সরস্বতী পূজা রচনা, Essay on Saraswati Puja in Bengali

সরস্বতী পূজা রচনা

সরস্বতী পূজা হলো বাঙালিদের তথা আপামর ভারতবাসীর প্রাণের উৎসব। বিদ্যার দেবীকে ঘিরে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। বাঙালিদের বিশ্বাস অনুযায়ী সারা বছরজুড়ে দেবী সরস্বতী আমাদের মধ্যে জ্ঞান এবং সংস্কৃতিচর্চার রসদ জুগিয়ে দেন। ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক- অভিভাবিকা ও সাধারণ মানুষ সকলেই দেবী সরস্বতীর আরাধনা করেন। দেবী সরস্বতী শুধুই বিদ্যার দেবী নন, তিনি সঙ্গীতের ও ললিতকলার দেবীও। তাইতো শিল্পী মাত্রেই মায়ের পূজা করে থাকে।

দেবীর বর্ণনা, Description of Devi Saraswati

“জয় জয় দেবী চরাচর সারে
কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে
বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে
ভগবতী ভারতী দেবী নমস্তুতে।”

পংক্তিগুলো হয়তো সবার জানা আছে। প্রতি বছর সরস্বতী পূজার দিন এই মন্ত্র উচ্চারিত হয় সকলের মুখেই। এতে রয়েছে দেবীর রূপের বর্ণনা। দেবী সরস্বতী সর্বশুক্লা। তাঁর বসন ও গায়ের রং শুভ্র। তিনি পদ্মের উপর আসীন, তবে সেই পদ্মও শ্বেত পদ্ম। তাঁর বাহন হংস, তাও শ্বেত রঙের। তাছাড়া দেবীর একটি হস্তে থাকে পুস্তক এবং অন্য হস্তে একটি বীণা থাকে।

দেবীর বর্ণনা

সরস্বতী পূজার ইতিহাস, History of Saraswati Puja

প্রাচীন হিন্দু সাহিত্যে সরস্বতী বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন, ব্রহ্মাণী (ব্রহ্মার শক্তি), ব্রাহ্মী (বিজ্ঞানের দেবী), ভারতী (ইতিহাসের দেবী), বর্ণেশ্বরী (অক্ষরের দেবী), কবিজিহ্বাগ্রবাসিনী (যিনি কবিগণের জিহ্বাগ্রে বাস করেন) ইত্যাদি নাম। আবার সরস্বতী বিদ্যাদাত্রী (যিনি বিদ্যা দান করেন), বীণাবাদিনী (যিনি বীণা বাজান), পুস্তকধারিণী (যিনি হস্তে পুস্তক ধারণ করেন), বীণাপাণি (যাঁর হাতে বীণা শোভা পায়), হংসবাহিনী (যে দেবীর বাহন রাজহংস) ও বাগ্দেবী (বাক্যের দেবী) নামেও পরিচিত। শাস্ত্রীয় নির্দেশ অনুসারে মা সরস্বতী বৈদিক যুগের পরবর্তী একজন দেবী।

প্রাচীন যুগে তান্ত্রিকরা দেবী সরস্বতীর বদলে দেবী বাগেশ্বরীর আরাধনা করতেন। ঐতিহাসিকরা মনে করেন যে দেবী সরস্বতীর বর্তমান রূপটি তুলনামূলকভাবে নতুন। তবে পুরাকালে পূজিত দেবীর রূপটি বর্তমানের তুলনায় ভিন্ন হলেও দুই রূপের মধ্যে খুব একটা তফাৎ ছিল না। বর্তমানে সরস্বতী পূজা বাঙ্গালীদের মধ্যে গৃহস্থের অন্দরমহল কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অঙ্গনে সীমাবদ্ধ। তবে কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষার সাথে যুক্ত নয় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোতেই এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

সরস্বতী পূজার ইতিহাস

এই পূজা সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে কয়েক শতাব্দী আগে পর্যন্তও বাংলার বুকে বিভিন্ন জায়গায় ধুমধাম করে মহাসমারোহে সরস্বতী পূজা হত। এই প্রসঙ্গে বর্ধমানের রাজার তত্ত্বাবধানে প্রচলিত থাকা বিখ্যাত সরস্বতী পূজার কথার উল্লেখও বিশেষভাবে করতে হয়। সমগ্র বাংলা সহ বাংলার বাইরে থেকেও এই পূজার সাথে জড়িত অনুষ্ঠান দর্শনের উদ্দেশ্যে জনসমাগম হত।

সরস্বতী পূজার সময়কালীন প্রাকৃতিক অবস্থা,  Nature during Saraswati Puja 

সরস্বতী পূজার সময় প্রাকৃতিক অবস্থা অর্থাৎ আবহাওয়া থাকে খুবই আনন্দদায়ক। এক কথায় এ সময় সাধারণত আবহাওয়া ভাল থাকে অর্থাৎ না ঠাণ্ডা না গরম। সময়টা শীতের শেষের দিক এবং বসন্তের শুরুর সময় বলে প্রকৃতি যেন নব সাজে সজ্জিত হয়। ছাত্রছাত্রীরা মন ভরে আনন্দ করেই এই পুজোর সময়।

সরস্বতী পূজার জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠান ও আনন্দ উপভোগ, Events and festivities organized for Saraswati Puja

বাগদেবী, ব্রাহ্মী, সারদা, ইলা, শতরূপা, মহাশ্বেতা, বীণাপাণি, বীণাবাদিনী, ভারতী, পৃথুধর, পদ্মাসনা, হংসারূঢ়া, হংসবাহনা, বকেশ্বরী সহ আরো অনেক নামেই দেবী ভক্তের হৃদয়ে বিরাজমান। মাঘ মাসের শুক্ল পক্ষের পঞ্চমী তিথিতে দেবী সরস্বতীর পূজা অনুষ্ঠিত হয়। সেজন্য এই পূজার তিথি শ্রীপঞ্চমী নামেও পরিচিত। শীতের শেষ ও বসন্তের প্রারম্ভে হয় দেবীর আরাধনা। এই সময়টি খুবই মনোমুগ্ধকর। দেবী সরস্বতীর পূজাকে ঘিরে ছাত্র-ছাত্রীদের মনে খুবই উৎসাহ ও উদ্দীপনা সঞ্চার হয়।

পূজা একদিনই হয় বটে কিন্তু পূজার এক- দু দিন আগে থেকে প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। পুজোর কয়েকদিন আগে কয়েকজন ছাত্ররা প্রতি শ্রেণীকক্ষে গিয়ে চাঁদা আদায় করে। এভাবে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়, কারণ এই চাঁদা রূপে সংগ্রহ করা টাকা দিয়েই পুজো সম্পন্ন হয়। বিদ্যালয়ের সকলেই পুজোর কোনো না কোনো কাজে যুক্ত থাকে। পুজোর আগের দিন ছাত্র- ছাত্রীরা নিরামিষ ভোজন করে এবং নিজের মনকে পবিত্র রাখে, বছর বছর ধরে এভাবেই হয়ে আসছে।

সরস্বতী পূজার জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠান ও আনন্দ উপভোগ

এদিন সন্ধ্যাবেলা সকল ছাত্রছাত্রী মিলে প্রদীপ বা মোমবাতি নিয়ে শোভাযাত্রার মাধ্যমে মূর্তি নিয়ে আসে পুজো মন্ডপে। পূজার দিন খুব সকালে উঠে স্নান করে নতুন অথবা পরিষ্কার ধোয়া জামা কাপড় পরে ফুল তুলে সকল ছাত্রছাত্রী তথা শিক্ষকগণ পূজা মণ্ডপে উপস্থিত হয়। সেদিন সকাল থেকে অঞ্জলি না দেওয়া পর্যন্ত সকলেই উপবাসে থাকে। সকলে শুদ্ধ মনে পূজা শেষ করে,

 “নমঃভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ। বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত-বিদ্যা-স্থানেভ্য এব চ।।এস স-চন্দন পুষ্পবিল্ব পত্রাঞ্জলি সরস্বতৈ নমঃ।।

এই মন্ত্র উচ্চারণ করে অঞ্জলি দেওয়া হয়, তারপর সরস্বতী দেবীর প্রণাম মন্ত্র উচ্চারণ করেন সকলে, “নমো সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে। বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাংদেহি নমোহস্তুতে।।” তারপর প্রসাদ গ্রহণ করে। 

সরস্বতী পূজা উপলক্ষে প্রতিমা স্থাপনের জন্য তৈরি পূজার মণ্ডপটি বিভিন্ন সামগ্রী ব্যবহার করে খুবই সুসজ্জিত করে রাখা হয়। পূজার স্থানে দেবী প্রতিমার সম্মুখে রাখা হয় বই, দোয়াত, কলম ইত্যাদি। তাছাড়া মায়ের জন্য নতুন শাড়ী ও গামছা পুজোর ঘটের উপর রাখা হয়। ছাত্রীরা মিলে আগের দিন পুজোর স্থানে বিভিন্ন রং দিয়ে আলপনা এঁকে মণ্ডপের সৌন্দর্য্য বর্ধিত করে। পুজোর সময় অনেকেই নিজেদের পাঠ্যবই দেবীর চরণে দিয়ে রাখেন।

অনেকের এই দিনে ‘হাতে খড়ি’ হয়। বিকেলের দিনে ছোটো থেকে বড় সকলেই শাড়ী পরে বিভিন্ন মন্ডপে পুজো দেখতে যায়। তাছাড়া সন্ধ্যার দিকে প্রতিটি পূজা মণ্ডপে আলোকসজ্জা দেখা যায়। সন্ধ্যা আরতির পর শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই দিনটিকে ঘিরে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে উৎসাহের অন্ত থাকে না। কোন কোন বিদ্যালয়ে অথবা বারোয়ারি পূজামণ্ডপে দুপুরে পূজার পর ‘খিচুড়ি’ খাওয়ানোর ব্যবস্থা থাকে। সন্ধ্যায় বিদ্যালয়ে বিভিন্ন নাট্যাভিনয়, আবৃত্তি ও জলসার আয়োজন থাকে।

অনুষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীরা অংশগ্রহণ করে। তাছাড়া স্কুল, কলেজ, পাঠাগার বা বাড়ির পূজায় শুধু ছাত্র-ছাত্রীরা নয়, সকলেই অংশ নেয় ও আনন্দ উপভোগ করে। পরদিন ষষ্ঠী-প্রতিমা নিরঞ্জনের দিন। এদিন বিষন্ন মনে ছাত্র-ছাত্রীরা শোভাযাত্রা করে স্থানীয় নদী অথবা পুষ্করিণীতে প্রতিমা বিসর্জন দেয়।

সরস্বতী পূজার অর্থনৈতিক গুরুত্ব, Economic importance of Saraswati Puja

অন্যান্য সব পূজার মত সরস্বতী পূজারও কিছু অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। এই পূজাকে কেন্দ্র করে প্রতিমা নির্মাণ, সাজসজ্জার ফুল, প্রসাদের জন্য চাল, ডাল, শাক, সবজি ইত্যাদি কেনাকাটা সহ পূজার বিভিন্ন সামগ্রী ক্রয় করা হয়। এরফলে অসময়ে হলেও বিভিন্ন মৃৎশিল্পীরা এই পূজার মধ্য দিয়ে জীবিকা অর্জন করে থাকেন।

তাছাড়া এই পূজার উপর ভিত্তি করেই এখনো দোয়াত  তৈরির কারিগররা কিছুটা সচ্ছলতার মুখ দেখেন। উল্লেখ্য সরস্বতী পূজায় বিপুল পরিমাণ ফুল প্রয়োজন হওয়ার কারণে ফুলের ব্যবসায়ীরাও কিছুটা লাভবান হন। তাই বলা যায় যে সরস্বতী পূজার অর্থনৈতিক গুরুত্ব যথেষ্ট রয়েছে।

সরস্বতী পূজার অর্থনৈতিক গুরুত্ব

উপসংহার, Conclusion 

সরস্বতী পূজা বিশেষত বাঙালিদের প্রধান উৎসবের একটি। এই পূজাকে কেন্দ্র করে বাঙালিদের মনে সর্বপ্রকার ভেদাভেদ ভুলে পূর্ণতার বিকাশ ঘটে। যুগ যুগ ধরে এই পূজা বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ রূপে বাঙালিদের বিশেষ পার্বণের তালিকাকে অলংকৃত করে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও এই ধারা একইভাবে অক্ষুণ্ণ থাকবে।

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts