জল দূষণ বর্তমানে সময়ে একটি উদ্বেগজনক সমস্যা। দেশ তথা সারা পৃথিবীতেই কোনো না কোনোভাবে জলদূষণ হয়ে চলেছে নিত্যদিন, আর এই দূষণ মানব স্বাস্থ্যের পাশাপাশি পরিবেশের জন্যও একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জল আমাদের জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ, যা ছাড়া জীবন কল্পনা করা যায় না। তাই আমাদের গ্রহ পৃথিবীর সুস্থ ভবিষ্যতের জন্য জলকে দূষণমুক্ত রাখা এবং সংরক্ষণের জন্য সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা সকলেরই কর্তব্য।
জল দূষণ কি, What is water pollution?
বিভিন্ন মানবিক ক্রিয়াকলাপের ফলে অথবা প্রাকৃতিক কোনো কারণে জলাশয় এবং জলের ভূগর্ভস্থ সম্পদের দূষণকে জল দূষণ বলে। নগরায়ণ বৃদ্ধি, শিল্পায়নের উন্নতি, বন জঙ্গল উচ্ছেদ করে দেওয়া, যেখানে সেখানে বর্জ্য অপসারণ, ল্যান্ডফিল ইত্যাদি মানবিক কর্মকাণ্ড প্রাথমিকভাবে এই জল দূষণের জন্য দায়ী।
তবে আমরা অনেকেই এটা ভুলে যাই যে জল দূষণ শুধু পরিবেশগত উদ্বেগের কারণ নয়, বরং এর পাশাপাশি পৃথিবীর সমস্ত জীবিত প্রজাতির জীবন ও স্বাস্থ্যের বিষয়ও জল দূষণের কারণে সংকটে আছে। পৃথিবীর জনসংখ্যা যেমন দিন দিন বেড়ে চলেছে, ঠিক তেমনি দূষণের ফলে পানীয় জলের মাত্রাও কম হয়ে আসছে। পৃথিবীতে মোট যতটা পরিমাণ জল আছে এই সমস্ত জলের মাত্র 2.5% মিঠা জল অর্থাৎ যে জল আমরা আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনে ব্যবহার করি। কিন্তু, দিনের পর দিন মানুষের সভ্যতার উন্নতি এই মিঠে জলের সম্পদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে, যা এই জলকে ক্রমশ করে তুলেছে দূষিত।
জলের গুরুত্ব, Importance of water
জল পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য একটি অপরিহার্য সম্পদ। জল ছাড়া পৃথিবীতে জীবন অকল্পনীয় হবে। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীদের পরিষ্কার এবং নিরাপদ জল ছাড়া বেঁচে থাকা কঠিন। ছোটবেলা থেকেই আমরা বই পুস্তক পড়ে এসেছি যে পৃথিবীর একভাগ জল এবং অন্যভাগ স্থল। বলতে গেলে পৃথিবীর মোট আয়তনে যতটা পরিমাণ জল রয়েছে তার মধ্যে মাত্র 2.5% আমাদের ব্যবহার করার যোগ্য, যা মিঠা জল হিসেবে পরিচিত।
জল দূষণের কারণগুলো কি কি? Causes of water pollution
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, কিছু প্রাকৃতিক কারণেও জল দূষণ হয়, আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জল মানুষের বিভিন্ন কার্যকলাপের কারণে দূষিত হয়। জল দূষণের জন্য দায়ী কিছু প্রাকৃতিক কারণ হল : আগ্নেয়গিরি এবং বন্যা ইত্যাদি। মানবসৃষ্ট জল দূষণের বিভিন্ন কারণ হল-
কৃষিকাজের মাধ্যমে দূষণ
কিছু কৃষি বর্জ্যে উচ্চ পরিমাণে পুষ্টি থাকে, আর এই পুষ্টিসমৃদ্ধ দূষিত পদার্থগুলি পুকুর – জলাশয় ইত্যাদিতে শৈবালের বৃদ্ধি ঘটায়। জলে শৈবালের প্রাচুর্য জলকে পানীয় এবং অন্যান্য কাজের জন্য অনুপযুক্ত করে তোলে। শেত্তলাগুলি জলে অক্সিজেন টেনে নিয়ে অন্যান্য জীবের জন্য অক্সিজেনের অভাব তৈরি করে, ফলে পুকুর – জলাশয় অন্যান্য জীবের মৃত্যু হয়।
শহুরে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা
শহুরে জনবসতি থেকে আসা পয়ঃনিষ্কাশন দিয়ে আসা বর্জ্য জলাশয়ে ফেলে দেওয়া হয়। এতে ক্ষতিকারক রাসায়নিক, ব্যাকটেরিয়া এবং প্যাথোজেন থাকে, যা জলজ জীবন এবং মানুষের জন্যও অত্যন্ত ক্ষতিকর।
শিল্প বর্জ্য থেকে জল দূষণ
আমরা সকলেই জানি যে শিল্পকারখানাগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এই শিল্প বর্জ্যের মধ্যে আছে সীসা, পারদ, সালফার, অ্যাসবেস্টস এবং নাইট্রেটের মতো দূষক। এটা আর আলাদা করে বলে দিতে হয় না যে এই রাসায়নিকগুলি শুধু উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগত নয় বরং মনুষ্যকুলের জন্য ক্ষতিকারক, কারণ এগুলো জলের সাথে মিশে জলকে ব্যবহারের অনুপযোগী করে তোলে। সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অনুপস্থিতির কারণে, এভাবে জল দূষণ ঘটে।
আবর্জনা ডাম্পিং এর অনুন্নত ব্যবস্থা
আবর্জনা যেমন প্লাস্টিক, খাদ্য, কাঠ, কাগজ, রাবার, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি অনেকসময় সরাসরি সাগর ও নদীতে ফেলা হয়, আবার অনেকসময় পরোক্ষভাবে তাদের কাছে পৌঁছে যায়, কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই, এটি জলাভূমিকে দূষিত করে এবং জলজ জীব তথা সামুদ্রিক জীবনের পাশাপাশি পার্শ্ববর্তী ভূমিতে থাকা উদ্ভিদ ও প্রাণী জীবনকেও হুমকির মুখে ফেলে।
ল্যান্ডফিলস লিকেজের থেকে জল দূষণ
ল্যান্ডফিলস হল আবর্জনার বিশাল স্তূপ। এগুলি সাধারণত যেকোনো শহর বা শহুরে জনবসতির উপকণ্ঠে দেখা যায়। ল্যান্ডফিলে জমা করা আবর্জনাগুলো অনেক সময় বৃষ্টির সাথে জলাশয়ে এসে পড়ে বা কিছু বাতাসের সাথে উড়ে জলাশয় বা নদীর জলে গিয়ে পৌঁছায়, যায় ফলে জল দূষিত হয়, যা জলজ জীবনের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এছাড়াও, পৃথিবী তথা সারা বিশ্বের বহু পরিবারে রোজকারের কার্যকলাপের দরুন যে গৃহস্থালি বর্জ্য তৈরি হয় সেগুলোর সঠিক বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব রয়েছে এবং এগুলোর বেশিরভাগই সরাসরি জলে ফেলা হয়, তাই দিন দিন জল দূষণের মাত্রা বেড়ে চলেছে।
জল দূষণের প্রভাব, Effect of water pollution
জল দূষণের সবচেয়ে বেশি ও দ্রুত প্রভাব জলে বসবাসকারী জীবের ওপর পড়ে, যা পরবর্তীতে আশেপাশের গাছপালা, প্রাণী এবং মানুষের জন্যও ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়ায়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বা কারখানা থেকে নির্গত রাসায়নিক জল দূষণকারী উপাদান হিসেবে সবচেয়ে ক্ষতিকর, কারণ এগুলি খাওয়া বা ব্যবহারের জন্য জলকে ক্ষতিকারক করে তোলে, আর এই দূষিত জলের ব্যবহার মানুষের মধ্যে বেশ কিছু গুরুতর রোগ সৃষ্টি করতে পারে, যেমন – ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড, আমাশয় ইত্যাদি এবং জীবন-হুমকি হয়ে উঠতে পারে। তাইতো কবি লিখেছেন,
“জলে প্লাস্টিক মল মূত্র, স্রোতে লেগেছে জরা,
মরছে জীব লুপ্ত উদ্ভিদ, সূর্যি করেছে খরা।
মানুষের চক্রে অপবিত্র ভগীরথ, খুইয়েছে প্রাণ শক্তি,
সবুজ ফসল বিষে পূর্ণ, রোষে নিহত ভক্তি।”
জল দূষণ প্রতিরোধের উপায়, Ways to prevent water pollution
কিছু সহজ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে আমরা জল দূষণ প্রতিরোধ করতে পারি। যেমন –
- আপনার রান্নাঘরের সিঙ্কে চর্বি বা তেল ঢেলে দেবেন না।
- আমাদের বাড়ির বর্জ্য নিষ্পত্তি করার সময় আমাদের অবশ্যই যত্ন নিতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে এই জাতীয় বর্জ্য পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থায় না পৌঁছায়। প্রয়োজনে রাসায়নিক স্প্রে ব্যবহার করে ড্রেনগুলোকে জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে, লক্ষ্য রাখতে হবে যেন বর্জ্য থেকে কোনো দূষিত পদার্থ নর্দমা বা জলাশয়ের জলের সাথে না মিশতে পারে।
- অব্যবহৃত বা মেয়াদোত্তীর্ণ কোনো ওষুধ কখনই বাড়ির বর্জ্য নিষ্কাশনে পৌঁছাতে দেবেন না।
- কৃষি ক্ষেত্রে যথা সম্ভব কম রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে বরং জৈব সার বেশি ব্যবহার করতে হবে।
- বর্তমানে বাজার হাটে তথা প্রতিটি বাড়িতে পলিথিন ব্যাগ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। আমরা যে পলিথিন ব্যবহার করি, তা নন-বায়োডিগ্রেডেবল হওয়ায়, এটি সেখানে পড়ে থাকে এবং মাটি ও জলকে দূষিত করে তোলে।
- বর্জ্যকে অ-ক্ষয়যোগ্য হিসাবে আলাদা করুন এবং এর যথাযথ নিষ্পত্তি নিশ্চিত করুন।
- আপনার দৈনন্দিন সকল কাজকর্ম করার সময় কথা সম্ভব জল সংরক্ষণের চেষ্টা করুন, যেমন রান্না করার সময়, শেভিং করতে গিয়ে জলের নল ছেড়ে রাখবেন না, স্নান করতে জল কম ব্যবহার করুন।
- অটোমোবাইল তেলের মতো বর্জ্য ভুল করেও কখনো যেনো ড্রেনে না ফেলা হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে, কারণ এটি খুব সহজেই নদী ও স্রোতে পৌঁছায়। এটি জলর বিশুদ্ধতা নষ্ট করে দেয়।
উপসংহার, Conclusion
জল দূষণ যদি বর্তমান সময়ের মতো চলতে থাকে, তবে দু-এক দশকের মধ্যেই হয়তো আমদের গ্রহ জলের তীব্র সংকটের মুখোমুখি হতে পারে। নিঃসন্দেহে জল দূষণ আজ এক গুরুতর সমস্যা হয়ে দঁড়িয়েছে যা পৃথিবীর সকল বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যের জন্য উদ্বিগ্নতার কারণ। আমরা সবাই জানি যে জল আমাদের জন্য একটি খুব দরকারী সম্পদ, যা মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীদের পানীয় এবং অন্যান্য জরুরী ক্রিয়াকলাপের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তাই যদি দুষ্প্রাপ্য মিঠে জলকে ক্রমশ দূষিত করে যাওয়া হয় তবে আমাদের এই গ্রহে জীবনের সম্ভাবনা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে থাকবে। পৃথিবীতে যদি জীবন বাঁচাতে হয় তবে আমাদের প্রথম দায়িত্ব হবে আশেপাশের সকল পরিষ্কার রাখা এবং জল সংরক্ষণ করা।