শব্দ দূষণ রচনা, Essay on noise pollution in Bengali

শব্দ দূষণ রচনা

আমাদের চারপাশের পরিবেশের অন্যতম নিয়ামকগুলো হচ্ছে বায়ু, জল ও মাটি। এই তিনটি উপাদান দূষিত হলে মানবসৃষ্ট পরিবেশও দূষিত হয়ে পড়ে, তবে এগুলোর সাথে আরেকপ্রকার দূষণও মানব জীবনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, সেটা হলো শব্দদূষণ, আর এই শব্দদূষণ সমগ্র বিশ্বের জন্য বর্তমানে একটি ভয়াবহ সমস্যায় পরিণত হয়েছে। নিঃসন্দেহে মানবজাতির বিকাশ এর জন্য দায়ী। তাই যেহেতু এই সমস্যা মানবসৃষ্ট তাই মানুষই এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে। আজকের এই প্রবন্ধে আমরা শব্দদূষণ সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য আলোচনা করবো।

শব্দদূষণ কী, What is noise pollution?

শব্দদূষণ হল মানবসৃষ্ট উচ্চ শব্দ, যা মানুষেরই স্বাস্থ্যের জন্য হানিকারক। শহরঞ্চলে শব্দদূষণের মাত্রা সর্বাধিক। শহরের আবাসিক এলাকায় শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৩৫ থেকে ৪৫ ডেসিবল আর নগরে-বন্দরে ৪৫-৫০ ডেসিবলের বেশি।এর থেকে বোঝায় যাচ্ছে যে শহরে শব্দদূষণের পরিণাম অবশ্যই ভয়াবহ।

সাধারণত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবল হয়ে গেলে মানুষ ঘুমাতে পারে না। শব্দ ৮৫ ডেসিবলে পৌঁছে গেলে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতে শুরু করে এবং এই শব্দের মাত্রা যখন ১২০ ডেসিবল হয়ে যায় তখন কানে ব্যথা শুরু হয়। তিন বছরের কম বয়সী শিশু যদি কাছাকাছি দূরত্ব থেকে ১০০ ডেসিবল মাত্রার শব্দ শোনতে পায় তবে শিশুটি শ্রবণক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। আমরা সকলেই জানি যে শব্দদূষণের একক হল হার্টজ। কোনো শব্দ যদি ১৫ থেকে ২০ কিলোহার্টজ  সীমা অতিক্রম করে, তখনই শব্দদূষণ ঘটে। কবির ভাষায় বলতে গেলে, 

“নীরব ঘাতক শব্দ দূষণ
করছে রিক্ত নিচ্ছে ভূষণ
পরিবর্তিত হচ্ছে জলবায়ু
ঘাতক নিচ্ছে কেড়ে আয়ু।”

শব্দদূষণ কী

শব্দদূষণের সৃষ্টির কারণ, Causes of noise pollution

হিরন্ময় নীরবতা বা নিস্তব্ধতা বলে আজ যেন আর কিছুই নেই। প্রতিমুহূর্তে কর্ণযন্ত্রের উপর, মস্তিষ্কের উপর চারিদিকে উৎকট শব্দ আঘাত হানছে। প্রাকৃতিক শব্দ বৈচিত্রের সৌন্দর্য ধ্বংস করে যন্ত্রের উৎকট আওয়াজ মানুষের সূক্ষ্ম চিন্তাভাবনার সূত্রকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। সমগ্র জগত জুড়ে শব্দই ব্রহ্ম। কিন্তু প্রযুক্তির লীলায় সেই শব্দ ব্রহ্ম হয়েছে মানুষের কাছে মর্মদহ পীড়ার কারণ। শব্দদূষণের বহু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় সকল কারণই মানবসৃষ্ট, কিছু কারণ প্রকৃতিকভাবে সৃষ্ট। জেনে নিন কি কি কারণে শব্দ দূষণের সৃষ্টি হয় :-

  • বিমান, হেলিকপ্টার, রেলগাড়ি, মোটরগাড়ি, ট্রাক, বাস ও মোটরসাইকেল সবই মাত্রাতিরিক্ত উচ্চ শব্দ সৃষ্টি করে।
  • যানবাহনে ব্যবহৃত হাইড্রোলিক ভেঁপু। 
  • মাইক্রোফোন, বিভিন্ন শ্রুতিবাদন যন্ত্র, সিডি, ক্যাসেট প্লেয়ার, বেতার, টেলিভিশন, লাউড স্পিকার, টেলিফোন, মোবাইল ফোন, কলিংবেল।
  • কলকারখানার ইঞ্জিনের শব্দ, মাইকিং ও বাজি-পটকার আওয়াজ।
  • ফায়ার সার্ভিস, এম্বুলেন্স বা যুদ্ধের সময় যে সাইরেন বাজানো হয় তাও শব্দ দূষণ ঘটায়।
  • গোলাবারুদ, বোমা বিস্ফোরণ, গ্রেনেড বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজে শব্দ দূষণ হয়। 
  • রাজনৈতিক সভা, সমাবেশ, মিছিল, মিটিং, হাট বাজার সহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অনেক মানুষের সমাগম হলে সেখানে শব্দ দূষণ ঘটে।
শব্দদূষণের সৃষ্টির কারণ

এই ধরনের শব্দ রীতিমতো শব্দদূষণ ঘটায়। এ ছাড়া উচ্চ শব্দে কথা বলা, গান করা, লোকজনের চিৎকার-চেঁচামেচিতেও শব্দদূষণ ঘটে

শব্দদূষণের ফলাফল, Effects of noise pollution

 শব্দদূষণ স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। এটি বিভিন্নভাবে আমাদের স্বাস্থের উপর প্রভাব ফেলছে। কিন্তু অনেকেই এ বিষয় নিয়ে চিন্তা করেন না, কারণ অনেকে জানেন না যে শব্দদূষণের ফলে  আমদের কি কি ক্ষতি হয়, তাই জেনে রাখা ভালো যে শব্দ দূষণের ফলস্বরূপ আমাদের নিম্নে উল্লেখিত সমস্যাগুলো হতে পারে :-

  • মস্তিষ্কের ক্ষতি, 
  • বধিরতা, 
  • হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়াবন্ধ, 
  • উচ্চ রক্তচাপ, 
  • উচ্চ হৃৎস্পন্দন, 
  • মাথা ব্যথা, 
  • ঘুমের ব্যাঘাত, 
  • মানসিক ভারসাম্য বিনষ্ট, 
  • মেজাজ খিটখিটে হয় ও লেখাপড়ায় অমনোযোগিতা 
  • শব্দ দূষণযুক্ত এলাকায় বসবাস করলে শিশুদের দৈহিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।
উচ্চ রক্তচাপ

শব্দ দূষণের ফলে উপরিউক্ত বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া শব্দ দূষণের ফলে স্নায়ুযন্ত্রের উপরও চাপ সৃষ্টি হয় যা পরবর্তীতে দেহের বিভিন্ন অঙ্গ এবং বিভিন্ন গ্রন্থির উপর প্রভাব ফেলে। তবে শব্দ দূষণ শুধু মানব সমাজের উপরই যে খারাপ প্রভাব ফেলে তা না, বরং অন্যান্য প্রাণীদের জন্যও এটি মারাত্মক ক্ষতিকর। বন্য পরিবেশে শব্দ দূষণ পশুদের শিকারের ক্ষেত্রে অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাছাড়া এই প্রকার দূষণ পাখিদের প্রজননের ব্যাপারেও অসুবিধা সৃষ্টি করে।

পাখি ও অন্য প্রাণীর প্রজননে বাধা পড়লে তাদের নতুন প্রজন্ম পৃথিবীতে আসে না। সেজন্য পরিবেশের বাস্তুরীতির ভারসাম্য বিঘ্নিত হয় এবং তার প্রভাব মানুষের মধ্যেও পড়ে। তাই আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, “আওয়াজ কম রাখুন নয়তো আওয়াজ আপনাকে চেপে রাখবে। আমাদের কান সংরক্ষণ করুন।”

শব্দদূষণ প্রতিকারের উপায়গুলো কি কি, What are the remedies for noise pollution?

শব্দদূষণ মানবসৃষ্ট সমস্যা। বাড়িতে থাকি, কিংবা অফিসে, নতুবা রাস্তায়, বিভিন্নভাবে আমরা শব্দ দূষণের শিকার হই। তাই শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিকার করতে হলে জনগণের ব্যক্তিগত সচেতনতা ও সম্মিলিত প্রয়াসের প্রয়োজন। যেমন—

  • হাইড্রোলিক হর্ন এড়িয়ে চলুন, অপ্রয়োজনে গাড়ির হর্ন না বাজানো, আর বাজালে যাতে উচ্চ মাত্রায় শব্দ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা। 
  • সিডি, টিভি, রেডিও, মাইক চালানোর সময় শব্দ সহনীয় পর্যায়ে রাখা, 
  • জোরে কথা বলা ও চিৎকার-চেঁচামেচি থেকে বিরত থাকা। 
  • কলিংবেল, টেলিফোন বা মোবাইল ফোনের আওয়াজের মাত্রা কমিয়ে রাখতে হবে। 
  • সামাজিক অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে গান বা যন্ত্র বাজানো থেকে বিরত থাকুন।
  • নির্মাণ কাজে বিভিন্ন মেশিনের শব্দের সীমা বজায় রাখুন, যন্ত্র বা গাড়িতে উন্নত প্রযুক্তির ইঞ্জিন এবং সাইলেন্সার ব্যবহার করা উচিত, যাতে শব্দ সহনশীল থাকে।
  • শব্দ সৃষ্টি হয় এমন পটকা ফাটানো বন্ধ করা।

এসব পদক্ষেপ শব্দদূষণের প্রভাব কম করে দিতে পারে ফলে মানবজাতি এই দূষণের ফলে সৃষ্ট সমস্যা থেকে রক্ষা পাবে।

শব্দ সৃষ্টি হয় এমন পটকা ফাটানো বন্ধ করা

জনশিক্ষার মাধ্যমে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ, Control of noise pollution through public education

শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ মানুষই করতে পারবে, তবে দূষণ নিয়ন্ত্রণে সকলকে একসাথে এগিয়ে আসতে হবে, কারণ সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যেকোনো সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। তবে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে জনশিক্ষা খুব জরুরী। এর জন্য যা করতে হবে :-

(i) শব্দ দূষণের কুফল সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার গণমাধ্যমের সহায়তায় প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করতে হবে, যাতে সবাই শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসে।

(ii) বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে নিয়ম মেনে ৬৫ ডেসিবেল এর নিচে শব্দ করে মাইক বাজানো হলে সাধারণ মানুষের কানের কোনো অসুবিধা হবে না, ফলে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রিত হবে।

(iii) সামাজিক মাধ্যম, বা গণমাধ্যমের মধ্য দিয়ে  আতশবাজি পোড়ানো, পটকা ফাটানো বন্ধের ব্যাপারে মানুষজনকে সচেতন করতে পারেন, তাহলে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রিত হয়। সম্ভব হলে বাজারে শব্দযুক্ত আতশবাজি বিক্রি রোধ করতে পারেন।

(iv) স্কুটার, মোটর সাইকেল, মোটরগাড়ি ইত্যাদির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শব্দযুক্ত হর্ন ব্যবহার না করে বরং কম শব্দ হয় এমন হর্ন ব্যবহার করতে পারেন, তাছাড়া কম আওয়াজযুক্ত উন্নত মানের ইঞ্জিন ব্যবহার করলে শব্দ দূষণ কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হয়।

(v) শব্দ দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন বা সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে, তবেই হয়তো এই সমস্যা সমাধান সহজ হবে।

উপসংহার, Conclusion

শব্দ দূষণের বর্তমান মাত্রা খুবই উদ্বেগজনক। একটু সচেতন হলেই এই মানবসৃষ্ট সমস্যাটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আমাদের আচরণগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই এই শব্দ দূষণ কমানো যেতে পারে। মনে রাখতে হবে যে, “আমাদের করা অতিরিক্ত শব্দ না হোক অন্য কারো মাথা ব্যথার কারণ।” আমাদেরকে একটা কথা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে শব্দদূষণ রোধ করার মধ্য দিয়ে আমরা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন গড়ে তুলার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারি।

 

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts