প্লাস্টিক-পলিথিনের ব্যবহার নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। আমরা সকলেই জানি প্লাস্টিক জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর, এই বিষয়ে প্রতিনিয়ত শঙ্কা ও উদ্বেগও প্রকাশ করা হচ্ছে। কিন্তু প্লাস্টিক পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক পদার্থ হলেও এর ব্যবহার মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে। কবিতার ভাষায় বলতে গেলে,
“আকাশ মাটি পাহাড় চষে প্লাস্টিক অবশেষ
বলতে পারো মিলবে কোথায় দূষণ মুক্ত দেশ ?
জল স্থল অন্তরীক্ষে জয়ের কেতন উড়ছে
সভ্য আজ হল বর্বর প্লাস্টিকের বর্জ্যে।“
একদিকে প্লাস্টিকের ক্ষতিকর দিক নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে, অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে এর ব্যবহারও বাড়ছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, মানবজাতিকে একদিনে প্লাস্টিকের ব্যবহার থেকে মুক্ত করা যাবে না। এর জন্য নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা, আর এক্ষেত্রে সবার আগে ভাবতে হবে প্লাস্টিকের বিকল্প নিয়ে। তবে শুধু বিকল্প খুঁজে পেলেই চলবে না, বিকল্পটি হতে হবে প্লাস্টিকের মতোই সহজলভ্য, ব্যবহার উপযোগী এবং সুলভ।
আধুনিক জীবনে প্লাস্টিক এর ব্যবহার, Use of plastic in modern life
প্লাস্টিক ক্রমে মানবজাতির আধুনিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে। একটা সময় ছিল যখন বাজার থেকে জিনিসপত্র ক্রয় করে সেগুলো বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পাটের তৈরি ব্যাগ, কাগজের প্যাকেট, কাপড়ের থলি ইত্যাদি ব্যবহার করা হতো, যা ছিল পরিবেশ বান্ধব উপাদান দিয়ে তৈরি, তাই এগুলো ব্যবহার করার পর যেখানে সেখানে ফেলে দিলেও সহজেই প্রকৃতিতে মিশে যেতো। পচনশীল বর্জ্য বলে এগুলো পরিবেশের কোনো ক্ষতি করতো না।
কিন্তু বর্তমানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্লাস্টিকের তৈরি ব্যাগ বা প্যাকেট ব্যবহার করা হয়, যা মোটেও পচনশীল নয়, যা পরিবেশের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর। নিত্যদিন প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়ে চলেছে, ক্ষতিকারক জেনেও কেউ এর ব্যবহার কম করতে পারছে না।
সময়ের সাথে সাথে প্লাস্টিকের তৈরি বিভিন্ন পদার্থ আমাদের নিত্য দিনের ব্যবহারযোগ্য উপকরণে পরিণত হয়েছে। তবে এখানে শুধু ক্যারিব্যাগের কথা বলা হচ্ছে না, প্লাস্টিকের তৈরি আরো হাজার রকম জিনিস আছে যা আমরা রোজই ব্যবহার করে থাকি। যেমন টুথ ব্রাশ, সেটিও প্লাস্টিকের তৈরি; জলের বোতল প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি; মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ইত্যাদিও প্লাস্টিকের তৈরি। এমনকি আমরা যে কলম দিয়ে লেখি তাও প্লাস্টিকের তৈরি।
প্লাস্টিকের ব্যবহার এতটা বৃদ্ধির কারণ হল এটি সহজলভ্য, তাছাড়া প্লাস্টিকের তৈরি জিনিসের দামও কম হয় এবং এগুলো যথেষ্ট টেকসই হয়। তাই মানুষও নির্বিচারে প্লাস্টিকের জিনিস ব্যবহার করে চলেছে।
প্লাস্টিক ব্যবহারে সৃষ্ট দূষণ, Pollution caused by use of plastic
প্লাস্টিকের মাধ্যমে হওয়া দূষণজনিত ক্ষতি নিয়ে আশা করি কারও কোন দ্বিমত নেই। তবে প্লাস্টিক সৃষ্ট দূষণের মাধ্যমে ক্ষতি শুধু স্বাস্থ্য বা পরিবেশের নয়, বরং এই প্লাস্টিক মানুষের দৈনন্দিন জীবনধারায় নানা বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। ব্যবহার করার পর বিভিন্ন প্লাস্টিক ব্যাগ ও বোতলগুলি যেখানে সেখানে ফেলা হয়, প্লাস্টিক পচনশীল না হওয়ার ফলে মাটি দূষিত হয়ে যায়।
তাছাড়া অনেকে সমুদ্র বা জলাশয়ের তীরে প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলে দেয়, ফলে মাটির পাশাপাশি জলও দূষিত হয়। মানুষ নিত্য প্লাস্টিক ব্যবহার করছে, ফলে প্রচুর পরিমাণে বর্জ্য সৃষ্ট হচ্ছে, যা কোনো না কোনোভাবে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে। এমনকি জলাশয় তথা সমুদ্রের নীচে থাকা বৈচিত্রময় জীবজগতও মানুষের ব্যবহৃত প্লাস্টিকের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যান্য পচনশীল বর্জ্যের কারণে এমন কোনো সমস্যার সৃষ্টি হয় না, কিন্তু প্লাস্টিক পচনশীল নয় বলে বিভিন্নভাবে পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।
প্লাস্টিক পরিবেশের কি কি ক্ষতি করে, What harm does plastic do to the environment?
- প্লাস্টিক আমাদের অজান্তেই বিভিন্নভাবে পরিবেশের ক্ষতি করছে। প্লাস্টিকের ব্যবহার পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখে। জাইলিন, ইথিলিন অক্সাইড এবং বেনজিনের মতো রাসায়নিক পদার্থ থেকে প্লাস্টিক তৈরি হয়। তাছাড়া এটি নন বায়োডিগ্রেডেবল বা অপচনশীল বলে পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে চলেছে।
- ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক ক্রমে মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়, যা হাজার বছর ধরে এভাবেই পড়ে থাকে, পচে মাটির সাথে মিশে যায় না। প্লাস্টিক থেকে বিষাক্ত পদার্থ নির্গত হয়ে মাটির উর্বর শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। ফলে গাছপালা ধ্বংস হয়ে যেতে পড়ে। তাছাড়া ফসলের ফলন হ্রাস পায়।
- প্লাস্টিক বর্জ্য পচে না বলে অনেকে সেগুলো পুড়িয়ে দেয়। কিন্তু প্লাস্টিক পোড়ানোর ফলে বায়ু দূষণকারী রাসায়নিক পদার্থ ধোঁয়ার সাথে নির্গত হয়, যা মানুষ তথা অন্য প্রাণীদের জন্য ক্ষতিকারক। এই ধোঁয়ার প্রভাবে মারাত্মক রোগও হতে পারে।
- কখনো কখনো গরু বা ছাগল গৃহস্থালির বর্জ্য থেকে খাবার সংগ্রহ করে, কিন্তু সেইসব বর্জ্যের সাথে প্লাস্টিকের উপস্থিতি থাকলে গরু অনেকসময় অজান্তেই প্লাস্টিক খেয়ে ফেলে, যার ফলে তাদের পাচনের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়, এর ফলে তারা মারা যায়।
- সামুদ্রিক প্রাণীরা প্রায়শই প্লাস্টিকের ধ্বংসাবশেষকে খাবারের সঙ্গে ভুল করে খেয়ে ফেলে, যার ফলে তাদের মৃত্যু হয়।
- প্লাস্টিক যেখানে সেখানে ফেলে রাখা হয় বলে নালা নর্দমার জল নিষ্কাশন ব্যবস্থার উপর প্রভাব পড়ে, কারণ বৃষ্টির জলে ভেসে গিয়ে প্লাস্টিকের জিনিসগুলো ড্রেনে জমা হয়, যা দিনের পর দিন এভাবেই থেকে যায়, ফলে নালাগুলির জল প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়, তাই অল্প বৃষ্টিতেও রাস্তায় জল জমতে শুরু করে, আর এই নোংরা জলের কারণে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয়।
প্লাস্টিক দূষণ রোধে করণীয়, What can be done to prevent plastic pollution?
বাজারে প্লাস্টিক ব্যবহার কম করার পদক্ষেপ নিতে হবে, তবে এর জন্য আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করা জরুরি। নিঃসন্দেহে প্লাস্টিকের ব্যবহারে অনেক সুবিধা রয়েছে, কিন্তু এর ক্ষতিকর প্রভাব পরিবেশে দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সৃষ্টি করে চলেছে। তাই প্লাস্টিকের ব্যবহার যতটা সম্ভব এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কম করতে হবে, যাতে কোনোভাবেই প্লাস্টিকের কারণে দূষণের সৃষ্টি না হয়। এর জন্য করণীয় :
একটা সময় ছিল যখন সফট ড্রিঙ্কস কাঁচের বোতলে বিক্রি করা হতো। কিন্তু বর্তমানে এগুলো প্লাস্টিকের বোতলে বিক্রি করা হয় বলে, মানুষ এইসব পান করার পর বোতল যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে দেয়। এক্ষেত্রে আবার যদি প্লাস্টিকের বদলে কাঁচের বোতলের ব্যবহার বাড়িয়ে দেওয়া যায়, তবে যত্রতত্র ছড়ানো প্লাস্টিকের মাধ্যমে দূষণ রোধ করা সম্ভব হবে।
মানুষের অভ্যাসগুলোকে পরিবর্তন করা খুব কঠিন কাজ। শুধু আইন প্রয়োগ করে হয়তো প্লাস্টিক ব্যবহারের অভ্যাস থেকে মানুষকে বিরত রাখা যাবে না, বরং মানুষকে প্লাস্টিক থেকে সৃষ্ট দূষণ নিয়ে সচেতন করতে হবে। বিশ্বের বহু দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। এভাবে গণমাধ্যমের সহায়তায় মানুষকে সচেতন করার মধ্য দিয়ে প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা সহজে করা যায়। এরজন্য যা করতে হবে –
- প্রথমত, যত্রতত্র প্লাস্টিক বা পলিথিন না ফেলা নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
- দ্বিতীয়ত, অন্যান্য বর্জ্য থেকে প্লাস্টিক বর্জ্যকে আলাদা করে রাখতে হবে।
- তৃতীয়ত, আলাদা করে রাখা প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইকেলের আওতায় নিতে হবে।
- চতুর্থত, বাজারে, হাটে যথা সম্ভব প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার বর্জন করতে হবে, বরং পরিবর্তে পাটের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ বা কাগজের ঠোঙা ব্যবহার করতে পারেন।
- পঞ্চমত, বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাজার, বাস-রেল-লঞ্চ স্টেশনসহ বিভিন্ন লোক সমাগম আছে এমন স্থানে দুই রঙের আলাদা দুটি বাস্কেট স্থাপন করতে হবে। একটি শুধু প্লাস্টিক বর্জ্য এবং অপরটি সাধারণ বর্জ্য।
উপসংহার, Conclusion
নাগরিক হিসেবে প্রত্যেককে পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার প্রতি দায়িত্বশীল হতে হবে। প্লাস্টিক দূষণের অনিবার্য পরিণতি থেকে মানব সভ্যতাকে রক্ষা করতে হলে উপরোক্ত পদক্ষেপ এবং মানুষের সচেতনতা উভয়ই প্রয়োজনীয়। প্লাস্টিক ব্যবহারের কুফল সম্পর্কে যতদিন পর্যন্ত জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হচ্ছে না, ততদিন অবধি কোনো আইন তৈরি করেও লাভ হবে না। তাই মানুষের নিজেদেরকেই প্লাস্টিক দূষণ রোধে এগিয়ে আসতে হবে।