হিন্দু ধর্ম মতে দেবী সরস্বতী বিদ্যার দেবী। তিনি বাকদান করেন, তাই তিনি বাগদেবী । দেবী সরস্বতী শিক্ষার আলো বিতরণ করেন, তাই তার হাতে দেখা যায় বই। ছাত্রছাত্রীদের কাছে মাতা সরস্বতী বিদ্যার দেবী। সরস্বতী পূজা যা বসন্ত পঞ্চমী নামেও পরিচিত, একটি প্রাণবন্ত এবং আনন্দের উৎসব যা সারা ভারত জুড়ে পালিত হয় বিদ্যা, সঙ্গীত, শিল্পকলা এবং জ্ঞানের দেবী সরস্বতীকে সম্মান জানাতে। সরস্বতী পুজো মানে কচিকাঁচা তথা ছাত্রছাত্রীদের মনে যেন বাড়তি আনন্দ কারণ এই পুজোর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে থাকে পড়ুয়ারা। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে এই দেবীর পূজা হয় ।
দেবী সরস্বতীর বর্ণনা, Description of Goddess Saraswati
দেবী সরস্বতী শ্বেতবর্ণা ও শ্বেতবসনা । পদ্মে এই দেবী উপবেশন করেন। হংসে অধিষ্ঠাত্রী দেবীর এক হাতে থাকে বীনা অন্য হাতে থাকে পুস্তক। সরস্বতী একদিকে যেমন ভাষা শিক্ষা দেন, অন্যদিকে অজ্ঞানতা দূর করেন । দেবীর আরাধনায় আপামর জনতার, বিশেষ করে ছাত্র-ছাত্রীদের মনের মধ্যে অজ্ঞানতা ও ক্লান্তি দূরীভূত হয়ে যায়।
আমাদের বিদ্যালয়ে সরস্বতী পুজোর তাৎপর্য, Significance of our Saraswati Puja in our school
আমাদের বিদ্যালয়ে, সরস্বতী পূজা একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে কারণ এই আরাধনা নিছক একটি পূজা নয়, এটি প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানের সাধনা এবং আমাদের জীবনে শিক্ষার গুরুত্বকে নির্দেশ করে। আমাদের বিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজার আয়োজনে শুধুমাত্র ঐতিহ্যবাহী আচার-অনুষ্ঠান এবং প্রার্থনাই অন্তর্ভুক্ত থাকে না বরং অন্যান্য কর্মকাণ্ডের আধিক্যও থাকে যা দিনটিকে প্রত্যেক বছরই স্মরণীয় করে তোলে । সরস্বতী পূজা আমাদের বিদ্যালয়ে তাই এক অত্যন্ত তাৎপর্য বহন করে কারণ এটি প্রতিটি শিক্ষার্থীদের শিক্ষার গুরুত্ব এবং জ্ঞান অর্জনের উপর জোর দিয়ে থাকে। আমরা আমাদের আজকের এই প্রবন্ধটিতে আমাদের স্কুলে সরস্বতী পূজার তাৎপর্য এবং কীভাবে আমরা এই শুভ অনুষ্ঠানটি উদযাপন করি তার একটি সংক্ষিপ্ত পরিচয় প্রদান করব।
বিদ্যালয়ে সরস্বতী পুজো কেন উদযাপন করা হয় ? Why is Saraswati Puja celebrated in school?
সরস্বতী পূজা শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়; এটি গভীর সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষাগত গুরুত্ব রাখে। সরস্বতী, এই দিনে শ্রদ্ধেয় দেবী, জ্ঞান, শিক্ষা এবং সৃজনশীলতার মূর্ত প্রতীক। সরস্বতী পূজা উদযাপন করে, আমরা জ্ঞানের সাধনার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি এবং আমাদের একাডেমিক প্রচেষ্টায় সাফল্যের জন্য আশীর্বাদ চাই।
বিদ্যালয়ে সরস্বতী পুজোর প্রস্তুতি, Preparation of Saraswati Puja in school
আমাদের বিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজা অত্যন্ত উৎসাহ ও উদ্দীপনার সাথে পালিত হয়। দেবী সরস্বতীর আরাধনা কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই আমাদের বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা পুজোর প্রস্তুতি শুরু করে দেয়। ছাত্র-ছাত্রী এবং শিক্ষকরা স্কুল প্রাঙ্গণকে রঙিন ফুল, রঙ্গোলি এবং দেবী সরস্বতীকে উৎসর্গীকৃত বিস্তৃত প্যান্ডেল দিয়ে সাজানোর জন্য একত্রিত হয়। রঙিন কাগজ ও প্লাস্টিকের শিকলি-সহ আরও বেশকিছু উপকরণ দিয়ে পুজোর কয়েকদিন আগেই দেবীর অধিষ্ঠানের স্থানটির চারপাশ সাজানোর কাজ শুরু হয়ে যায়। বসন্ত পঞ্চমীর সময়টা
শীতের শেষের দিক এবং বসন্তের শুরুর সময় বলে প্রকৃতি যেন নব সাজে সজ্জিত হয়। এই অনুকুল আবহাওয়ায় ছাত্রছাত্রীরাও আনন্দে মেতে ওঠে। দেবী মায়ের জন্য নতুন শাড়ী ও গামছা পুজোর ঘটের উপর রাখা হয়। ছাত্রীরা মিলে আগের দিন পুজোর স্থানে বিভিন্ন রং দিয়ে আলপনা এঁকে মণ্ডপের সৌন্দর্য্য বর্ধিত করে। সরস্বতী পুজোর দিন পুরো পরিবেশটি আনন্দমুখর হয়ে ওঠে কারণ আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলেই অধীর আগ্রহে শুভ দিনের আগমনের অপেক্ষায় থাকে।
আমাদের বিদ্যালয়ে সরস্বতী পুজো উদযাপন, Saraswati Puja celebration in our school
সরস্বতী পূজার দিন আমাদের বিদ্যালয়ে প্রত্যেকবারই প্রধান অতিথি পূজার শুভ উদ্বোধন করেন। তারপর প্রধান অতিথি সহ আমাদের বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের উপস্থিতিতে সরস্বতী পূজার শুভারম্ভ হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকল ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ সবাই উঠে দাঁড়িয়ে সরস্বতী বন্দনা উপস্থাপনা করেন।
সরস্বতী পূজার দিনে, স্কুল ক্যাম্পাস যেন কার্যতরূপে ক্রিয়াকলাপের একটি প্রাণবন্ত কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়। ছাত্রছাত্রীরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে এসে উৎসবের আমেজটিকে বহু অংশে বাড়িয়ে তোলে। ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে অভিভাবক- অভিভাবিকারাও অংশগ্রহণ করে থাকেন বিদ্যালয়ে এই আড়ম্বরপূর্ণ পুজো উদযাপনে। পুজোর আগের দিন বিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র- ছাত্রীরা নিরামিষ ভোজন করে এবং নিজের মনকে পবিত্র রাখে।
সরস্বতী যেহেতু বিদ্যার দেবী, তাই তাঁর কাছে বই রাখার প্রচলন বহুদিন ধরেই চলে আসছে। প্রায় প্রত্যেক স্কুলেই এখন সরস্বতী পুজোর কয়েকদিন পরেই আয়োজিত হয় বার্ষিক পরীক্ষা। আমাদের বিদ্যালয় ও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই যার যে বিষয়ে একটু বেশি দুর্বলতা রয়েছে, সে সেই বইটিই দেবীর কাছে রেখে আসে। আমার সহপাঠীর মধ্যে কেউ কেউ আবার যে পেন দিয়ে পরীক্ষা দেবে বলে মনোস্থির করেছে, সেটিও রেখে দিত দেবীর চরণে। আশা একটাই, মায়ের আশার্বাদে পরীক্ষা যেন ভাল হয়।
সরস্বতী পূজোর আচার-আচরণ, Saraswati Puja Rituals
সরস্বতী পুজোর দিনটি সাধারণত আমাদের স্কুলের পুরোহিতদের দ্বারা পরিচালিত প্রার্থনা এবং আচারের মাধ্যমে শুরু হয়, জ্ঞান এবং সাফল্যের জন্য দেবী সরস্বতীর আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। আমাদের সরস্বতী পূজা উদযাপনের একটি অন্যতম আকর্ষণ হল এই য়ে প্রত্যেক বছরই আমাদের স্কুলের কেন্দ্রীয় প্রাঙ্গণে এই ঐতিহ্যবাহী পূজা অনুষ্ঠিত হয় । ছাত্র এবং শিক্ষকরা সরস্বতীর সুন্দরভাবে সজ্জিত মূর্তির চারপাশে জড়ো হয়, শ্রদ্ধা এবং ভক্তির চিহ্ন হিসাবে ফুল, ফল এবং মিষ্টি নিবেদন করে। সব মিলিয়ে সরস্বতী দেবীর স্তোত্র এবং মন্ত্রের সুরেলা জপে ভরা একটি নির্মল এবং আধ্যাত্মিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
“নমঃভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ। বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত-বিদ্যা-স্থানেভ্য এব চ।।এস স-চন্দন পুষ্পবিল্ব পত্রাঞ্জলি সরস্বতৈ নমঃ।।”
পুরোহিত মশাইয়ের কন্ঠে উচ্চারিত এই মন্ত্রে বিদ্যালয়ের সকল পড়ুয়া ও শিক্ষক শিক্ষিকারা দেবীর উদ্দেশ্যে অঞ্জলি প্রদান করেন।তারপর সরস্বতী দেবীর প্রণাম মন্ত্র উচ্চারণ করেন সকলে, “নমো সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে। বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাংদেহি নমোহস্তুতে।।” তারপর প্রসাদ গ্রহণ ও বিতরণ করা হয় সকলের মধ্যে। স্কুল পড়ুয়া শিক্ষক-শিক্ষিকারা ও প্রসাদ বিতরণের এই শুভ কাজে একসাথে এগিয়ে আসেন। আমাদের বিদ্যালয়ে দুপুরে পূজার পর ‘খিচুড়ি’ খাওয়ানোর ব্যবস্থা থাকে, যা পূজোর দিনটিকে আমাদের জন্য আরও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে ।
সরস্বতী পুজোর পরবর্তী পর্যায়ে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, Cultural programme held after the Saraswati Puja
পূজা অনুষ্ঠানের পর আমাদের শিক্ষার্থীদের প্রতিভা প্রদর্শনের জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং নৃত্য পরিবেশনা থেকে শুরু করে কবিতা আবৃত্তি এবং শিল্প প্রদর্শনী পর্যন্ত, সরস্বতী পূজা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলভাবে নিজেদের প্রকাশ করতে এবং তাদের দক্ষতা প্রদর্শন করতে সহায়তা করে। বিদ্যালয়ের মঞ্চটি উক্ত সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্যে দিয়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে। শিক্ষার্থীরা তাদের নিজেদের শৈল্পিক এবং সৃজনশীল ক্ষমতা সর্বোত্তম রূপে প্রকাশ করে থাকে এই বিশেষ দিনটিতে।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বিজয়ীদের পুরষ্কার বিতরণ করা হয় এবং এভাবে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। এই ক্রিয়াকলাপগুলি কেবল সকলের চেতনাকেই সমৃদ্ধ করে না বরং শিক্ষার্থীদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সাংস্কৃতিক উপলব্ধির অনুভূতিও বাড়িয়ে তোলে।
আমাদের বিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজার প্রাপ্তি, Accomplishment of Saraswati Puja in our school
সরস্বতী পূজা শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়; এটি শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং ঐক্যের উদযাপন। ছাত্র, শিক্ষক এবং অভিভাবক সহ সমগ্র স্কুল সম্প্রদায় এই দিনটিকে বিশেষ করে তোলে সকলে মিলে একত্রিত হয়ে । আমাদের বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিষ্ঠা এবং আমাদের শিক্ষার্থীদের কঠোর পরিশ্রম সত্যি ই প্রশংসনীয়। সরস্বতী পূজা আধ্যাত্মিক তাৎপর্য এবং সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির দিন। এটি শুধুমাত্র জ্ঞান এবং শিক্ষার গুরুত্বকে শক্তিশালী করে না বরং ছাত্রদের মধ্যে একতা ও আত্মিক বোধ জাগিয়ে তোলে। বিদ্যালয়ের সকলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের দ্বারা যে নিষ্ঠা ও উদ্দীপনা প্রদর্শিত হয় তা সত্যিই অসাধারণ।
উপসংহার, Conclusion
সরস্বতী পূজা আমাদের বিদ্যালয়ের অন্যতম একটি লালিত ঐতিহ্য যা শিক্ষা, সৃজনশীলতা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে মূর্ত করে। পূজা উদযাপনের মাধ্যমে, আমরা কেবল দেবী সরস্বতীর আশীর্বাদই চাই না, জ্ঞান ও শিক্ষার প্রতি আমাদের অঙ্গীকারও পুনর্ব্যক্ত করি। সরস্বতী পূজা একটি অনুস্মারক হিসাবে কাজ করে যে শিক্ষা কেবল তথ্য অর্জনের জন্য নয় বরং বুদ্ধিকে লালন করা, সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করা এবং প্রজ্ঞার প্রতি শ্রদ্ধার বোধ তৈরি করা। যেহেতু আমরা বছরের পর বছর সরস্বতী পূজা উদযাপন করে থাকি, এটি আমাদের স্কুল সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্মিক বন্ধনকে দৃঢ় করে এবং আমাদের মধ্যে শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের মূল্যবোধ অধিক পরিমাণে জাগিয়ে তোলে।