২০২০ সালের করোনা মহামারীর সময়টাকে কারও পক্ষে ভুলে যাওয়া সহজ নয়। ২০২০ সালটি বিশ্বের কাছে একটি অভিশপ্ত বছর হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। অজানা অচেনা করোনা ভাইরাস হঠাৎ এসে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্তব্ধ করে দিয়েছিল সমগ্র বিশ্বের জীবনযাত্রা।
এই মহামারীর প্রকোপ প্রাথমিক পর্যায়ে রোধ করার জন্য সমগ্র বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশের সরকারের তরফ থেকে জারি করা হয়েছিল আংশিক তথা সম্পূর্ণ লকডাউন। এই লকডাউন স্বাভাবিক জীবনধারা প্রায় বদলেই দিয়েছিল। এক সময়ে খুব ব্যস্ত থাকা মানুষেরা গৃহবন্দি দশায় এসে পড়ে, এই পর্যায়ে মানুষের মনে অবসাদের অন্ধকার চেপে বসেছিল।
মহামারী এবং লকডাউন, Pandemic and Lockdown
২০২০ সালে সারা বিশ্বব্যাপী করোনা সংক্রমণ রোধ করার উদ্দেশ্যে মার্চ মাসের শেষের দিক থেকে লকডাউন জারি হয়েছিল। এই লকডাউন এর মধ্যে কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি এবং জরুরী পরিষেবা ছাড়া অন্য সবকিছুই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়।এদিকে মানুষ ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে পড়ে।
এমন অবস্থার কারণ এই ছিল যে, মহামারীর সংক্রমণ রোধের একমাত্র উপায় মানুষে মানুষে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা। বেশ কিছু দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় বহু মানুষের। তাই ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে সমগ্র সমাজ জুড়ে তৈরি হয় আশঙ্কার বাতাবরণ।
লকডাউনের ফলে মানসিক অবসাদ, lockdown and mental depression
লকডাউনের কারণে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার অনিবার্য ফল হিসেবে মানুষের জীবনে সৃতি হয়েছিল অসংখ্য সমস্যা। সেই সমস্যাগুলির মধ্যে অন্যতম এবং গুরুত্বপূর্ণটি হল মানসিক অবসাদ। লকডাউনের ফলে ঘরে দীর্ঘদিন ধরে বন্দী থাকতে হয়, ফলে ঘরে বসে বসে মানুষের মন ভারাক্রান্ত হয়ে অবসাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। এই মানসিক অবসাদ সমাজে বেশ নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে, যার স্বাভাবিক ফলস্বরূপ মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারিবারিক হিংসা, কলহ ইত্যাদি দেখা যায়।
দৈনন্দিন জীবনে স্তব্ধতা, Stagnation in daily life
লকডাউন ঘোষণা হওয়ার সাথেই সমগ্র দেশ তথা বিশ্ব জুড়ে হঠাৎ করেই নেমে আসে স্তব্ধতা। সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কার্যকলাপে বদল আসে। সমস্ত অফিস কাছারি, দোকানপাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গ্রন্থাগার, প্রেক্ষাগৃহ সবকিছুই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। পাশাপাশি বন্ধ হয়ে যায় সাধারণ গণপরিবহন ব্যবস্থাও।
রেল স্টেশন, বাজার, শপিং মল সর্বত্রই বিরাজ করছিল শ্মশানের নিস্তব্ধতা। রাস্তাঘাট ফাঁকা পড়ে থাকতো। মানুষ যাতে বাড়ি থেকে না বের হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্য প্রতিনিয়ত চলতে থাকে প্রশাসনিক টহলদারি। শুনশান রাস্তা, ঘরে বসে মাঝেমধ্যে শুধু অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শোনা যেত, যা মানুষের আশঙ্কাকে আরো বাড়িয়ে দিত।
