ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দক্ষিণে উত্তর ও দক্ষিণ 24 পরগণার অংশ এবং বাংলাদেশের কিছু অংশ নিয়ে সুন্দরবন অঞ্চলটি গড়ে উঠেছে। অঞ্চলটি পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ সমভূমির অন্তর্গত। এই অঞ্চলের লবণাক্ত পরিবেশে সুন্দরী, গরান, গেওয়া, হোগলা প্রভৃতি বৃক্ষের ম্যানগ্রোভ অরণ্য রয়েছে।
কেন্দ্রীয় জল কমিশনের হিসাব অনুযায়ী ভারতের মোট ক্ষেত্রমানের ১১% অর্থাৎ ৩৭ মিলিয়ন হেক্টর বন্যা কবলিত অঞ্চলের মধ্যে সুন্দরবন অঞ্চল অন্যতম। অঞ্চলটিকে প্রায় প্রতি বছরই বন্যার সম্মুখীন হতে হয়। জলবায়ুগত সমস্যাগুলির মধ্যে এই অঞ্চলের অন্যতম সমস্যা হল বন্যা। তাই সুন্দরবন অঞ্চলের বন্যা প্রকোপ রোধ করতে সুন্দরবন বন্যা প্রকল্প কর্মসূচি রূপায়ন করা হয়েছে।
সুন্দরবন-এর নামকরণ, Why Sundarban is named so?
সুন্দরবন-এর আক্ষরিক অর্থ হল সুন্দর জঙ্গল বা সুন্দর বনভূমি। মূলত সুন্দরী গাছ থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়, কারণ এই অঞ্চলে সুন্দরী গাছ প্রচুর পরিমাণে জন্মায়। সুন্দরবন স্থানীয়ভাবে বাদা বা বাদাবন, হুলোবন, শুলোবন, মাল, মহাল ইত্যাদি নামেও পরিচিত। বাদা মানে জোয়ার-ভাটা বয়ে যায় যে বনের মধ্যে দিয়ে।
সুন্দরবনের বন্যার কারণসমূহ কি কি, What are the causes of Sundarbans floods?
সুন্দরবনের বন্যার কারণ কিছু প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট আবার কিছু মনুষ্যসৃষ্ট। সুন্দরবনের তীরবর্তী এলাকায় যে বন্যা সংঘটিত হয় সে বন্যার কারণগুলো হল : জলবায়ু পরিবর্তন, যার কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর ফলে নোনা জল কম হয়ে যাচ্ছে, তাই এই বন্যা-সহনশীল গাছগুলির জটবদ্ধ শিকড় দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।
তদুপরি, ব্রহ্মপুত্র এবং গঙ্গা অববাহিকায় বাঁধ নির্মাণ করার ফলে পলির সরবরাহ কমে গেছে, যা এই অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্রকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে। অন্যদিকে সুন্দরবন ঘেঁষে ৩২০ টি ছোটো বড় শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে, যা মূলত বাংলাদেশের অংশেই রয়েছে, এর নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় পরিবেশে কমিটি।
১৯৯৯ সালে বাংলার পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সুন্দরবনের চারপাশের ১০ কিলোমিটার এলাকাকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা বলে ঘোষণা করলেও এসব শিল্প-কারখানার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন পরিবেশবিদরা। সুন্দরবনকে ঘিরে শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠার অর্থই হচ্ছে এই অঞ্চলের ক্ষতি-সাধন। এতে পরিবেশের বিভিন্নভাবে ক্ষতি হচ্ছে। পরিবেশবিদদের মতে এসব শিল্পকারখানাই সুন্দরবনের পরিবশকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
সুন্দরবনের বন্যার ফলাফল, Effects of Sundarban flood
