শরতের কাশফুল, Shoroter Kashful in Bangla font

শরতের কাশফুল

“শরৎ রানী যেন কাশের বোরখা খানি খুলে,

কাশ বনের ওই আড়াল থেকে নাচছে দুলে দুলে।

প্রথম কবে ফুটেছে কাশ সেই শুধুরা জানে,

তাইতো সেটা সবার আগে খোঁপায় বেঁধে আনে।”

নির্মলেন্দু গুণ।

প্রকৃতিতে যখন শরৎকাল আসে; তখন কাশফুলই জানিয়ে দেয় নিজের আগমনী বার্তা। এ ঋতুতে পালকের মতো নরম এবং ধবধবে সাদা রঙের কাশফুল ফোটে। বর্ষা ঋতুকে বিদায় জানিয়ে নীল আকাশে সাদা তুলার মতো মেঘের সঙ্গে কাশফুলের মৃদু বাতাসে দোল খাওয়া প্রকৃতিতে শুধুই মুগ্ধতা ছড়ায়। গ্রামবাংলায় বিশ্বাস করা হয়, কাশফুল মনের কালিমা দূর করে। তাই তো শুভ কাজে কাশফুলের পাতা বা ফুল ব্যবহার করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব এলাকায়ই কাশফুল দেখা যায়।

কাশফুল কত দিন থাকে? How many days does Kashful last?

আমরা প্রায়ই নদীর চরে অথবা ক্ষেত বা রাস্তার আশেপাশে কাশফুলের শুভ্র সারি দেখে থাকি। এই ফুলের সৌন্দর্য সর্বোচ্চ ২০-২৫ দিন থাকে।

কাশফুল কত দিন থাকে?

কাশ ফুলের রং কি? What is the colour of Kashful?

কাশফুল শরৎকালে দেখতে পাওয়া যায়। এই ফুলগুলো দেখতে সাদা, বাদামী, হলুদ, গোলাপি, নীল, বেগুনি, ফিকে লাল রংয়ের হয়ে থাকে । ফুলগুলো সাধারণত একক হয়ে থাকে।

কাশফুল কোথায় ফোটে? Where does kashful bloom?

কাশফুল উদ্ভিদটি উচ্চতায় সাধারণত ৩ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। গাছটির চিরল পাতার দুই পাশ বেশ ধারালো। কাশফুল মূলত ছন গোত্রীয় এক ধরনের ঘাস। নদীর ধার, জলাভূমি, চরাঞ্চল, শুকনো রুক্ষ এলাকা, পাহাড় কিংবা গ্রামের কোনো উঁচু জায়গায় কাশের ঝাড় বেড়ে ওঠে। তবে নদীর তীরেই এদের বেশি জন্মাতে দেখা যায়। এর কারণ হল নদীর তীরে পলিমাটির আস্তর থাকে এবং এই মাটিতে কাশের মূল সহজে সম্প্রসারিত হতে পারে।

কাশফুল কোথায় ফোটে?

কাশফুল কি কি কাজে ব্যবহৃত হয়, What is Kashful used for?

কাশ দিয়ে গ্রামের বধূরা ঝাঁটা, ডালি, মাদুর তৈরি করে থাকে। ঘরের চাল, বাড়ির সীমানার বেড়া ও কৃষকের মাথাল তৈরিতেও কাশগাছ ব্যবহার করা হয়।

কাশফুলের ঔষধি গুণ, Medicinal Properties of Kashful

কাশফুলের বেশ কিছু ঔষধি গুণ রয়েছে। যেমন— কারও পিত্তথলিতে যদি পাথর হয় তবে নিয়মিত গাছের মূলসহ অন্যান্য অঙ্গ দিয়ে ওষুধ তৈরি করে পান করলে পিত্তথলির পাথর দূর হয়। এছাড়াও কাশমূল বেটে চাইলে চন্দনের মতো নিয়মিত গায়ে মাখতে পারেন, এতে গায়ের দুর্গন্ধ দূর হয়। শরীরে ব্যথানাশক ফোঁড়ার চিকিৎসায় কাশের মূল ব্যবহৃত হয়।