মানুষের প্রয়োজনেই সমাজ সৃষ্টি হয়েছিল। স্বভাবতই মানুষ একা বাঁচতে পারে না। সমাজের বন্ধনহীন স্রোতে একা বাঁচা মানুষের পক্ষে খুব কঠিন, আর লকডাউন মানুষকে সমাজ থেকেই সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় পরিজনদের সাথে মেলামেশাও বন্ধ হয়ে যায়। এইভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য একা বাঁচতে ডিজিটাল মাধ্যম, ইন্টারনেট আর work-from-home সংস্কৃতির চোরাস্রোতে ভেসে যায় মানুষ।
Work-from-Home সংস্কৃতির বিস্তার, Spread of work-from-home culture
মহামারী রোধে লকডাউনের ফলস্বরূপ সমাজের সবচেয়ে অভিনব প্রাপ্তি হল work-from-home সংস্কৃতি। তবে মহামারীর পূর্বেও এই ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। লকডাউনের সময় সমাজ জুড়ে এই ব্যবস্থা রীতিমত এক সংস্কৃতির পর্যায়ে উন্নীত হয়। এই ব্যবস্থায় অফিস আদালতে না গিয়ে বাড়িতে বসে অফিসের কাজ ডিজিটাল মাধ্যমে তথা ইন্টারনেটের সাহায্যে সম্পন্ন করে নেওয়া যায়, এতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে, পাশাপাশি বেশ কিছু কাজ থামিয়ে রাখতে হয়নি। এই সংস্কৃতি বহু মানুষকে অবসাদ থেকে দূরে থাকতে সহায়তা করেছিল।
তবে বাড়িতে বসে উক্ত পদ্ধতিতে কাজ করা শুনতে যতটা সহজ মনে হয়, করতে গিয়ে ততটা প্রতিকূল। বাড়ির পরিবেশ এবং অফিসের পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা হয়, এটা সবাই জানে, সে কারণেই অফিসের কাজকে বাড়ির পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়া এতটা সহজ ছিল না। তবে সময়ের সাথে অনেকেই খুব সহজে ব্যক্তিগত সময় এবং অফিসের কাজ করার সময়কে আলাদা করতে সক্ষম হয় এবং ওয়ার্ক ফ্রম হোম ব্যবস্থায় অফিসের বেশ কিছু জরুরী কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন।
অনলাইনে ক্লাসের মাধ্যমে পড়াশুনা, education through online classes
লকডাউন হওয়ার সাথে স্কুল কলেজ ইত্যাদিও বন্ধ হয়ে যায় ফলে শিক্ষার্থীদের পড়াশুনায় বাধা সৃষ্টি হয়। ক্রমে সর্বত্র অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে স্কুল কলেজে শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়, ফলে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষাগত ক্ষতি থেকে কিছুটা বেঁচে যায়। যদিও প্রাথমিকভাবে এই পদ্ধতিকে সবাই একভাবে মেনে নিতে পারে নি। তবে সময়ের সাথে সাথে ছাত্র তথা শিক্ষকদেরকে অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা অনেকটা সহায়তা করে। নয়তো বহু শিক্ষক কর্মহীন জীবনে পিছিয়ে পড়তেন, পাশাপাশি ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে অজ্ঞাত থেকে যেত।
বিনোদনের অভাব, lack of entertainment
জীবনে বেঁচে থাকার জন্য শুধু যে খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান প্রয়োজন তাই নয়, বরং এসবের সাথে মানুষের একান্ত প্রয়োজন হল বিনোদন। বিনোদন ছাড়া জীবন যেন একঘেয়ে হয়ে ওঠে, ফলে আনন্দহীনতায় ভোগেন অনেকে।
লকডাউন মানুষের জীবন থেকে সামাজিক বিনোদনের উপায়টুকুও কেড়ে নিয়েছিল। তবে এমন সময় সহায়ক হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করে ভার্চুয়াল বিনোদন প্রক্রিয়াগুলো। কিন্তু সামাজিকভাবে বিভিন্ন প্রকার বিনোদনের কত যে মাহাত্ম্য তা এই লকডাউনের ফলে মানুষ প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেছিল।
পারিবারিক কলহ এবং হিংসার সৃষ্টি, Creating family strife and violence
ঘরবন্দী একঘেয়ে জীবনে মানুষের মনের উপর চেপে বসে মানসিক অবসাদ, যার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ক্রমাগত বেড়ে ওঠে পারিবারিক কলহ এবং হিংসা। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষের ফলে যে পারিবারিক অশান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি হচ্ছিল তা মানুষের মনকে যেন আরো বেশি করে অবসাদের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তবে পারিবারিক হিংসা এবং অশান্তির কথা লকডাউনের প্রারম্ভে যে মাত্রায় কল্পনা করা হয়েছিল, বাস্তবে ততখানি মাত্রায় সমস্যা দেখা যায়নি।
লকডাউনে অবসাদ দূরীকরণের উপায়, Ways to relieve boredom in lockdown
লকডাউনের প্রাথমিক পর্যায়ে মানসিক অবসাদে ভুগলেও কিছু সময় পর এই সমস্যা দূরীকরণের বিভিন্ন পথ বের করে নেওয়া হয়েছিল। এক্ষেত্রে সামাজিক মাধ্যম বিশাল ভূমিকা পালন করে। মানুষ নিজের পছন্দমত কাজ, যেমন ছবি আঁকা, গান গাওয়া, নাচ, অভিনয় করা, সাজগোজের সম্পর্কিত বিভিন্ন কিছু সহ রান্নার ভিডিও তৈরির মাধ্যমে মানুষ সময় কাটানোর এবং নিজের বিনোদনের পথ খুঁজে নেয়। এভাবেই কবে লকডাউনের এতগুলো মাস কেটে যায় তা গুনতে পারেনি কেউ।
এক কথায় বহু মানুষের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পায় লকডাউনের সময়। তবে অনেকেই মোবাইলের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে এই করোনার সময়কালে। বিনোদনের অভাবে সবাই অনলাইন বিভিন্ন মাধ্যমে ভিডিও দেখা বা সিনেমা দেখার কাজ করতে করতে এইসব কবে যেন এক অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়, যার ফলে বাড়ির মানুষের সাথেও ভালোভাবে কথা বলতে সময় পায়নি মানুষ।
কিন্তু অনেকে আবার মোবাইল ছেড়ে বাড়ির সবার সাথে ভালো সময় কাটিয়েছেন, তাদের সাথে বসে পুরোনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন, বিভিন্ন খেলা যেমন : লুডো, দাবা ইত্যাদি খেলে সময় কাটায়। এভাবে পারিবারিক সম্পর্কগুলোর মধ্যে আন্তরিকতা বাড়ে। এক কথায় লকডাউন মানুষের জীবনে খারাপ প্রভাব এবং ভালো প্রভাব দুটোই নিয়ে আসে নিজের সাথে। তবে মানুষ যেন সর্বদা ভালো কেই প্রাধান্য দেয় সেই আশা করাই ভালো।
উপসংহার, Conclusion
করোনা মহামারীর অন্ধকার পৃথিবীর বুকে চেপে বসেছিল, তার আবহ লকডাউনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে কেটে গেছে। বিশ্বব্যাপি সমস্ত দেশেই লকডাউন উঠে গিয়ে মানুষ নিজের পুরানো স্বাভাবিক জীবনে নতুন করে আবার ফিরে এসেছে। ভবিষ্যতে আবার কখনো যদি লকডাউনের পরিস্থিতি আসে তবে মানুষের হয়তো পূর্বের মত সমস্যা হবে না। এই আশা নিয়েই সভ্যতা পা রাখুক ভবিষ্যতের পৃথিবীতে। সুস্থ থাকুক সবাই মিলে এটাই কামনা।