বন্যা সংগঠিত হওয়ার পর এর ফলাফল মানুষের জীবনে মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে। সুন্দরবনের বন্যা শুধু সেই অঞ্চলের মানুষই নয়, বরং সেখানকার উদ্ভিদ প্রাণী ইত্যাদিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুন্দরবনের বন্যার ফলে কৃষির প্রয়োজনীয় জল এবং খাদ্য ও পানীয় জলের সমস্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে জলতল বেড়ে যাওয়ার কারণে আশে পাশের নদীবাঁধ ভেঙে বন্যার আশঙ্কা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
সুন্দরবন অঞ্চলের বন্যার প্রকল্পের উৎস, Sources of flood projects in the Sundarbans region
সুন্দরবন অঞ্চলের বন্যার প্রকল্প কর্মসূচির বিভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। এরমধ্যে প্রধান উদ্দেশ্যগুলি হল-
- (i) সুন্দরবন অঞ্চলের ভূমিরূপগত অবস্থান সম্পর্কে অবগত হওয়া।
- (ii) সুন্দরবন অঞ্চলে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া বন্যার কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা।
- (iii) জলবায়ুগত বিপর্যয় সৃষ্টিতে মানুষের ভূমিকা পর্যালোচনা।
- (iv) বন্যার প্রভাব ও এর ব্যাপ্তি সম্পর্কে অবগত হওয়া।
- (v) বন্যা প্রতিরোধে সুন্দরবন অঞ্চলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার ওপর আলোকপাত।
প্রকল্প কর্মসূচি রূপায়ন পদ্ধতি, Project Program Implementation Procedures
সুন্দরবন অঞ্চলের বন্যার প্রকল্প কর্মসূচি রূপায়ন করার জন্য প্রথম দিকে একাধিক বই, জার্নাল, এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এরপর বিভিন্ন ধরনের মানচিত্র অঙ্কন করা হয় গৃহীত তথ্যের সাহায্যে। তথ্যের বিশ্লেষণ যেভাবে করা হয় :
অবস্থান :
প্রায় 25,500 বর্গকিমি স্থানজুড়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের দক্ষিণাংশে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদের মোহনায় পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ সমভূমি সুন্দরবন অঞ্চল অবস্থিত। ভারতে অন্তর্ভুক্ত সুন্দরবনের আয়তন 9629 বর্গ কিমি।
সীমা ও ক্ষেত্রমান :
সুন্দরবন অঞ্চলের দক্ষিণদিকে বঙ্গোপসাগর, উত্তরে উত্তর ও দক্ষিণ 24 পরগণা, পূর্বে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা।
জলবায়ু :
সুন্দরবন অঞ্চলটি ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত। এই অঞ্চলের গড় বার্ষিক উচ্চতা 32-36* সেলসিয়াস। অন্যদিকে সুন্দরবন অঞ্চলের বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ 160-200 সেমি।
ভূ-প্রকৃতি :
হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল মেঘালয় মালভূমি ও ছোটোনাগপুর মালভূমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি নদী বাহিত মোহনা অঞ্চলে সুন্দরবন অঞ্চল গড়ে উঠেছে। এটি মূলত নিম্ন সমভূমির অন্তর্গত এবং এর বেশিরভাগ অঞ্চলই জোয়ারের জলে পুষ্ট। অঞ্চলটির বেশিরভাগ অংশ পলি, বালি ও কাদা দ্বারা গঠিত। সুন্দরবন অঞ্চলটি একাধিক নদী, নালা প্রভৃতির সমন্বয়ে গঠিত।
নদ- নদী :
সুন্দরবন অঞ্চলের জোয়ারি নদীগুলি হল—মাতলা, বিদ্যাধরি, ঠাকুরানি, গোসাবা, রায়মঙ্গল, সপ্তমুখী, বারতলা, পিয়ারি, জামিরা, হাড়িয়াভাঙা প্রভৃতি। এই নদীগুলি হল ভাগীরথী ও হুগলি নদীর শাখানদী। এগুলোর ওপর 3,500 কিমি বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে।
স্বাভাবিক উদ্ভিদ :
সুন্দরবন চিরসবুজ ম্যানগ্রোভ অরণ্যাবৃত। এখানকার প্রধান বৃক্ষগুলি হল—সুন্দরী, গরান, গেওয়া, গোলপাতা, হোগলা প্রভৃতি। তবে বেশিরভাগ স্থান জুড়ে সুন্দরী বৃক্ষের প্রাধান্য।