কাশফুলের ঔষধি গুণ

সাহিত্য মাধ্যমে কাশফুলের উল্লেখ, References to Kashful through literature

সাহিত্যে নানাভাবে কাশফুলের কথা এসেছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন গ্রন্থ ‘কুশজাতক’ কাহিনী অবলম্বন করে ‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্য রচনা করেছিলেন। কাশফুল মনের কালিমা দূর করে, এর শুভ্রতা দেখে যেন মনের ভয় দূর হয়ে যায়, এর শুভ্রতা শান্তির বার্তা বয়ে আনে। 

সত্যজিৎ রায়ের পথের ‘পাঁচালী’ ছবির কথা হয়তো অনেকেরই মনে আছে। কাশবনের ভেতর দিয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে অপু আর দুর্গা। কাশবনের এই দৃশ্যটা নেওয়ার জন্য বছরখানেক সময় লেগেছে সত্যজিৎ রায়ের। তুমুল বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল কাশবনের সৌন্দর্য। তার পরের বছর আবার সেই একই জায়গায় কাশফুল ফোটার অপেক্ষায় থেকেছিলেন তিনি।

সাহিত্য মাধ্যমে কাশফুলের উল্লেখ,

কবি নির্মলেন্দু গুণ নিজের গ্রামের নামই রেখে দিয়েছেন ‘কাশবন’। নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে ছিল কবির জন্মস্থান, সেই গ্রামের নাম ছিল কাশতলা। পরবর্তীতে কাশফুলকে ভালোবেসে কবি গ্রামের নাম রেখেছেন কাশবন।

কাশবন কম হয়ে যাওয়ার কারণ, The reason for the reduction of kashaban

পরিবেশ ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে কাশবন কম হয়ে যাওয়ার মূল কারণ হল জলবায়ু পরিবর্তন।  প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা কোনো কিছুর বৃদ্ধিতে পরিবর্তন দেখা দিলে তার মূল কারণ প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্তনই নির্দেশ করে।

অন্যদিকে নদীর তীর ক্রমে মানুষের দ্বারা দখল হয়ে যাবার জন্যেও কাশফুল দিনদিন কমে এসেছে। শুধু জ্বালানি বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহারের জন্য নয়, বরং সৌন্দর্য প্রেমিদের মনের চাহিদার জন্য হলেও নদী তীরে দিগন্ত-বিস্তৃত কাশবন থাকা উচিত। জমি দখল আর নদের তীরে চাষাবাদ বেড়ে যাওয়ায় কাশবনের পরিধি কম হয়ে এসেছে।

শরৎ ঋতু ও কাশফুলের স্মৃতি, Memories of autumn season and flowers

শরৎ ঋতুর কথা মনে পড়লেই যেন আমাদের চোখের কোণে ভেসে উঠে ফুটন্ত সাদা কাশফুল, পাল তোলা নৌকার সারি, দূর আকাশের কোণে জমে থাকা ধূসর সাদা মেঘের ভেলার কথা। কখনো মিষ্টি রোদে আলোর খেলা আবার কখনো হঠাৎ বৃষ্টির হানা। মাঝে সাজেই দেখা যায় রৌদ্র মেঘের লোকুচুরি খেলা। শরতের কাশফুল অগোচরে হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায় প্রকৃতি প্রেমীদের মনে।

শরৎ ঋতু ও কাশফুলের স্মৃতি

নদীর ধারে, জলের ধারে, উপকূলেই এই ফুল স্বমহিমায় বিরাজমান। দূর থেকে কাশের বনে তাকালে মনে হয়, শরতের পেঁজা পেঁজা সাদা মেঘ যেন নেমে এসেছে ধরণির বুকে। একটু বাতাস পেয়ে দলে দলে কাশফুল যখন এদিক-ওদিক মাথা নাড়ায়, তখন মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। কাশফুলের এই সৌন্দর্য্য দেখলে কবি নির্মলেন্দু গুণ এর কবিতার পংক্তিগুলো মনে পড়ে যায়, 

ইচ্ছে করে ডেকে বলি, “ওগো কাশের মেয়ে―

আজকে আমার চোখ জুড়ালো তোমার দেখা পেয়ে

তোমার হাতে বন্দী আমার ভালোবাসার কাশ

তাইতো আমি এই শরতে তোমার কৃতদাস”

ঢাকার ভিতরে কাশফুল কোথায় আছে? Where is Kashful inside Dhaka?

ঢাকার কাছাকাছি ৯টি কাশবন আছে :

১) দিয়াবাড়ি

 দিয়াবাড়ির কাশবনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে অনেকেই সেখানে ছুটে যান। বেলা বাড়ার সাথে সাথে এখানে বিনোদনপ্রেমীদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। আর কাশবনের পাশে নদীর তীরের হিমেল বাতাস আলোড়িত করে দর্শনার্থীদের।

২) আফতাব নগর

রামপুরা ব্রিজ থেকে উত্তর পূর্ব দিকে অবস্থিত জহুরুল ইসলাম সিটির ভেতর দিয়ে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলে কাশবনের আরেক মহাসমুদ্র চোখে পড়ে। ঢাকার এত কাছে অবস্থিত আফতাবনগরের এই কাশবন জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে সৌন্দর্য প্রেমীদের কাছে অন্যতম।

৩) হযরতপুর

কেরাণীগঞ্জের হযরতপুরের কালিগঙ্গা নদীর তীরের বিস্তৃর্ণ ভূমিতে শরতের শোভা কাশফুল ফোটে। খেয়া নৌকায় নদী পার হলে দেখা মিলবে কাশবনের।

৪) ৩০০ ফিট সড়ক

প্রকৃতিপ্রেমী এবং ভোজন রসিকদের কাছে প্রসিদ্ধ ৩০০ ফুট সড়ক কাশফুল। কালো কুচকুচে পিচঢালা রাস্তার দুইপাশে শুভ্রতার সমারোহ মনকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় কল্পনার রাজ্যে।

৫) পদ্মা নদী

শরৎকলে পদ্মা নদীর আশেপাশে অনেক স্থানেই কাশফুল ফোটে। শুভ্র এই ফুলের সৌন্দর্য আহরণে চলে যেতে পারেন মাওয়ার শিমুলিয়া ঘাটে। সেখান থেকে নৌকা ভাড়া করে নদীতে ভ্রমণের সাথে সাথে খুঁজে নিন কাশবনের চর।

৬) মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ

নদীর তীরবর্তী বালুময় প্রান্তরে শরৎকালে কাশফুলের মেলা বসে। আর বুড়িগঙ্গা তীরের মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ যেন কাশফুলের এক রাজ্য স্বরূপ। 

৭) ধলেশ্বরী নদী

ধলেশ্বরী নদীর দুই তীরে প্রতিবছরই কাশফুল ফুটে থাকে। ঢাকা থেকে মাওয়া সড়ক যাওয়ার কুচিয়ামারা এলাকায়ও নদীর তীরে কাশফুল দেখা যায়।

৮) মায়াদ্বীপ

মেঘনার বুকে কাশফুলের মায়া ছড়িয়ে আছে মায়াদ্বীপ। এই দ্বীপে কাশফুলের সৌন্দর্য দেখার সাথে সাথে বোনাস হিসাবে এখানকার মানুষের জীবনযাত্রার সাথে পরিচিত হতে পারবেন।

তবে ঢাকা তথা বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন রাজ্য যেমন পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, ওড়িশাতেও কাশবন দেখতে পাওয়া যায়। 

ঢাকার ভিতরে কাশফুল কোথায় আছে

শেষ কথা, Conclusion 

নীল আকাশের নিচে সাদা কাশফুল যখন বাতাসে দুলতে থাকে; তখন মনে হয় শ্বেত বসনা একঝাঁক নৃত্যশিল্পী নৃত্য করছে। কাশফুল পছন্দ করে না এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর শোভা সকলেরই মন ছুঁয়ে যায়।

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts