চিদাম্বরম পিল্লাই, লালা লাজপত রায়, শিবরাম রাজগুরু, আল্লুরি সিতারামারাজু, কাজী নজরুল ইসলাম, হাজি ওসমান সইত, দয়ানন্দ সরস্বতী প্রমুখ। স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশের সকল রাজ্যের মানুষ যোগদান করেছিলেন।
উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্য থেকে শুরু করে পশ্চিম-দক্ষিণ সহ সকল অংশের মানুষ স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্খায় উদগ্রীব হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন দেশকে স্বাধীন করার জন্য।
স্বাধীনতার পটভূমি, Independence background
ভারতবর্ষে একদিকে চলছিল ব্যাপক গণ-আন্দোলন, ইংরেজদের বিরুদ্ধে আজাদ হিন্দ ফৌজের আগ্রাসন, নৌ বিদ্রোহ; আর অন্যদিকে ইংরেজরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধাক্কা সামলাতে না পেরে ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দানে বাধ্য হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত স্বাধীনতার পূর্বে ভারতবর্ষ ভারত ও পাকিস্তান এই দুইটি দেশে ভাগ হয়ে যায়। অবশেষে দীর্ঘ ২০০ বছরের প্রতীক্ষার পর ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট মধ্যরাত্রে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৫ই আগস্ট জওহরলাল নেহেরু তিরঙ্গা পতাকা উত্তোলন করেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের বাঙালিদের ভূমিকা, Role of Bengalis in freedom struggle
বাংলার সুদীর্ঘকালের ইতিহাসে চোখ ফেরালে দেখা যায় যে, ভারতের নবজাগরণ শুরু হয়েছিল বাংলাতেই। প্রথম নবচেতনার উদ্বোধন করেছিলেন রাজা রামমোহন রায়। অন্যদিকে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্র দিয়ে বাঙালিদের জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। ক্রমে সিপাহী বিদ্রোহ, নীলচাষ বিদ্রোহ, স্বাধীনতার আকুতিকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের মধ্যে দিয়ে বাঙালিরাও পরাধীনতার জ্বালাকে প্রকাশ করেছিল।
১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন বাংলা ভাগ করতে চাইলে বাঙালিরা এর প্রতিবাদ জানায়। সভা, সমিতি, মিছিলের মধ্য দিয়ে এই প্রতিবাদ আরও গর্জে উঠে। কবিরা শুরু করেন বিদ্রোহী কবিতা রচনা, রচিত হয় দেশাত্মবোধের গান। স্বদেশী আন্দোলনের সময় থেকেই রবীন্দ্রনাথ জননায়ক হয়ে উঠেছিলেন। তিনি স্বদেশী চেতনায় বহু মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।
গান্ধীজিরর সত্যাগ্রহ আন্দোলন, লবণ আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলনও বাঙালি দেশ প্রেমিকের সহযোগিতায় এক অন্য মাত্রা নেয়। এছাড়াও ১৯৩০ সালে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে অবিভক্ত বাংলায় চট্টগ্রামে শুরু হয় সশস্ত্র সংগ্রাম। তৈরি হয় স্বদেশী সরকার। ১৯৪২ সালে দেশ জুড়ে শুরু হয় গণ বিপ্লব। তমলুকে মাতঙ্গিনী হাজরা ব্রিটিশ পুলিসের গুলিতে নিহত হন।
বাংলায় প্রথম শহীদ হন ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী। স্বাধীনতা লাভের জন্য বাংলার বহু বিপ্লবী তথা বীরাঙ্গনা আত্মবলীদান দেয়, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বাঘা যতীন, বিনয়-বাদল- দীনেশ, মাতঙ্গিনী হাজরা, সূর্যসেন, প্রীতিলতা, রাসবিহারী বসু, চারুচন্দ্র বসু, কল্পনা দত্ত, সুশীল সেনগুপ্ত, বসন্ত বিশ্বাস প্রমুখ; এছাড়াও আরও কত বিপ্লবী বাঙালি নিজের প্রাণকে আহুতি দিয়েছিলেন দেশের স্বার্থে তার কোন হিসেব নেই। তাই অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে বলতে হয় যে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বাঙালির অবদান অনস্বীকার্য তথা এই স্বাধীনতা সংগ্রামের সিংহভাগই ছিল বাঙালি।
উপসংহার, Conclusion
স্বাধীনতা দিবস এক অত্যন্ত আনন্দের দিন। তেমনই স্বাধীনতা সংগ্রামের আমাদের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল সময় ছিল যা আজ আমাদেরকে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছে। আমরা প্রতিবছর ১৫ই আগস্ট স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উদ্দেশ্য শ্রদ্ধা জানিয়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকি।
দেশের প্রধানমন্ত্রী এইদিনে দিল্লির লালকেল্লায় পতাকা উত্তোলন করে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। আমাদের সর্বদা মনে রাখা উচিত যে, যে স্বপ্ন আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামীরা দেখেছিলেন আমরা সেগুলিকে সার্থক করে তুলবো। সকলের মনে যেন এই কথা উচ্চারিত হয়,
“ভারত আবার জগত সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।।” দেশকে উন্নত করার চেষ্টায় ক্রমাগত কাজ করে যেতে হবে, দেশের স্বার্থে কাজ করে যাওয়া আমাদের কর্তব্য। এভাবেই আমরা বিশ্ব দরবারে নিজের শির উচুঁ রাখতে সক্ষম হব।