ভূমির ব্যবহার :
সুন্দরবন অঞ্চল বেশিরভাগটাই ম্যানগ্রোভ অরণ্য দ্বারা আবৃত। তবে পূর্বে কম থাকলেও বর্তমান দিনে এখনকার জনসংখ্যার পরিমাণ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখানকার বেশকিছু অঞ্চলের বনভূমি ধ্বংস করে সেই অংশ কৃষিকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এর ফলে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্যের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে, যার ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে এই অঞ্চলের বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য।
বন্যা প্রতিরোধে গৃহীত ব্যবস্থা, Measures taken to prevent floods
পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য অঞ্চল সুন্দরবন বন্যার দ্বারা প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বর্তমান সময়ে বন্যা প্রতিরোধে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সেগুলি হল—
- (i) বৃক্ষরোপণ করা : নদীর পাড় ও উপকূলবর্তী অঞ্চলে ভূমিক্ষয় রোধ করার জন্য সরকারি, বেসরকারি ও গ্রাম্য উদ্যোগে সুন্দরবন অঞ্চলে বৃক্ষরোপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
- (ii) নদীবাঁধের সংস্কার : নদীবাঁধগুলি ঠিক আছে কিনা, জলের চাপে ক্ষতি হয়েছে কি না তা পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে তা মেরামত করার কাজ করা।
- (iii) নদীবক্ষ পরিষ্কার করা : যে সকল নদীতে অতিরিক্ত পলিসঞ্চয় ঘটেছে সেই নদীবক্ষগুলিকে পরিষ্কার করতে ড্রেজিং করে নদীর জলধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার চেষ্টা চলছে।
- iv) ছোটো ছোটো খাতের সৃষ্টি : বর্ষাকালে নদীগুলো অতিরিক্ত জলকে অন্যত্র যাতে বাহিত করতে পারে এর জন্য ছোটো ছোটো খাত তৈরি করা হচ্ছে। এইভাবেই নদীতে অতিরিক্ত জলের পরিমাণ কমানো সম্ভব হয়েছে।
- (v) জলাধার নির্মাণ : বর্ষাকালে নদীর অতিরিক্ত জলকে সঞ্চয় করে রাখতে অসংখ্য জলাধার নির্মাণ করা হয়েছে সুন্দরবন অঞ্চলে।
বন্যা প্রকল্পটির মূল্যায়ন, Evaluation of the flood scheme
সুন্দরবন অঞ্চলে বন্যা প্রকল্পটি রূপায়ন করার মাধ্যমে উক্ত অঞ্চলের অরণ্যের বর্তমান পরিস্থিতি, ভূমিরূপগত অবস্থা এবং বাস্তুতান্ত্রিক অবনতিকে ঠিক করার তথা উন্নত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই অঞ্চলে বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য বর্তমানে বেশ কিছু সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যা সুন্দরবনকে ভবিষ্যতে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে সাহায্য করবে।
শেষ কথা, Conclusion
সুন্দরবনকে বন্যা থেকে রক্ষা করা এই অঞ্চলের অস্তিত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে একটি জরুরী পদক্ষেপ। সুন্দরবন জাতীয় জীবনে জীববৈচিত্র্যের বাসস্থানসহ উপকূলীয় এলাকায় জীবিকার উৎস হিসাবে যে ভূমিকা পালন করছে তা বর্ণনাতীত। তাই এই বনকে রক্ষা করাও আমাদের দায়িত্ব। নিজেদের দায়িত্ব পালনে যদি আমরা ব্যর্থ হই তাহলে সুন্দরবন একাই ধ্বংস হবেনা বরং অঞ্চলের মানুষের ধ্বংসও অনিবার্য হয়ে উঠবে। তাই নিজেদের স্বার্থেই সুন্দরবন অঞ্চলকে টিকিয়ে রাখার জন্য ব্যক্তিগত ও জাতীয় পর্যায়ে কাজ করতে হবে।