অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে আর বহু দুর্নীতি ও ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে প্রমত্তা পদ্মার বুকে আজ বহু- কাঙ্ক্ষিত সেতু দাঁড়িয়ে আছে। এই সেতু শুধু ইট-সিমেন্ট-স্টিল-লোহার কংক্রিটের একটি অবকাঠামো নয় এ সেতু বাংলার অহংকার, বাংলার গর্ব, দেশের সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক। পদ্মা সেতুর নির্মাণ প্রকল্প তথা ইতিহাস সম্পর্কে হয়তো অনেকেই জানেন না, তাই এই সেতু সম্পর্কিত সকল তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করলাম আজকের এই প্রতিবেদনে।
পদ্মা সেতু উদ্বোধন কে করেন ? Who inaugurated Padma Setu?
বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপর নির্মিত সেতুটি ২০২২ সালের ২৫ জুন উদ্বোধন করা হয়। এই দিন উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তিনি নিজে মাওয়া প্রান্ত দিয়ে টোল প্রদান করে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মা সেতুতে আরোহণ করেন এবং এর মাধ্যমে সেতুটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
পদ্মা সেতু ঢাকার কোথায় অবস্থিত? Where is Padma Setu located?
পদ্মা সেতুর দুই প্রান্ত বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ও শরিয়তপুরের জাজিরা পয়েন্ট এর সাথে যুক্ত, অর্থাৎ এই সেতুর মধ্য দিয়ে পদ্মা নদীর উক্ত দুই প্রান্তকে যুক্ত করেছে। তাই বলা যায় পদ্মা সেতু মুন্সিগঞ্জের ও শরিয়তপুর জেলায় অবস্থিত।
পদ্মা সেতুতে রেল চালু হয় কত তারিখে? On what date was the railway launched at Padma Setu?
পদ্মা সেতুর মাধ্যমে রেল চালু হওয়ার জন্য ওপারের বাসিন্দারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। এর কারণ হল এই রেলপথে দক্ষিণের বেশ কিছু জেলা প্রথমবারের মতো যুক্ত হবে রেল নেটওয়ার্কে। যাতায়াতের ভোগান্তির পাশাপাশি যাত্রা পথের সময়ও অনেকটা কমবে। ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরু হয়। তবে এর প্রায় ১০ মাস পর অর্থাৎ ২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল প্রথমবারের মতো সেতু অতিক্রম করে পরীক্ষামূলক ট্রেন।
পদ্মা সেতু দিয়ে ট্রেন বা রেলগাড়ি কোথায় কোথায় যাবে? Where will the train go through the Padma Setu?
পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে ট্রেন ঈশ্বরদী জংশন, পাকশী, ভেড়ামারা, মিরপুর, পোড়াদহ, কুষ্টিয়া কোর্ট, কুমারখালী, খোকসা, পাংশা, কালুখালী জংশন, রাজবাড়ী, পাঁচুরিয়া জংশন, আমিরাবাদ, ফরিদপুর, তালমা, পুকুরিয়া, ভাঙ্গা, শিবচর, পদ্মা ও মাওয়া প্রমুখ স্টেশনগুলোতে যাত্রাবিরতি করবে।
শেখ মুজিবুর রহমানের সময়কালে নির্মাণ প্রকল্প, Construction projects during the period of Sheikh Mujibur Rahman
শেখ মুজিবুর রহমান যখন রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োজিত ছিলেন তখনও একবার এই পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী জাপান থেকে আগত জরিপ বিশেষজ্ঞদের একটি দল পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) নিকট ঢাকা–ফরিদপুর সড়ক নির্মাণের জন্য একটি সম্ভাব্যতা প্রতিবেদন জমা দেয়।
সড়কটি নির্মাণের অংশ হিসেবে তারা পদ্মা নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের ঘোষণা করলেই তাঁর মৃত্যুর কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়নি।
পদ্মা সেতুর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন, Foundation stone laying of Padma Setu
১৯৯৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সরকার রাজধানী ঢাকা ও দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা-খুলনা মহাসড়কে পদ্মা নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণের জন্য ৩,৬৪৩.৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের প্রস্তাব করে। ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১৮.১০ মিটার চওড়া উক্ত সেতুটিকে দেশের সম্ভাব্য দীর্ঘতম সেতু হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল।
প্রস্তাবে ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করে ২০০৪ সালের জুনে শেষ করার কথা জানানো হয়। নির্মাণের জন্য প্রস্তাবিত টাকার ২৬৯৩.৫০ কোটি টাকা বিদেশী উৎস থেকে এবং ৭৫০ কোটি টাকা জাতীয় উৎস থেকে জোগান দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পরে ১৯৯৯ সালের মে মাসে উক্ত সেতু প্রকল্পের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই পরীক্ষা শুরু হয়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সেতুর নির্মাণ কাজ প্রথম পরিকল্পনা অনুসারে ২০১২ সালেই শুরু হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই কাজ ক্রমে পিছিয়ে পড়ে। ২০১৪ সালের ১৭ জুন পদ্মা বহুমুখী সেতুটি নির্মাণে চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকারের সেতু বিভাগ। ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর মূল পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ, Construction work of Padma Setu
পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত। দুই স্তর বিশিষ্ট ইস্পাত ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাসের এই সেতুর উপরের স্তরে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরে একটি একক রেলপথ রয়েছে।
পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় তৈরি সেতুটি ৪১টি স্প্যান নিয়ে গঠিত, প্রতিটি স্প্যান লম্বায় ১৫০.১২ মিটার (৪৯২.৫ ফুট) এবং চওড়ায় ২২.৫ মিটার (৭৪ ফুট)। সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিমি (৩.৮২ মাইল)। এটি বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু, স্প্যান সংখ্যা ও মোট দৈর্ঘ্য উভয়ের দিক থেকে গঙ্গা নদীর উপর নির্মিত দীর্ঘতম সেতু এবং ১২৮ মিটার (৪২০ ফুট) গভীরতাযুক্ত বিশ্বের গভীরতম পাইলের সেতু।
পদ্মা সেতুর গঠন, Construction of Padma Bridge
পদ্মা সেতুর উচ্চতা ৮ হাজারে ৮৪৮ মিটার, আর পদ্মা সেতুতে ব্যবহৃত সব পাইলের মোট উচ্চতা মাউন্ট এভারেস্টের চারগুণেরও বেশি। সেতুর মোট দৈর্ঘ্য হল ৬.১৫ কিলোমিটার (২০,১৮০ ফুট) এবং প্রস্থ হল ১৮.১৮ মিটার (৫৯.৬৫ ফুট)। পদ্মা সেতু নির্মাণ কার্য শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর এবং নির্মাণ কার্য শেষ হয়েছে ২০২২ সালের ২৩ জুন। এই সেতুর উদ্বোধন হয় ২০২২ সালের ২৫ জুন এবং পরের দিন অর্থাৎ ২৬ জুন থেকেই এটি চালু করে দেওয়া হয়।
সেতু প্রকল্পের ব্যয় কত? How much does the bridge project cost?
পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় নতুন করে ১ হাজার ১১৭ কোটি ৯৭ লাখ ৯০ হাজার ৫৮০ টাকা বাড়ানোর কারণে মূল সেতু প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ালো প্রায় ১৩ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা। এর আগে মূল সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১২ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা। পুরো প্রজেক্টের মোট ব্যয় ধরা হয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। পরে তা বাড়িয়ে ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা করা হয়। এর মধ্যে ২০২২ সালের মে পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় ২৮ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা। চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি পদ্মা মূল সেতু প্রকল্পের কাজ করছে।
পদ্মা বহুমুখী সেতুর অর্থনৈতিক গুরুত্ব, Economic importance of Padma multi-purpose bridge
পদ্মা বহুমুখী সেতুর মাওয়া-জাজিরা পয়েন্ট দ্বারা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সরাসরি সংযোগ তৈরি হয়। এই সেতুটি অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিল্প বিকাশে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখবে। প্রকল্পটির ফলে প্রায় ৪৪,০০০ বর্গ কি.মি. বা বাংলাদেশের মোট এলাকার ২৯% অঞ্চলজুড়ে ৩ কোটিরও অধিক জনগণ প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে।
প্রকল্পটি দেশের পরিবহন নেটওয়ার্ক এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো হিসাবে বিবেচিত। সেতুটিতে ভবিষ্যতে রেল, গ্যাস, বৈদ্যুতিক লাইন এবং ফাইবার অপটিক কেবল সম্প্রসারণের ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও এই সেতুটি নির্মানের ফলে বাংলাদেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
শেষ কথা, Conclusion
পদ্মা সেতু নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রতীক। এই সেতুর মাধ্যমে সড়ক ও রেলপথে দ্বারা দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এর ফলে এ অঞ্চলের মানুষের একদিকে দীর্ঘদিনের ভোগান্তির লাঘব হবে, অন্যদিকে অর্থনীতি হবে বেগবান।
Frequently Asked Questions :
২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়।
৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।
২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর।
২০২২ সালের ২৫ জুন।