প্রতি বছর আমাদের দেশ তথা আরো অন্য বেশ কিছু দেশ থেকে প্রচুর পর্যটক নেপাল ভ্রমণ করতে যায়। নেপালের ভূপ্রকৃতির গল্প পড়ে সকলের মনেই একবার হলেও এই দেশটি দেখে আসার ইচ্ছে জাগে। আমার পরিচিত অনেকেই গেছেন নেপাল, কেউ চিকিৎসার জন্য আবার কেউ পরিবারের সাথে হাওয়া বদল করতে। তাদের গল্প শুনে আমারও খুব ইচ্ছে হল হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এই ছোট দেশটি দেখার। তাই ইচ্ছে অনুযায়ী ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা হল পরিবারের সাথে।
নেপাল কথায় অবস্থিত ? Where is Nepal situated?
হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত দক্ষিণ এশিয়ার একটি ছোট দেশ হল নেপাল। এই দেশটির চারদিক চীন ও ভারত দ্বারা ঘেরা রয়েছে। নেপালে জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাংস্কৃতিক ভিন্নতা রয়েছে, রাজপ্রাসাদ ও রাজকীয় ক্ষেত্রেও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের পাশাপাশি শতবর্ষের পুরনো বিভিন্ন হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে যেখানে নানা ধরনের উৎসব পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
নেপালে কেন যাবেন ? Why one should go to Nepal?
নেপাল ভ্রমণ করার পর আমি অনুভব করলাম যে এটি এমন একটি দেশ যেখানে আপনি একসাথে অনেক বিনদোন পাবেন। পুরোটা দেশ যেন প্রাণ জুড়ানো সবুজের হাতছানি দিয়ে আপনাকে মুগ্ধ করে তুলে, প্রাচীন কোন হ্রদের ধারে কিংবা জলপ্রপাতের কলকল ধ্বনির সাথে আপনার মনকে স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে দেয়।
ঐতিহাসিক বিভিন্ন মন্দির, স্বচ্ছ হ্রদ , সারি সারি সবুজ ভ্যালি , পাহাড় কিংবা তাদের রাজপ্রাসাদ সমূহ সব কিছুতেই যেন এক অনন্য মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে। যদি কেউ এ্যাডভেঞ্চার প্রিয় হয়ে থাকে তাহলে তো নেপালকে পৃথিবীর বুকে স্বর্গস্বরূপ বোধ হবে। বাঞ্জি জাম্পিং, প্যারাগ্লাইডিং, কি নেই নেপালে; আমিও খুব আনন্দ উপভোগ করেছি এসব এ্যাডভেঞ্চার করে।
নেপাল ভ্রমণ যাত্রা, My Nepal tour
পরিবারের সকলে মিলে বিমানপথে পাড়ি দিলাম নেপালের উদ্দেশ্যে। জানালার পাশের সিটে বসে মেঘের খেলা ও হিমালয়ের চূড়া মুগ্ধ করে দিয়েছিল আমায়। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডুর ত্রিভুবন বিমান বন্দরে। সেখান থেকে ট্যাক্সী করে আগে থেকে বুক করে রাখা হোটেলে পৌঁছে সবাই মিলে বিশ্রাম নিলাম।
দুপুরের মধ্যেই পৌঁছে গিয়েছিলাম আমরা, তাই বিকালে আশে পাশের বাজারে ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। সময়টা ছিল অক্টোবর মাস এবং এইসময়ে এখানকার আবহাওয়াও বেশ মনোরম ছিল। সবাই মিলে মোমো খেয়ে নিলাম তারপর আশে পাশে থাকা দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলাম। নেপালে গিয়ে শীতের কাপড় কিনে নেওয়া বাঞ্ছনীয়, কারণ এখানকার তৈরি শীতের কাপড় জামা ভ্রমণে আসা পর্যটকরা একটি হলেও কিনে নিয়ে যায়, তবে আজ প্রথম দিন বলে তেমন কিছু কেনাকাটা করা হয়নি। বাইরে থেকেই খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা হোটেলে ফিরলাম।
বাঙালি হোটেলও আছে এখানে, তাছাড়া শুধু তাদের দেশের বিশেষ খাদ্য নয় বরং ভারতের বেশ কিছু মজার খাবারও তৈরি হয় এখানে। তাই খাওয়া দাওয়া নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। আমাদের ৫ দিনের ভ্রমণ পরিকল্পনা হয়েছে, হোটেলের সাথে গাড়ি ভাড়া করা নিয়ে আলোচনা করে কি কি দেখতে হবে এবং কবে কোথায় যাবো সেটা ঠিক করে রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
ভ্রমণের শুরু থেকে শেষ, My Nepal tour from the beginning till the end
আমি অনুভব করে দেখলাম যে অনেক সকালে বেরিয়ে পড়লে একদিন বেশ কয়েকটি জায়গা দেখে নেওয়া যায়, কারণ বেশ কিছু পর্যটন স্থানের মধ্যে দূরত্ব কম। সেই মত আমরা পরিকল্পনা করে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম গাড়ি নিয়ে।
সবার আগে পোখরা ভ্রমণ, Pokhara tour
নেপালের রাজধানী কাঠামাণ্ডু হলেও পোখরা হল এদেশের পর্যটন রাজধানী। এই শহরে হ্রদ আছে, এখানকার সবুজ পরিবেশ মনে আনন্দ জোগায়, পুরোনো পোখরার মন্দিরগুলিও দর্শন করলাম। তাছাড়া চাইলে এখানেই কেনাকাটাও সেরে ফেলতে পারেন। এখানকার ছোটো তিব্বতি বাজার ঘুরে শপিং করতে বেশ মজা লাগছিল।
দেখতে গেলে কাঠমাণ্ডুর তুলনায় পোখরায় পর্যটকদের ভিড় বেশি। এখানে আছে প্যারাগ্লাইডিং করার সুযোগ, পাশাপাশি হেলিকপ্টারও চড়া যায় এখানে। তারপর চলে গেলাম নাগরাকোট। নগরকোট কাঠমাণ্ডু থেকে মাত্র ২৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, এর উচ্চতা ৭০০০ ফিট। এটি হিমালয়ের ১৩ খানা রেঞ্জের মধ্যে অষ্টম রেঞ্জ। নাগরাকোট থেকে হিমালয়ের অপূর্ব সৌন্দর্য দেখতে পেলাম। গল্পে পড়া বর্ণনা যেন সত্যি মনে হল তখন।
আবার ঘুরে দেখলাম অন্নপূর্ণ সার্কিট, লাংতাং উপত্যকা, মুসতাং উপত্যকা ইত্যাদি। পাহাড়ের মাঝে লাংতাং-এর রোডোডেনড্রনের জঙ্গল দেখে যেকোনো ব্যক্তি মুগ্ধ হয়ে যেতে বাধ্য। পাহাড়ি গ্রাম ঘুরে আশপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করলাম।
হেঁটে হেঁটে লুম্বিনি ভ্রমণ, Tour of Lumbini by walking
দ্বিতীয় দিনের ভ্রমণ স্থান গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনি। কখনো এখানে যেতে পারবো বলে হয়তো কল্পনাও করিনি। ইতিহাসে পড়া বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্মস্থান দর্শনের অনুভূতিই আলাদা। কাঠমাণ্ডু থেকে লুম্বিনির দূরত্ব ২৫০ কিলোমিটার, তাই সকাল সকল বেরিয়ে পড়লাম। বুদ্ধদেবের জন্মস্থানটিতে তাঁর মায়ের নামে মায়াদেবী মন্দির রয়েছে।
নেপাল বেড়াতে গিয়ে আর কোথাও যাই বা না যাই এখানে আসবো বলে তো আগেই ভেবে নিয়েছিলাম। বিভিন্ন জায়গায় পড়েছি যে লুম্বিনি হল ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের একটি সাইট। এখানে ২০০০ বছর আগের অনেক প্রাচীন স্তূপ এবং পূর্ববর্তী রাজবংশদের দ্বারা নির্মিত মঠ রয়েছে।
