বিজ্ঞানের যুগে টেলিভিশন নিঃসন্দেহে এক অনন্য আবিষ্কার। এই বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে মানুষ বিশ্বের এক প্রান্তে নিজের ঘরে বসে অন্য প্রান্তের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে পারছে। দূরদর্শনের ব্যবহার করে মানুষ একই সাথে দূর-দূরান্তের বিভিন্ন তথ্য বা ঘটনার কথা শ্রবণ ও ছবি দর্শন করতে পারে। বহুকাল ধরে জাতীয় জীবনে টেলিভিশনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া শিক্ষার প্রসার ঘটানোর ক্ষেত্রেও এই যন্ত্রের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।
দূরদর্শনের আবিষ্কার ও ব্যবহার, Discovery and use of television
দূরদর্শন হল বিজ্ঞানীদের বহু বছরের সাধনা ও গবেষণার ফল। ১৯২৫ সালে ইংল্যান্ডের বিজ্ঞানী বেয়ার্ড টেলিভিশন আবিষ্কার করেছিলেন। এই দূরদর্শন মানব সভ্যতার ইতিহাসে যুগান্তকারী আবিষ্কারের এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। প্রথমে যদিও সাদাকালো টেলিভিশন চালু হয়, যেখানে সব ছবি শুধু সাদা ও কালো এই দুই রঙেই দেখা যেত। তবে পরে চালু হয় রঙ্গিন টেলিভিশন, যেখানে ছবির সব রঙ প্রকাশ পেয়েছে।
টেলিভিশনের গুরুত্ব, importance of television
টেলিভিশনের উপযোগিতা বা গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় যে, বিভিন্ন বিষয়ে তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতা টেলিভিশনের মাধ্যমে অর্জন করা যায়। আমরা সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর খবর ও ছবি সহ দেখতে পাই দূরদর্শনে। তবে সাধারণত টেলিভিশনকে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবেই ধরা হয়, তবে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান-বিজ্ঞান, দেশ বিদেশের খবরা খবর, দেশের নানা সমস্যার সমাধান, সমাজ ও অর্থনীতির উন্নয়ন বিষয়ক, নানা প্রকার আলোচনা-সমালোচনা, প্রতিবেদন ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে অনুষ্ঠান টেলিভিশনে নিয়মিত প্রচার করা হয়।
জনগণের মধ্যে জ্ঞান বিস্তার তথা জাতি গঠনে টেলিভিশনের ভূমিকা, The role of television in spreading knowledge among people and nation building
আমাদের দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ অশিক্ষিত। অক্ষরজ্ঞান না থাকার কারণে বহু মানুষ জরুরী বিষয় জানতে পারেন না, কিন্তু টেলিভিশন শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করে থাকে, যা দেশের জাতিকে একটি স্বাক্ষর জনগোষ্ঠীতে পরিণত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, কারণ জনগন ছবি দেখে ও টিভিতে বলা জ্ঞানমূলক কথাগুলো শুনে অনেক কিছু শিখতে পারেন। বর্তমানে টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন স্তর অনুযায়ী আদর্শ পাঠ দান পদ্ধতিও চালু করা হয়েছে, তাই বলা যায় যে টেলিভিশন শিক্ষা ক্ষেত্রে এক প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
তাছাড়া শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও কল্পনা শক্তির বিকাশ সাধন করার উদ্দেশ্যে টেলিভিশনের মাধ্যমে দেশ ও জাতির সমকালীন সমস্যাবলীর উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন বিতর্ক প্রতিযোগিতার ব্যবস্থাও করা হয়। এক কথা বলতে গেলে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান আহরণের স্পৃহাকে জাগ্রত করে তোলার অন্যতম সহায়ক উপকরণ হল টেলিভিশন। একটি শিক্ষিত জাতি গঠন করার ক্ষেত্রে নানা বিষয়ে শিক্ষা দিয়ে ধীরে ধীরে দেশকে তথা বিশ্বকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে টেলিভিশনের সমকক্ষ হয়তো আর কিছু নেই।
গণশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে দূরদর্শনের ভূমিকা, Role of Doordarshan as a medium of mass education
টেলিভিশনে প্রদর্শিত অনুষ্ঠানগুলোর প্রতি সাধারণত তরুণ ও কিশোর সম্প্রদায়ই সর্বাধিক আকৃষ্ট হয়। টেলিভিশনে স্কুল- কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিভিন্ন শিক্ষা বিষয়ক অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়, অনেকেই হয়তো সেগুলো দেখে থাকবেন। সেক্ষেত্রে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা দানের সম্পূরক হিসেবেও টেলিভিশন ব্যবহৃত হতে পারে।
দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বৈচিত্রপূর্ণ বিষয় নিয়ে তথা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচয় করানো সহ দেশে ও বিদেশে বিদ্যমান নানা সমস্যা ও সমাধান করার উপায় সম্পর্কে তথ্য পূর্ণ জ্ঞান দান করতে পারে টেলিভিশন। তাছাড়া কৃষি ক্ষেত্রে সার প্রয়োগ, কৃষি পদ্ধতি ইত্যাদি সম্পর্কেই বহু অনুষ্ঠান সম্প্রচার হয়, যা কৃষকদের ক্ষেত্রে উপযোগী। বলাই বাহুল্য, দেশ বিদেশে শিক্ষার প্রসারে বহু বছর ধরে দূরদর্শনের একটি ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে। সেগুলি হল :
- (১) দূরদর্শনের মাধ্যমে বাস্তবধর্মী শিক্ষাদান করা যায় : দূরদর্শন হল এমন এক গণমাধ্যম, যেখানে বাস্তবের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়, যার মাধ্যমে জনগণকে বিভিন্ন পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন করা হয়। সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়, যা থেকে মূল্যবোধের শিক্ষাও পাওয়া যায়।
- (২) দূরদর্শন সর্বজনীন গণমাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয় : দূরদর্শন হল অনিয়ন্ত্রিত শিক্ষার এমন এক মাধ্যম যা সমাজের সব স্তরের শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত মানুষের কাছে খুব সহজভাবে গ্রহণযােগ্য। নিরক্ষর জনগণ দূরদর্শনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবি দেখে এবং সেখানে উল্লেখ করা কথাবার্তা বা আলাপ-আলােচনা শুনে বিভিন্ন বিষয়ে অবহিত হন এবং আকৃষ্ট হয়ে পড়েন, ফলে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদেরকে জ্ঞান দেওয়া সহজ হয়ে যায়।
- (৩) দূরদর্শন দর্শন ও শ্রবণ-নির্ভর মাধ্যম: আমরা সকলেই জানি যে দূরদর্শন হল দর্শন এবং শ্রবণ-নির্ভর মাধ্যম, মূলত এই কারণেই উক্ত মাধ্যম জনগণের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বলাই বাহুল্য, এটি একই সঙ্গে মানুষের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী দুটি ইন্দ্রিয়কে কার্যকরী করে তােলে। তাই শিক্ষাক্ষেত্রে তথা শিক্ষা দান করার জন্য এই মাধ্যমের গুরুত্ব অনেক বেশি।
- (৪) দ্বিমুখী শিক্ষার মাধ্যম : বর্তমান সময়ে দূরদর্শনকে শিক্ষার দ্বিমুখী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দূরদর্শনের বিভিন্ন চ্যানেলে শিক্ষামূলক বেশ কিছু অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়, এই অনুষ্ঠানগুলির সম্প্রচারকালে শিক্ষার্থীরা টেলিফোনের মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারে।
- (৫) নান্দনিক রুচি বিকাশে সহায়তা করে দূরদর্শন : জনগণের মধ্যে নান্দনিক রুচির বিকাশ ঘটায় দূরদর্শন। দূরদর্শনের বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান দেখার সময় মানুষের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সৃজনশীল রুচি গড়ে ওঠে।
- (৬) দূরদর্শন সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হয় : কোনাে দেশের সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করা তথা বিশ্বে এই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে দূরদর্শনের উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রয়েছে। যেমন : অতীত দিনের এমন বহু সিনেমা, নাটক তথা গান আছে যা দূরদর্শনের মাধ্যমে বিশেষ উপায়ে সংরক্ষণ করে, বিভিন্ন সময়ে জনগণের সমক্ষে সম্প্রচার করার ব্যবস্থা করা হয়।
- (৭) জনমত গঠনে সহায়ক : বর্তমান সময়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এস এম এস-এর মাধ্যমে দর্শকের মতামত চায় দূরদর্শন। তাই দেখতে গেলে জনমত গঠনের ক্ষেত্রেও দূরদর্শনের অত্যন্ত শক্তিশালী ও কার্যকরী ভূমিকা রয়েছে, যা অস্বীকার করা যায় না।
- (৮) দূরদর্শনের বৈচিত্র্যপূর্ণ অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়: শুধুমাত্র নাটক, গান, সিনেমা বা সংবাদ নয়, বরং দূরদর্শন শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষের কাছেই উপযােগী এমন ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে থাকে।
- (৯) বেসরকারি চ্যানেলের অনুষ্ঠান : দূরদর্শন যন্ত্রের সঙ্গে কেবল লাইন-এর সংযােগ ঘটানাের ফলে বেশ কিছু সংখ্যক বেসরকারি চ্যানেলের অনুষ্ঠানও দেখার সুযােগ পাওয়া যায়। এর ফলে সারা বিশ্বের খবর, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ইত্যাদির সঙ্গেও পরিচিত হওয়ার সুযােগ বৃদ্ধি পেয়েছে।
- (১০) সুষ্ঠু অবকাশ সময় যাপনের উপযুক্ত মাধ্যম : অবকাশ সময় যাপনের ক্ষেত্রে দূরদর্শন সুষ্ঠু এবং স্বাস্থ্যসম্মত একটি উপায়। এই দূরদর্শন আবালবৃদ্ধবনিতার কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত, ফলে অনেকেই এর বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখার মধ্য দিয়ে সময় কাটানোর পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয় জেনে নিতে সক্ষম।
- (১১) বৃত্তিকালীন শিক্ষার প্রসার ঘটায় : বৃত্তিকালীন শিক্ষার প্রসার ঘটানোর ক্ষেত্রে দূরদর্শনের ব্যবহার বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
- (১২) মানসিক বিকাশে সহায়তা করে : দূরদর্শন জনগণের মানসিক বিকাশে বিশেষভাবে সহায়তা করে। বিভিন্ন অনুষ্ঠান জনগণের বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, ফলে আমরা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সহজেই সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি।
টেলিভিশনের ব্যবহারের কিছু নেতিবাচক দিক, Some negative aspects of television usage
সবকিছুরই ভালো দিকের পাশাপাশি একটি খারাপ দিক থাকে। টেলিভিশন বিজ্ঞানের আশীর্বাদ হলেও অনেক ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক ব্যবহার অভিশাপ হিসেবেও চিহ্নিত হতে পারে। টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের প্রতি আসক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে ছেলে মেয়েরা অনেক সময় পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে পড়ে।
এছাড়াও টেলিভিশনে প্রদর্শিত কিছু কুরুচিপূর্ণ মার পিটের দৃশ্য সমাজে সন্ত্রাস ডেকে আনতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে টেলিভিশনের মধ্য দিয়ে অপসংস্কৃতির প্রসারও ঘটানো হয়। কিছু কিছু অনুষ্ঠান এমনও হয় যা যুব সমাজের নৈতিক মূল্যবোধ নষ্ট করে। এইসব দিক টেলিভিশন ব্যবহারের নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে।
পরিশেষে, Conclusion
টেলিভিশন হল একটি শক্তিশালী প্রচার মাধ্যম। এর মাধ্যমে একটি দেশের জাতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে জ্ঞান লাভ করতে পারে। তাই বলা যায় যে দেশ গঠনে তথা জনগণের মধ্যে জ্ঞানের প্রসার ঘটিয়ে শিক্ষার উন্নয়ন করার ক্ষেত্রে টেলিভিশন বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। তবে একে সঠিক ভাবে ব্যবহার না করলে দেশ বিদেশের জনগণ বিশেষত যুব সমাজের নৈতিক অধঃপতনও অনিবার্য হয়ে যেতে পারে।