জাতীয় সংহতির গুরুত্ব pdf, Importance of National Integration in Bengali PDF

জাতীয় সংহতির গুরুত্ব pdf

কোনো দেশের একটি জাতির উন্নতির মূল ভিত্তি হল জাতীয় সংহতি। একটি দেশের প্রত্যেকটি মানুষ যদি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দলমত নির্বিশেষে এক মন্ত্রে দীক্ষিত হয়, সহস্র কোটি মন যদি একসূত্রে গ্রথিত হয়, তবেই দেখা দেবে জাতীয় সংহতি। কিন্তু বর্তমান সময়ে অনেকেই এই জাতীয় সংহতির গুরুত্ব বুঝতে পারেন না। তাছাড়া বেশ কিছু বাধা রয়েছে এই সংহতির গুরুত্ব উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে। 

জাতীয় সংহতির স্বরূপ, what is meant by national integration 

জাতীয় সংহতি হল দেশের জনগণের আন্তরিক ঐক্যচেতনা বা ঐক্যানুভূতি। “নানা ভাষা, নানা মত ও নানা পরিধান” এইসব বাধা থাকা সত্ত্বেও দেশে মিলনের ও ঐক্যবোধের চেতনার বিকাশ দেখা যায়, যার ফলে গড়ে ওঠে জাতীয় সংহতি। একটি দেশে বসবাসকারী জাতির সব মানুষ যখন ভৌগোলিক সীমা, জাতিভেদের সীমা, সাম্প্রদায়িকতার সীমা, অর্থসংগতির সীমা, নানা বিশ্বাস ও সংস্কারকে উপেক্ষা করে সম্মিলিতভাবে নিজেদের মধ্যে ঐক্যবোধ ও চেতনা জাগিয়ে তোলে, তখনই সহস্র জীবন একসূত্রে গ্রথিত হয়ে জাতীয় সংহতি গড়ে ওঠে।

"নানা ভাষা, নানা মত ও নানা পরিধান"

জাতীয় সংহতির পথে বাধা, Obstacles to national integration

সৃষ্টির আদি যুগ থেকেই মানুষ দলবদ্ধভাবে বাস করে এসেছে। দলবদ্ধভাবে বাস করার প্রবণতা সকল মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত। কিন্তু মানবসভ্যতার বিবর্তন তথা সমাজবিকাশের ইতিহাস আলোচনা করলে উপলব্ধি করা যায় যে, এর সবটা পারস্পরিক হৃদ্যতার উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। মানবসভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাসে, মানুষের সঙ্গে মানুষের, এক সমাজের সঙ্গে অন্য সমাজের, কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে অন্য একটি রাষ্ট্রের যুদ্ধের ঘটনা দেখা যায়।

তাই বলা যায় যে সমাজে বসবাসকারী মানুষেরা পরস্পরবিরোধী প্রবণতার উপর প্রতিষ্ঠিত। আবার বিভিন্ন সমাজের ক্ষেত্রে পারস্পরিক দ্বন্দ্বও বর্তমান, অন্যদিকে একই সমাজে বসবাসকারী বিভিন্ন মানুষের মধ্যেও দ্বন্দ্ব লেগে থাকে। এসব কারণে জাতীয় সংহতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাতীয় সংহতির পথের মূল বাধাগুলো হল :

(১) ধর্মীয় আবেগ ও সাম্প্রদায়িকতা :

ধর্মের প্রতি গোঁড়া মনোভাব এবং অন্ধ বিশ্বাস এই ধরনের অসংহতির জন্য দায়ী। স্বাধীনতার দীর্ঘদিন পরে, আজও দেশে জনগণ ধর্মের দোহাই দিয়ে অনেক অবাঞ্ছনীয় কাজে লিপ্ত হয়।

ধর্মীয় আবেগ ও সাম্প্রদায়িকতা

(২) জাতিভেদপ্রথা, অস্পৃশ্যতা ও বর্ণবৈষম্য :

বর্ণ ভেদের প্রথা রাষ্ট্রের বিভিন্ন নাগরিকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। কিছু ধর্মের ক্ষেত্রে বর্ণভেদ প্রথা দেখা যায়, কোনো বিশেষ বর্ণের লোকের সামাজিক অনুষ্ঠানে অন্য কোনো বর্ণের লোকের প্রবেশ নিষেধ। এই ধরনের সামাজিক প্রথা বিভেদমূলক মনোভাব গড়ে তুলতে পারে পরস্পরের মধ্যে।

(৩) বহু ভাষা এবং ভাষাগুলির প্রতি অবহেলা :

ভাষা সংহতির ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। এক অঞ্চলের মানুষ অন্য অঞ্চলের মানুষের ভাষা বোঝে না, এর ফলে ভাবের আদান-প্রদান সঠিকভাবে হয় না। তাই পরস্পরের মধ্যে ঐক্য স্থাপিত হয় না। 

(৪) সংকীর্ণ প্রাদেশিকতা এবং উপদলীয় কোন্দল :

যথাযথ নেতৃত্বের অভাব থাকার ফলে একটি দেশ বিভিন্ন প্রতিবেশী রাজ্যের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব প্রকাশ করতে অক্ষম, আর এই ধরনের সংকীর্ণ মনোভাব থাকার ফলে একটি দেশের ওপর দেশের সাথে বিরোধ দেখা দিচ্ছে এবং এই বিরোধেই সাধারণ নাগরিকগণও হিংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত হচ্ছে। এইরূপ উগ্র প্রাদেশিকতা জাতীয় সংহতির পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া উপদলীয় কোন্দল এসবের ক্ষেত্রে সমস্যা বাড়িয়ে তুলছে।

(৫) রাজনৈতিক দলাদলি ও উগ্র জাতীয়তাবাদ :

রাজনৈতিক দলাদলি দেশের জনগণের মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি করে। এর কারণেই পারস্পরিক বিবাদের সৃষ্টি হয়। তাছাড়া দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদের সমস্যা থাকলে জনগণের মধ্যে সমস্যা কম হয় না বরং বাড়তে থাকে।

রাজনৈতিক দলাদলি ও উগ্র জাতীয়তাবাদ

(৬) জনসংখ্যা বৃদ্ধি :

জনসংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধি দেশে সংহতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে বিশেষ সমস্যা সৃষ্টি করে। দেশে জনসংখ্যা বাড়তে থাকলে বাসস্থানের অভাব, খাদ্যের অভাব, বেকারত্ব সবকিছুই বাড়তে থাকে ফলে বিভিন্ন ভাবে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়।

(৭) অর্থনৈতিক অসাম্য :

অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাবে তথা জাতীয় আয়ের বণ্টন, বেকারত্বের সমস্যা, এই সব কিছু ভারতের বর্তমান যুবক সম্প্রদায়ের মধ্যে মানসিক অসন্তোষের সৃষ্টি করেছে। বেকার যুবকদের মানসিক ক্ষোভ ভয়াবহ আকারে তাদের আচরণের মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে। তাই এটিও অসংহতির একটা প্রধান কারণ।

 (৮) দেশের বৃহৎ সংখ্যক মানুষের নিরক্ষরতা :

উপযুক্ত শিক্ষার অভাব, দেশের বৃহৎ সংখ্যক মানুষের নিরক্ষরতা জাতীয় সংহতি স্থাপনের পথে বাধা সৃষ্টি করে। দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত আছে, তার মাধ্যমে যথার্থ নাগরিকতার শিক্ষা পাচ্ছে না দেশের জনগন, ফলে শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যেও সুস্থ নাগরিক জীবনের যেসব বৈশিষ্ট্য থাকার দরকার তা দেখা যাচ্ছে না।

এসব ছাড়াও আরো বেশ কিছু ব্যাপার আছে যা আমাদের জাতীয় সংহতির ক্ষেত্রে বাধা দেয়। যেমন হতাশাগ্রস্ত বৃহত্তর জনসমাজ, বেকারত্ব, ক্ষমতাস্পৃহা এবং বিদেশি শক্তির সহায়তা প্রভৃতিও আমাদের দেশে জাতীয় অনৈক্যের কারণ হিসেবে অন্যতম।

জাতীয় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, importance of national education 

আবহমানকাল ধরে ভারতীয় সমাজ বিভিন্নতার মধ্যেও ঐক্য বজায় রেখেছে। আমাদের দেশের মানুষ কোনোদিনও নির্দিষ্ট একটি ভাষায় কথা বলেনি, কোনোদিনও নির্দিষ্ট একটি ধর্ম অনুসরণ করেনি, এমনকি ইতিহাস ঘটলেও দেখা যায় যে দেশের উপর কখনো নির্দিষ্ট একজন রাজা রাজত্ব করেননি, তা সত্ত্বেও যুগ যুগ ধরে আমাদের দেশের জনগণের মধ্যে মানসিক প্রক্রিয়ার সমতা দেখা গেছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে বিভিন্ন কারণে জনগণের মধ্যে বিবাদ বিতর্ক দেখা যাচ্ছে।

জাতীয় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা

তাই জনগণের মনে জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণ ঘটানো জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। জাতীয় সংহতির সমস্যাকে স্থায়ীভাবে সমাধান করতে হলে মানসিক ও বৌদ্ধিক পর্যায়ে সমাধান করতে হবে। শুধুমাত্র প্রক্ষোতমূলক সংহতির মাধ্যমে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। দেশের জনগণের মধ্যে নিজের জাতি, জাতির ভাষা-সংস্কৃতি-ইতিহাস- ঐতিহ্য সম্পর্কে গর্ববোধের জাগরণ ঘটানো খুব জরুরী, আর এর জন্য প্রয়োজন সর্বাগ্রে সঠিক লোকশিক্ষার বিস্তার।

জনগণের মনের সংকীর্ণ প্রাদেশিকতা-আঞ্চলিকতা ও সাম্প্রদায়িকতা বোধ দূর করা যায় সার্বিক শিক্ষাপ্রসারের দ্বারা এবং এর মাধ্যমেই বৃহত্তর জাতীয় চেতনা সৃষ্টি করতে পারলে সুদৃঢ় হবে জাতীয় সংহতি। শিক্ষিত দায়িত্বশীল নাগরিকদের এ ব্যাপারে দায়িত্ব নিতে হবে। এক কথায় বলতে গেলে একটি আদর্শ জাতীয় শিক্ষা পরিকল্পনা বর্তমান পরিস্থিতির মোকাবিলা করে জাতীয় সংহতিকে মূর্ত করে তুলতে সর্বাগ্রেই দরকার।

একটি উদার জাতীয় শিক্ষানীতি গ্রহণ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঐক্যের চিন্তাধারা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চার করলে জাতীয় সংহতি স্থাপনের পথ প্রশস্ত হতে পারে। জাতির মধ্যে ঐক্য ও দেশের সংহতি বজায় রাখার বিষয়গুলো এমনভাবে পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যাতে দেশের প্রতিটি অঞ্চলের শিক্ষার্থীর মনে উদার জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে।

প্রতিটি শিক্ষককে দেশপ্রেমে ও উদার জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হতে হবে এবং সাধারণ জনগণকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথও বলেছেন, “ভারতবর্ষের চিরদিনই একমাত্র চেষ্টা দেখিতেছি, প্রভেদের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করা, নানা পথকে একই লক্ষের অভিমুখীন করিয়া দেওয়া এবং বহুর মধ্যে এককে নিঃসংশয় রূপে অন্তরতররূপে উপলব্ধি করা, বাহিরে যেয়ে সকল প্রার্থক্য প্রতীয়মান হয় তাকে নষ্ট না করিয়া তার ভিতরকার বিমূঢ় যোগকে অধিকার করা।”

নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও সমাজসেবা, Eradication of illiteracy and social service

জাতীয় সংহতির প্রধান বাধা হল দেশের জনসাধারণের অজ্ঞতা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনোভাব, ধর্মান্ধতা। এগুলি দূর করার জন্য সমাজসেবামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে, জনসাধারণের মধ্যে এসবের মাধ্যমে জাতীয় চেতনা সৃষ্টি সম্ভব হবে। প্রয়োজনে সভাসমিতির কর্মসূচি গ্রহণ করে সংহতি প্রতিষ্ঠার নানা বিষয় নিয়ে সুষ্ঠু আলোচনা করা যেতে পারে।

নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও সমাজসেবা

উপসংহার, conclusion

আমাদের দেশ বহু ভাষাভাষী, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী এবং বিচিত্র জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত।

Unity in diversity'—বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য।

দেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য যেমন অফুরন্ত, তেমনি মানুষের বৈচিত্র্যও অফুরন্ত। জাতীয় সংহতির নামে এইসব বৈচিত্র্যকে কখনও জোর করে মিটিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠার সাথে আমাদের উদ্দেশ্য থাকতে হবে, ‘Unity in diversity’—বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য।

 

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts