“এই দেশেতে জন্ম মোদের আমরা ভারতবাসী, স্বাধীন দেশের স্বাধীন আইন তাই তো ভালোবাসি। প্রথম আইন প্রণয়ন হল 26 শে জানুয়ারি 1950 সন, সেই থেকেই চলছে আজও প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন।”
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মজয়ন্তীর পরপরই ক্যালেন্ডারে যে দিনটাকে ঘিরে প্রত্যেক ভারতীয়র মনে দেশাত্মবোধক আবেগ জাগ্রত হয়, সেটি হল ২৬ জানুয়ারি। একটা সময় ছিল যখন ২৬ জানুয়ারিকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু পরে, তা প্রজাতন্ত্র দিবসে রূপায়িত হয়। ২৬ জানুয়ারি তারিখের অভিধা কিভাবে বদলে যায় তা হয়তো অনেকেই জানেন না। প্রতিবছর এক দিনটি আনুষ্ঠানিক ভাবে পালিত হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে।
২৬ জানুয়ারিকে স্বাধীনতা দিবস ঘোষণা, Declaration of independence day on January 26
১৯৩০ সালে ২৬ জানুয়ারিকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি তে কার্যকর করা হল দেশের সংবিধান। এই দিনটার গুরুত্ব কী? এই দিনটির নেপথ্যে কী ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে? অনেকেই হয়তো সেটা জানে না। এই বিশেষ দিনটিকে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী ‘স্বতন্ত্রতা সংকল্প দিবস’ নাম দিয়েছিলেন। ১৯২৯ সালের বর্ষশেষে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে পূর্ণ স্বরাজ আনার শপথের পরই ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারিকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
প্রজাতন্ত্র দিবস কি এবং কেন? What is Republic Day and why it is celebrated?
ভারতে সাধারণতন্ত্র দিবস বা প্রজাতন্ত্র দিবস পালিত হয় ১৯৩৫ সালের ভারত সরকার আইনের পরিবর্তে ১৯৫০ সালের ভারতীয় সংবিধান কার্যকরী হওয়ার ঘটনাকে স্মরণ করে। এটি ভারতের একটি জাতীয় দিবস। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি তারিখে ভারতীয় গণপরিষদ সংবিধান কার্যকরী হওয়ার পর ভারত একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তাই এই দিনটি গণতন্ত্র দিবস হিসেবেও পরিচিত।
ছিল স্বাধীনতা দিবস, হয়ে উঠলো প্রজাতন্ত্র দিবস, Independence Day changed to Republic Day
২৬ জানুয়ারিকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার কয়েক বছর পরে, প্রায় দুশো বছরের ব্রিটিশ শাসনের পরাধীনতা ঘুচিয়ে ভারত যখন স্বাধীনতা অর্জন করল, তখন ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্ট স্বাধীনতা দিবসের মর্যাদা পেয়ে গেল, ফলে ২৬ জানুয়ারি তারিখের অভিধাও বদলে যায়। স্বাধীনতা লাভের প্রায় আড়াই বছর পর দেশের সংবিধান তৈরি হল।
১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি কার্যকর করা হল দেশের সংবিধান। সেই সূত্র ধরেই ২৬ জানুয়ারিকে ঘোষণা করা হল প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে। ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি দিনটি ভারতে প্রথম প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পালিত হয়েছিল।
সংবিধান কার্যকরী হওয়ার ইতিহাস, History of the Constitution
১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীন হলেও তখন দেশে কোনো স্থায়ী সংবিধান ছিল না; ঔপনিবেশিক ভারত শাসন আইনে কিছু রদবদল ঘটানোর মধ্য দিয়েই দেশ শাসনের কাজ চলছিল। এরপর ১৯৪৭ খ্রিঃ ২৮শে আগস্ট ড্রাফটিং কমিটি গঠন করা হয় একটি স্থায়ী সংবিধান রচনার জন্য। উক্ত কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন ভীমরাও রামজি আম্বেদকর।
১৯৪৭ সালের ৪ঠা নভেম্বর তারিখে কমিটি একটি খসড়া সংবিধান প্রস্তুত করে এবং সেই খসড়া গণপরিষদে জমা দেয়। চূড়ান্তভাবে সংবিধান গৃহীত হওয়ার পূর্বের ২ বছর, ১১ মাস, ১৮ দিন ব্যাপী সময় ধরে গণপরিষদ উক্ত খসড়া সংবিধান নিয়ে আলোচনার করার জন্য ১৬৬ বার অধিবেশন ডেকেছিল। এই সকল অধিবেশনে জনসাধারণেরও প্রবেশের অধিকার ছিল। শেষ অবধি ১৯৪৯ সালের ২৬শে নভেম্বর স্বাধীন ভারতের সংবিধান গৃহীত হয়।
এরপর নির্ধারিত দিনে অর্থাৎ ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারি থেকে ভারতের সংবিধান কার্যকর করার পরিকল্পনা করা হয় এবং সেদিন থেকে প্রজাতান্ত্রিক ভারতবর্ষ বা রিপাবলিক অফ ইন্ডিয়া হিসেবে পরিচিত হবে বলে স্থির করা হয়। এরপরও বহু বিতর্ক হয় এবং সংবিধানে আরো বেশ কিছু সংশোধন করার পর ২৪ শে জানুয়ারি ১৯৫০ এ গণপরিষদের ৩০৮ জন সদস্য চূড়ান্ত সংবিধানের হাতে-লেখা দু’টি নথি, যেখানে একটি ছিল ইংরেজি ও অন্যটি হিন্দি, তাতে স্বাক্ষর করেন। এর ঠিক দু’দিন পর অর্থাৎ ২৬ শে জানুয়ারি সারা দেশব্যাপী সংবিধান কার্যকর হয়।
১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি তারিখেই কেন ভারতের সংবিধান গৃহীত হয় ? Why was the Constitution of India adopted on 26 January 1950?
১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি দিনটি বিশেষভাবে সংবিধানের প্রয়োগের তারিখ হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল কারণ ১৯৩০ সালের একই দিনে অবিভক্ত ভারতে “পূর্ণ স্বরাজ” দিবস পালিত হয়েছিল ।
কিভাবে মানুষ প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপন করে ?How do people celebrate Republic Day?
প্রতি বছর ২৬ শে জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পালিত হয় দেশজুড়ে। এই দিবসটি দেশব্যাপী ছুটির দিন এবং এদিন পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠান হয়, তারপর বক্তৃতার মধ্য দিয়ে দিনটির বৈশিষ্ট্য, গুরুত্ব এবং অন্তর্নিহিত নীতিগুলি সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের অবগত করেন বক্তারা। এছাড়াও এদিন বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান, কুচকাওয়াজের মাধ্যমে দেশের সংস্কৃতি, ইতিহাসের ছবি ভেসে আসে দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে। রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে কলকাতা, এক কথায় প্রজাতন্ত্র দিবস ঘিরে সেজে ওঠে দেশের সকল প্রান্ত। বলাই বাহুল্য ২৬ জানুয়ারি মানেই দেশের রাজধানীর রাজপথে কুচকাওয়াজ, বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা।
দিল্লির পাশাপাশি অন্যান্য রাজ্যেও সেই আড়ম্বর চোখে পড়ে। এদিন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত সকাল থেকেই দেশাত্মবোধক গানগুলোতে মগ্ন হয়ে থাকে। বিভিন্ন স্থানে নিজের মত করে অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়, যেখানে গান, কবিতা এবং বক্তৃতা সবকিছুর মধ্য দিয়ে দেশমাতৃকার জন্যে বলিদানের গাথা শুনতে পাওয়া যায়।
প্রজাতন্ত্র দিবসের আগের দিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে নয়াদিল্লিতে ভাষণ দেন দেশের রাষ্ট্রপতি। এছাড়াও এই বিশেষ দিনের অনুষ্ঠানে রাজধানীতে পা রাখেন বিভিন্ন বিদেশী অতিথি অভ্যাগতরা। প্রজাতন্ত্র দিবসে বিদেশের প্রধানমন্ত্রী তথা রাষ্ট্রপতি প্রমুখ আসেন প্রধান অতিথি হিসেবে।
বিদ্যালয়ে প্রজাতন্ত্র দিবস উৎযাপন, Republic day celebration in school
প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন দেশের বিভিন্ন রাজ্যের বিদ্যালয়গুলোতে ছোটো বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এদিন প্রথমে পতাকা উত্তোলন করে জাতীয় সঙ্গীত ” জনগণ মন ” পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়।
বেশ কিছু বিদ্যালয় থেকে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকরা মিলে শোভাযাত্রার আয়োজন করেন, যেখানে কেউ ভারত মাতার সাজে ভূষিত হয়, কেউ শহীদদের স্মরণে তাদের মত সাজ পোশাক পরে, কেউ বা দেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে ফুটিয়ে তোলার জন্য বিভিন্ন কৌশল করে ছাত্রদের সাজিয়ে তোলেন, আবার কোথাও দেশের সংস্কৃতির বিভিন্ন সাজপোশাকে ভিন্ন ভিন্ন ছাত্রদের সাজিয়ে যাত্রায় অংশ নেন।
তাছাড়াও বিদ্যালয়ে সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশনের আয়োজন করা হয়, সকলের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ, ছাত্রদের মধ্যে চকলেট বিতরণ ইত্যাদি কার্যকলাপ বহু বছর ধরে চলে আসছে। এদিন সকলের মনে যেন বাজতে থাকে ” ভারত আমার ভারতবর্ষ, স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো, তোমাতে আমরা লভিয়া জন্ম, ধন্য হয়েছি ধন্য গো। “
শেষ কথা, Conclusion
ভারতবর্ষ সকল ভারতবাসীর কাছেই গর্ব। এই দেশের বিবিধের মধ্যে ঐক্য যেন গণতন্ত্রের এক অন্যন্য অর্থ উপলব্ধি করিয়ে দেয়। কবি লিখেছেন,
“হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকল ধর্মের ভিড়।
একসূত্রে ভারত মাতার সকল সন্তান
বাঁধা ভাতৃত্ববোধে, গাই ঐক্যের গান।
চেতনা হৌক উন্মুক্ত, মিথ্যে ভেদাভেদ
জয় করবো সকল বাঁধা, মনে রাখব জেদ।”
আর এই ভাবনা নিয়ে ‘ নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান’ এর মাঝেও ভারতবাসী নিজের ঐক্য বজায় রেখেছে। তাইতো এটি বিশ্বের একটি অনন্য দেশ হিসেবে গণ্য। ভারতেই ঐক্যের জন্যই প্রজাতন্ত্র দিবসের মর্ম আজও অক্ষুন্ন।