এসব জায়গা ভ্রমণ করে জানতে পারলাম যে সারা বিশ্বের মানুষ এই বৌদ্ধ বিহারে ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন, ধ্যান, যোগ অনুশীলন, বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে নানা তথ্য জানতে আসেন। আবার অনেকে আসেন শান্তি খুঁজতে যান, অন্যদিকে কেউ কেউ ট্রেকিং করতেও আসেন। সংস্কৃত ভাষায় ‘লুম্বিনি’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল ‘যা কিছু সুন্দর’, জায়গাটি ভ্রমণ করে মনে হল যে এর নাম টি যথার্থ।
জনকপুর ভ্রমণ, Janakpur tour
জনকপুর হল দেবী সীতার জন্মস্থান, এটা তো সকলেই জানি। এই স্থানেই প্রভু রাম ও মাতা সীতার বিয়ে হয়েছিল। এটি নেপালের দিঘির শহর হিসেবেও পরিচিত। এই জনকপুরে ৭০টিরও বেশি দিঘি রয়েছে। গাড়ি দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে সকল দীঘি দর্শন করলাম। এখানে গিয়ে রামায়ণ এবং তার গুরুত্ব সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম। রাম জানকী মন্দির জনকপুরের প্রধান আকর্ষণ।
কাঠমাণ্ডু ভ্রমণ, Kathmandu tour
ভ্রমণের শেষের দুই দিন কাঠমান্ডু ভ্রমণের জন্য স্থির করা ছিল। নেপালের রাজধানী এবং প্রধান শহর হল কাঠমাণ্ডু। এই শহরের প্রধান আকর্ষণ হল পশুপতিনাথের মন্দির। এছাড়াও এখানে দর্শন করলাম সোনার প্যাগোডা, হনুমান মন্দির, বোধি স্তূপ, নারায়ণহিতি প্যালেস মিউজিয়াম, কৈসর মহল, নীলকণ্ঠ মন্দির ইত্যাদি।
কাঠমাণ্ডু থেকে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত চূড়া এভারেস্ট দেখা যায়, এছাড়াও দেখলাম বাগমতি এবং বিষ্ণুমতি নদীর সঙ্গম। এসব দেখার পর নেপালে ভ্রমণের পরবর্তী ও শেষ গন্তব্য ছিল তৃতীয় ঐতিহ্যবাহী শহর হল ভক্তপুর। কাঠমাণ্ডুর পাশেই অবস্থিত এই শহর। শহরটিতে প্রধানত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বসবাস।
এই শহরে একটি প্রাচীন রাজপ্রাসাদ রয়েছে যা ইউনেস্কো হেরিটেজ সাইটের অনুমোদনপ্রাপ্ত। ২০১৫ সালের হওয়া ভূমিকম্পে ভক্তপুরের দরবার স্কোয়্যারের বেশিরভাগ মন্দিরই ভেঙে গিয়েছিল। সেই ভগ্নাবশেষ সেখানেই আছে। ফিরে এসে খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম, সবার ইচ্ছে ছিল নতুন কোনো খাবার খেয়ে দেখার, তাই ইন্দো-তিব্বতীয় সুস্বাদু খাবার খাওয়া হল সেদিন ।
শেষ কথা, To conclude
নেপালে যাওয়া আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। শীতের মাসগুলিও নেপাল ভ্রমণের জন্য একদম সঠিক সময়। তবে সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম যে মার্চ ও এপ্রিল মাসে এখানে সুন্দর ফুল দেখা যায়।
যাই হোক, ফুল দেখতে না হয় আবার আসবো। হাওয়া বদল করার জন্যও দেশটির আবহাওয়া বেশ ভালো, পরিবেশ মনোমুগ্ধকর, ফলে যেকোনো ব্যক্তি এমন পরিবেশে এসে খুব সহজেই সুস্থ হয়ে উঠবেন। শেষ দিন ফিরে যেতে মন চাইছিলো না। কিন্তু কিছু করার নেই, তবে আমি একবার হলেও ফিরে আসবো এই দেশে, আবারও উপভোগ করবো এই প্রকৃতি।