বিজয় দিবস কথাটি শুনলেই হয়তো বিজয়ের প্রথম অনুভূতির সাথে জড়িত ইতিহাসের কথা মনে করে বাংলাদেশের প্রতিটি বাঙালির বুক ভরে ওঠে। দেশের বাঙালি জাতি দীর্ঘ ২৪ বছরের নাগপাশ ছিন্ন করে ভাগ্যাকাশে এক নতুন সূর্যোদয় দেখেছিল সেদিন। পরাধীনতার শেকল ভেঙ্গে বাঙালিরা সেদিন প্রথম স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করেছিল। তাইতো বিজয় দিবসের দিনটি অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। এই দিনটির ইতিহাস সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য রয়েছে, যা আজকের এই প্রতিবেদনে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
কেন বিজয় দিবস পালন করা হয়? Why is Victory Day celebrated?
বিজয় দিবস প্রতিবার ১৬ ই ডিসেম্বর তারিখে বার্ষিকভাবে পালিত হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এক ঐতিহাসিক বিজয়কে চিহ্নিত করে, যার ফলে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধ এবং শেষ ১৩ দিন স্থায়ী সংঘাতের পর পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের আত্মসমর্পণে এক নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। তাই এই তারিখ বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয়।
বিজয় দিবসের তাৎপর্য কি? Bijoy Diboser tatporjyo
বিজয় দিবস বাঙালি জাতির হাজার বছরের শৌর্যবীর্য ও বীরত্বের এক অবিস্মরণীয় গৌরবময় দিন। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল। চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশে এই বিজয় দিবস ১৯৭২ সাল থেকে প্রতিবছরই রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয়। বলাই বাহুল্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ জাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
মুক্তি পাগল বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলন, Independence movement of Bengalis who truly wanted freedom
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে যখন দেশের ঘুমন্ত নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর ট্যাংক-কামানের মতো ভয়ংকর মারণাস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানের নৃশংস হানাদার বাহিনী গণহত্যার পৈশাচিকতায় মেতে উঠেছিল, তখন থেকেই শুরু হয়েছিল প্রতিরোধ সংগ্রাম। সেই রাতেই দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে মুক্তিযুদ্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার রক্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনবে বলে মুক্তি পাগল বাংলার দামাল ছেলেরা একদিন অস্ত্র কাঁধে তুলে নেয়।
জীবনের মায়া ছেড়ে দিয়ে দেশের বীর সন্তানেরা যুদ্ধের ময়দানে ছুটে গিয়েছিলেন শত্রুর মোকাবিলায়। সেই আন্দোলনে ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার সবাই শরিক হয়। যতই দিন অতিবাহিত হতে থাকে, প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার অস্ত্র আরও শাণিত হয়। লক্ষ্য স্থির রেখে দৃঢ়তা নিয়ে শত্রু হননে এগিয়ে যায় বীর বাঙালি জাতি। ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন। প্রতিবেশী ভারতও এসে জড়িয়ে পড়েছিল বাংলার এই ভাগ্যযুদ্ধে।
ডিসেম্বরের শেষ পর্যায়ে এসে চূড়ান্ত রূপ নেয় এই যুদ্ধের। বিজয়ী হয় বাঙালি জাতি। দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটিয়ে বাঙালি জাতির জীবনে সেদিন এলো নতুন প্রভাত। ১৬ ডিসেম্বর সূর্যোদয়ের সাথে সূচিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য বিজয়।
বাঙালি জাতি এদিন অর্জন করে নিজ ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার। বহু শহীদের রক্ত আর বাংলার মা-বোনদের সম্ভ্রমের বিনিময়ে স্বাধীনতা ধরা দেয় বাঙালির জীবনে। প্রভাত সূর্যের রক্ত আভা ছড়িয়ে পড়ে বাংলাদেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। সমস্বরে একটি ধ্বনি যেন নতুন বার্তা ছড়িয়ে দেয়, জয়বাংলা বাংলার জয়। বিশ্ব কবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, বাঙালিদের বাংলাদেশ যেন খুঁজে পায় তার আপন সত্তাকে।
বাংলাদেশে বিজয় দিবস উদযাপন কিভাবে হয় ? How to celebrate Victory Day in Bangladesh?
বাংলাদেশের জনগণের কাছে বিজয় দিবস একটি বিশেষ দিন। দেশের বিভিন্ন অংশে এই দিনটি উৎযাপন করা হয়। প্রতিবছর চলচ্চিত্র, কবিতা, নিবন্ধ, গণমাধ্যম ইত্যাদিতে বিভিন্নভাবে বাংলার এই বিজয়ের বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়। এছাড়াও এই বিশেষ দিবস বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজের আয়োজন করে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসের সূচনা ঘটে।
জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে অনুষ্ঠিত সম্মিলিত সামরিক কুচকাওয়াজে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীর সদস্যরা যোগ দেন। এই বিশেষ অনুষ্ঠান দেখতে দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে মানুষ আসেন এবং অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেন। তবে শুধু জাতীয় প্যারেড স্কয়ারেই নয় বরং দেশের প্রতিটি উপজেলায় বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ, বিশেষ আলোচনা অনুষ্ঠান, মতবিনিময় সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও আয়োজিত হয়।
এছাড়াও, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা নিহত হয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের অংশ হিসেবে ঢাকার সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মী, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ সর্বস্তরের মানুষ পুষ্পস্তবক অর্পণ করে থাকেন। জাতীয় স্মৃতিসৌধ সেদিন ভরে ওঠে অগণিত মানুষের নিবেদিত শ্রদ্ধার ফুলে ফুলে। অন্যদিকে দেশের প্রধান সড়কগুলো সাজানো হয় জাতীয় পতাকা দিয়ে।
তাছাড়াও এই বিশেষ দিন উপলক্ষ্যে ঢাকার সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করা হয়। এসব ছাড়াও এদিন সিনেমা হলে বিনামূল্যে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হয়; সরকারের পক্ষ থেকে তথা বেশ কিছু সামাজিক সংস্থার পক্ষ থেকে দেশের বিভিন্ন অংশে অবস্থিত এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম, হাসপাতাল, জেলখানা, শিশু বিকাশ কেন্দ্রসহ অনুরূপ প্রতিষ্ঠানগুলোতে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়; বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে বিশেষ দোয়া ও উপাসনার আয়োজন করা হয়।
ভারত ও বাংলার যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ, Surrender of Pakistani forces to the joint forces of India and Bengal
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে বাংলার নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের হওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর ভারত ও বাংলাদেশের যৌথবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই দিন ঢাকার কেন্দ্রস্থলে রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করে। এই বাহিনীর পক্ষ থেকে জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি সাক্ষর করেছিলেন। তিনি আত্মসমর্পণ করেন যৌথবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে। এই আত্মসমর্পণ এর সময়কালে সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর উপ-সর্বাধিনায়ক ও ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খোন্দকার।
- ১৯৭১ সালে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের নতুন নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংক হিসেবে।
- ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সংবিধান প্রকাশ করা হয়।
- ১৯৭২ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ গ্যাজেটের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় খেতাব ঘোষণা করা হয়।
- ১৯৯৬ সালে বিজয় দিবসের ২৫ বছর পূর্তি উৎসব করা হয়।
- ২০১৩ সালে বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ২৭,১১৭ জন স্বেচ্ছাসেবী বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার লাল এবং সবুজ ব্লক নিয়ে একত্রে জড়ো হয়ে বিশ্বের বৃহত্তম মানব পতাকার নতুন বিশ্ব রেকর্ড করে।
- ২০২১ সালে বিজয় দিবসের ৫০ বছর পূর্তি উৎসব পালন করা হয়।
উপসংহার, Conclusion
বিজয় দিবস বাংলাদেশের প্রতিটি বাঙালির কাছে বীরের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার দিন। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের নাম জানান দেওয়ার দিন। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর দিন। এক বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামে বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে বাঙালি জাতি নিজেদের জন্য বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাম সংযোজিত করেছিল।
Frequently asked questions
১৬ ই ডিসেম্বর।
জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি।
এর কারণ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতি পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধে বিজয় লাভ করায় বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছিল।