পুরোনো মন্দিরের আত্মকথা রচনা pdf,  Autobiography of an old temple in Bengali

পুরোনো মন্দিরের আত্মকথা রচনা

 “পুণ্যলোভীর নাই হল ভিড় শূন্য তোমার অঙ্গনে,
জীর্ণ হে তুমি দীর্ণ দেবতালয়।
অর্ঘ্যের আলো নাই বা সাজালো
পুষ্পে প্রদীপে চন্দনে
যাত্রীরা তব বিস্মৃতপরিচয়।”

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের লেখায় বর্ণিত এই মন্দিরের মত সময়ের সাথে সাথে পুরনো হয়ে যায় অনেক কিছু, আর পুরোনো হয়ে যাওয়া সব জিনিসের মূল্য কমতে থাকে। কখনো সিনেমায় অথবা বাস্তব জীবনে তোমরা হয়তো জঙ্গলের মধ্যে বা লোকালয়ে জীর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো ভাঙ্গা মন্দির দেখে থাকবে যা দীর্ঘকালের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বছরের পর বছর ধরে একই জায়গায়। আমি এমনই এক মন্দির। আমার ভাঙ্গা অংশগুলোতে জড়িয়ে থাকা আত্মকথা আজ তোমাদের বলবো।

নিজের ধ্বংসের প্রতীক্ষা, Nijer dhhongsher protikhha

 পৃথিবীতে সম্ভবত প্রাচীনের কোনও মূল্য নেই, তা বস্তু হোক কিংবা মানুষ, সে যত প্রাচীন হয় তার কদর বোধহয় ততটাই কম হতে থাকে। যদি তাই না হতো তাহলে হয়তো আজ আমার এই দুর্দশা হতো না। আমি এই গ্রামের প্রান্তে ঘন জঙ্গলের মাঝখানে দীর্ঘ ২০০ বছর পুরোনো ভগ্নপ্রায় একটি মন্দির।

লোকচক্ষুর আড়াল হয়ে হারিয়ে যাচ্ছি আজ বহুকালের কথা, মানুষের অবহেলায় জীর্ণ ও ভগ্নপ্রায় আমার অবস্থা। আমি এমন একটি প্রাচীন দেব মন্দির যে কিনা সময়ের গর্ভে মিলিয়ে যেতে না পেরে এখনো নিজের ধ্বংসের জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছি। তবে আমার চেহারা যে চিরকাল ধরেই আজকের মত জীর্ণসার ছিল না তা বলাই বাহুল্য।

যৌবনে আমার মধ্যে ছিল অপূর্ব জৌলুস, জনমানুষের কাছেও আমার যথেষ্ট কদর ছিল। তারপর একদিন নিয়তির এমন পরিহাস যে মানুষ ক্রমে আমায় ভুলে গেল। সেই থেকেই আমি একলা এই ঘন অরন্যের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছি। আমি এই দীর্ঘ জীবনের স্মৃতিপটে নিজের আত্মকথা রচনা করে চলেছি। আজ আমার সৃষ্টি থেকে শুরু করে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার গল্প বলবো।

নিজের ধ্বংসের প্রতীক্ষা

আমার সৃষ্টির বৃত্তান্ত, The story of my creation

আমার জন্ম হয়েছিল সুদূর অতীত কালে। ভারতের বুকে তখনও সুলতানদের আগমন ঘটেনি। বাংলায় তখন চলছে গৌড় অধিপতি শশাঙ্কের শাসন। সেই সময়ে গোটা ভারত জুড়ে হিন্দু নবজাগরণের হিড়িক লেগেছে। নতুন নতুন দেব মন্দির একে একে প্রতিষ্ঠা হয়ে চলেছে। আমার জন্মের পূর্বে একদল লোক আমি এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি এই স্থানে কুয়ো তৈরির উদ্দেশ্যে মাটি খুঁড়তে শুরু করেছিল।

তখন মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে হঠাৎ একটি ধাতুর তৈরি নাম না জানা দেবী মূর্তি বেরিয়ে পড়ে। তখন আমার চারপাশে ছিল জনবসতিপূর্ণ একটি গ্রাম। সেই মূর্তি পাওয়ার পর গ্রামে শোরগোল পড়ে গেল। মহারাজ শশাঙ্ক স্বয়ং এলেন সেই মূর্তি স্থাপন করার জন্য, তিনি আমায় গড়ে তোলার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। অনতিবিলম্বে দক্ষ কারিগরদের কাজ শুরু হয়ে গেল এবং তাদের হাতে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই হল আমার সৃষ্টি। আমার অন্দরমহলে গর্ভগৃহে স্থাপিত হলো সেই ধাতুর দেবী মূর্তি।

আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন, A memorable day of my life

আমার এই দীর্ঘ জীবনের সাথে অসংখ্য স্মৃতি জড়িত। তবে অতীতের এই স্মৃতিপটে উজ্জ্বল হয়ে আছে বহু আগের একটি দিনের কথা। সেই দিন সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা ছিল। আকাশে গুরু গর্জন করে মাঝেমাঝেই কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। গ্রামবাসীরা এমন দিনেও তাদের রোজকার জীবনের বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ সেদিন সন্ধ্যায় গ্রামে ডাকাত পড়লো।

নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর একদল ভীষণ দর্শন ডাকাত তরোয়াল, বর্শা, লাঠি ইত্যাদি অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করলো। তাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে অসংখ্য নিরীহ গ্রামবাসী বেঘোরে প্রাণ দিল, আর বেশ কিছু নারী নিজের সম্মান বাঁচাতে ও কিছু গহনা রক্ষা করতে আশ্রয় নিল আমার গর্ভগৃহের পিছনের একটি ঘরে।

ডাকাতদের কেউ হয়তো তা দেখে নেয়,  তরোয়াল আর বর্শা নিয়ে ডাকাতেরা তাদের খোঁজে আমার দিকে তেড়ে এলো। কয়েকজন ডাকাত যেই না আমার ভেতর প্রবেশ করতে যাবে সেই সময় হঠাৎ করে আকাশে ভীষণভাবে গর্জনের সাথে বজ্রপাত হলো ঠিক আমার চূড়ার সামনে, আর সেই ভীষণ বজ্রপাতেই দুজন ডাকাত তৎক্ষণাৎ মারা পড়ল, সাথে আমার চূড়ার একটি অংশ চিরকালের জন্য ভেঙে পড়ল আরেক ডাকাতের উপর। এতে সে আহত হল, সেই টুকরোর নিচে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকলো সে। এই দৃশ্য দেখে ডাকাত দলের অন্যান্যরা ভয়ে পালিয়ে গেল।

আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন

সেদিন আমার মনে হয়েছিল যেন ঈশ্বর নিজের সন্তানদেরকে নিজের গৃহেই আশ্রয় দিয়ে রক্ষা করলেন। সেদিনের পর থেকে আমার নাম রাখা হল জাগ্রত দেবীর মন্দির। পূজা-অর্চনা ও মান্যতা আরো বেড়ে গেলো। দূরের গ্রাম থেকেও মানুষ আসতে শুরু করলো আমার গর্ভগৃহে থাকা দেবীর আরাধনা করার জন্য।

ইতিহাসে আমার ঐতিহ্য, My heritage in history

 দীর্ঘ সময় ধরে আমার ২০০ বছরের পুরনো জীবনে আমি চারপাশের পটচিত্র বহুবার বহুরকমভাবে বদলে যেতে দেখেছি। অপরাজেয় গৌড় অধিপতি শশাঙ্কের মৃত্যু দেখেছি আমি। ভারতের ইতিহাসে মাৎস্যন্যায় দেখেছি আমি। পাল বংশের রাজাদের সদর্প শাসনও দেখেছি। বাংলার মানুষের ওপর বর্গীদের নৃশংস আক্রমণ দেখেছি।

আরো দেখেছি নিরীহ চাষীদের উপর খাজনার লোভে নবাবের অত্যাচার। আমার চারপাশে জঙ্গল গজিয়েছে আজ বহুকাল, তখন ব্রিটিশের শাসনে জর্জরিত দেশ। তাদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা বিপ্লবীদের আশ্রয় দিয়েছি বহুবার। জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া বহু মানুষকে আমার গর্ভগৃহের পাশে আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু এই অতি পবিত্র ভূমির এত ইতিহাসের সাক্ষী হওয়া সত্বেও আজ আমি নিজেই এক জ্বলন্ত ঐতিহাসিক নিদর্শন হয়ে গিয়েছি, ব্রিটিশদের শাসনের সময়কালে আমার এই দশা, মানুষের আসা যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে ক্রমে জঙ্গলে ভরে ওঠে আমার চারপাশ। 

বর্তমানে আমার অবস্থা, My present condition

আমি যদিও নিজেকে ঐতিহাসিক নিদর্শন বলে মনে করতে পারি, কিন্তু বর্তমানে মানুষের কাছে আমার সেই রূপের কোনো কদর নেই। আমার চারপাশে একসময় যে জনবসতিপূর্ণ গ্রাম ছিল তা আজ অতীত। আজ থেকে বহু বছর পূর্বেই এখানে গজিয়েছে ঘন জঙ্গল, আমার দেয়ালের উপরও আগাছা বড় হয়েছে, ক্রমশ অনাদর ও অবহেলার এবং ভূমিকম্পে আমার ভাঙা অংশের আশেপাশের আরও বেশ কিছু অংশ অচিরেই ভেঙে পড়েছে।

বর্তমানে আমার অবস্থা

এখন আর কাছে কোথাও কোনো গ্রাম নেই, মানুষের চিহ্ন নেই।  তবে বেশ খানিকটা দূরে একটি গ্রাম আছে, সেখান থেকে মাঝে মাঝেই লোকজন আসে কাঠ কেটে নিতে, আমার বারান্দায় বসে গল্পও করে অনেক সময়। কিন্তু তাদের কেউই হয়তো আমার ইতিহাস সম্পর্কে জানে না। তাদের কাছে আমার পরিচয় বুড়োদেবীর পোড়ো মন্দির।

আমার কাছেও এখন সচরাচর কোনো মানুষ আসেনা। যারা আসে তারা কখনো আমার গর্ভগৃহের অভ্যন্তরে কি আছে তা খোঁজ করেছি। আমার গর্ভগৃহে আজও মহারাজ শশাঙ্কের প্রতিষ্ঠা করা সেই দেবীমূর্তি রয়েছে। সুদূর অতীত কালে না জানি কোন কারিগর এই মূর্তি গড়েছিল। সেই কারিগর কালের গর্ভে হারিয়ে হারিয়ে গেলেও আমি তার অবিনশ্বর সৃষ্টি নিয়ে মহাকালের বুকে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছি।

উপসংহার, Conclusion 

দীর্ঘ অভিজ্ঞতা পেরিয়ে বর্তমান সময়ে উপস্থিত হয়ে এই ছিল আমার দীর্ঘ জীবনের উপলব্ধির কাহিনী। মানুষ বা বস্তু যত প্রাচীন হতে থাকে তার সঙ্গে ততই জড়িয়ে যেতে শুরু করে অতীতকালের নানা স্মৃতি, তৈরি হয় ইতিহাসের নানান গাঁথা। অবহেলার কারণে প্রাচীনতার স্বাক্ষর বহনকারী মানুষ কিংবা নিদর্শনগুলি দুঃখ পায় এবং আপন ইতিহাস থেকে ক্রমে দূরে সরে যেতে থাকে, ফলে কোন সমাজই সুষ্ঠুভাবে গড়ে উঠতে পারে না, আর এমন বলার কারণ ইতিহাস হল একটি সমাজের শিকড়। শিকড়হীন বৃক্ষ যেমন দাড়িয়ে থাকতে পারেনা, তেমনই সমাজের পক্ষেও ইতিহাস নামক শিকড় ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts