“বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ” কথাটি সেই সম্পদগুলিকে সংরক্ষণ করার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যা আমাদের কাছে প্রকৃতির উপহার। বন্য প্রাণী জঙ্গলের পরিবেশে বাস করে। তাই বন এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করা প্রয়োজন যাতে তারা বিলুপ্তির ঝুঁকি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। তাছাড়া এগুলো আমাদের জৈব বৈচিত্র তথা বাস্তুতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, ফলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ না করলে বাস্তুতন্ত্রে ব্যাঘাত ঘটবে। তাই আমাদের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করার জন্য উপযুক্ত পদ্ধতি প্রয়োগ করে বন্যপ্রাণী প্রজাতিকে বিলুপ্ত বা বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
বন্যপ্রাণী বিলুপ্তির হুমকির সম্মুখীন, Wildlife threatened with extinction
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ব্যবস্থা বিলুপ্তির হুমকির সম্মুখীন বন্যপ্রাণীদের বাঁচিয়ে রাখতে পারে। বন্যপ্রাণী আমাদের পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করছে। কিন্তু এই বন্যপ্রাণীর বিলুপ্তির পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে মানুষের অমানবিক কর্মকাণ্ড। আমাদের দেশ জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হলেও, বন্যপ্রাণীদের ক্ষতির জন্যও মানবসৃষ্ট অনেক কারণ দায়ী।
\বন্যপ্রাণী ধ্বংসের মূল কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অরণ্য সম্পদের অত্যধিক ব্যবহার, প্রাকৃতিক বাসস্থানের ক্ষতি সাধন, অত্যধিক পরিমাণে দূষণ, বাসস্থানের বিভাজন, শিকার, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি। মানুষ জীবনধারা ও আধুনিকতায় অগ্রসর হচ্ছে, যার ফলস্বরূপ ব্যাপকভাবে গাছপালা ও বন কাটা হচ্ছে, আর এসবের কারণে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মানুষের চিন্তাহীন ক্রিয়াকলাপ বন্যপ্রাণী প্রজাতির ব্যাপক বিলুপ্তির জন্য দায়ী।
বন্যপ্রাণীর অভাবের কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত, Details on the causes of wildlife scarcity
বন্যপ্রাণী ধ্বংসের বিভিন্ন কারণ রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারণ হল :
বাসস্থানের ক্ষতি :
নির্মাণ প্রকল্প, রাস্তা, বাঁধ ইত্যাদি নির্মাণের জন্য বন তথা কৃষি জমি ধ্বংস, অপ্রয়োজনীয় বন উজাড়, ইত্যাদির মাধ্যমে বিভিন্ন বন্যপ্রাণী এবং উদ্ভিদের আবাসস্থলের ক্ষতি হচ্ছে। এসব অমানবিক কর্মকাণ্ড বনের পশুদের থেকে তাদের বাসস্থান কেড়ে নিচ্ছে, ফলে বহু প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যায়।
সম্পদের অত্যধিক শোষণ :
প্রাকৃতিক সম্পদগুলিকে অপ্রাকৃত উপায়ে ব্যবহার করা হয় বলেই এগুলো প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ব্যবহার হয়ে যাচ্ছে। এই অতিরিক্ত ব্যবহার প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করছে, যা সব ধরনের প্রজাতির বিলুপ্তির দিকে নিয়ে যাবে।
শিকার এবং চোরাচালান :
মজা করার জন্য অনেকেই প্রাণী শিকার করে, যা সত্যিই একটি জঘন্য কাজ। নিজস্ব বিনোদনের জন্য এবং কিছু পণ্য পাওয়ার আনন্দের জন্য প্রাণীদের হত্যা করার মতন ঘৃণ্য কাজ আর কিছু হতে পারে না। কিছু প্রাণী থেকে তৈরি পণ্য অত্যন্ত মূল্যবান, উদাহরণস্বরূপ, হাতির দাঁত, চামড়া, শিং ইত্যাদি। এটি বেশ কিছু বন্যপ্রাণীকে বিলুপ্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যার উল্লেখ্যযোগ্য উদাহরণ হল কস্তুরী হরিণ।
গবেষণার উদ্দেশ্যে প্রাণীদের ব্যবহার করা :
বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষাগারে পরীক্ষামূলক কাজের ফলাফলের জন্য বিভিন্ন প্রাণী নির্বাচন করা হয়। গবেষণার জন্য অনেক সময় একই প্রজাতির প্রাণী ব্যাপক ব্যবহার হয়, যা সেই প্রজাতির বিলুপ্তির জন্য দায়ী।
পরিবেশ দূষণ :
মনুষ্য কুলের উন্নতির সাথে পরিবেশে বিভিন্ন ধরনের দূষণের মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। বিশেষত বায়ু, জল এবং মাটির গুণমান পরিবর্তন করার কারণে প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা অনেকাংশে হ্রাস পাচ্ছে। তাছাড়া জল দূষণের কারণে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্যও উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়; প্রবাল প্রাচীরগুলি তাপমাত্রা পরিবর্তন এবং দূষণ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রকার, Types of wildlife conservation
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রকারগুলো হল :
- ইন-সিটু সংরক্ষণ – এই ধরণের সংরক্ষণের ক্ষেত্রে উদ্ভিদ এবং প্রাণীর প্রজাতি এবং তাদের জেনেটিক উপাদানগুলি তাদের আবাসস্থলের মধ্যে সুরক্ষিত বা সংরক্ষিত করে রাখা হয়। এ ধরনের এলাকাকে বলা হয় সংরক্ষিত এলাকা। যেমন : জাতীয় উদ্যান, অভয়ারণ্য, বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ ইত্যাদি।
- এক্স-সিটু সংরক্ষণ – সংরক্ষণের এই কৌশলে উদ্ভিদ এবং প্রাণীর বিভিন্ন প্রজাতির পাশাপাশি তাদের বাসস্থানের বাইরে জেনেটিক উপাদানগুলিকে সংরক্ষণ করা হয়। এই সংরক্ষণ পদ্ধতি জিন ব্যাঙ্ক, ক্রিওপ্রিজারভেশন, টিস্যু কালচার, ক্যাপটিভ ব্রিডিং এবং উদ্ভিজ্জ বাগানের আকারে করা হয়।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের গুরুত্ব, Importance of wildlife conservation
ভারতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রচেষ্টা সম্পর্কে বলতে গেলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য সরকার কর্তৃক অনেক কর্ম ও নীতি প্রণয়ন ও পরিবর্তন করা হয়েছে। সেগুলি হল :
প্রজেক্ট টাইগার:
ভারত সরকার এই প্রকল্পটি 1973 সালে ক্রমহ্রাসমান বাঘের জনসংখ্যা সংরক্ষণ ও পরিচালনার উদ্যোগে শুরু করেছিল। বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যা ও আবাসস্থল ক্রমবর্ধমান মানবিক কর্মকাণ্ড ও অগ্রগতির ফলে দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। তাই তাদের আবাসস্থল এবং তাদের সংখ্যা সংরক্ষণ করতে এই প্রকল্প শুরু করা হয়েছিল।
ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন অথরিটি দ্বারা প্রকল্পটি পরিচালিত হয়, এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বাঘের আবাসস্থলকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানো এবং বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি নিশ্চিত করা।জাতীয় পশু বাঘ সংরক্ষণের জন্য এটি ছিল একটি সফল প্রচেষ্টা, কারণ এই প্রচেষ্টার পরে বাঘের সংখ্যা প্রায় 1000-5000 বেড়েছে। প্রাথমিক স্তরে, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে 9টি সংরক্ষিত এলাকা ছিল যা 2015 সাল নাগাদ 50টিতে উন্নীত হয়েছে।
প্রজেক্ট হাতি:
রাস্তা, রেলপথ, রিসর্ট, বিল্ডিং ইত্যাদি নির্মাণ করার মতো মানবসভ্যতার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশাল পরিমাণে বন ও চারণ স্থান পরিষ্কার করা হয়, ফলে বিভিন্ন বন্য প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হয়। হাতির ক্ষেত্রেও এই ধ্বংসের ব্যতিক্রম নেই। তাই হাতির সংখ্যা সংরক্ষণ, তাদের আবাসস্থল বজায় রাখতে, মানব-প্রাণী সংঘর্ষ কমানোর পাশাপাশি চোরাশিকার কম করতে 1992 সালে ভারত সরকার এলিফ্যান্ট প্রকল্প চালু করেছিল। প্রকল্পটি কেন্দ্রীয় স্তরের হলেও দেশের বেশ কিছু রাজ্যগুলি দ্বারা পরিচালিত হয়, এই প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন রাজ্যকে তাদের প্রয়োজন অনুসারে তহবিল সরবরাহ করা হয়। মূলত ১৬ টি রাজ্যে এই আইনটি বাস্তবায়ন করছে।
কুমির সংরক্ষণ প্রকল্প:
1975 সালে রাজ্য স্তরে কুমির সংরক্ষণ প্রকল্প শুরু হয়েছিল। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল কুমিরের আবাসস্থল ধ্বংস রোধ করে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা। এই উদ্যোগের ফলস্বরূপ, 2012 সালের মধ্যে কুমিরের সংখ্যা 100 থেকে 1000-এ উন্নীত হয়।
ইউএনডিপি সামুদ্রিক কচ্ছপ সংরক্ষণ প্রকল্প:
কচ্ছপের ক্রমহ্রাসমান জনসংখ্যাকে যথাযথভাবে পরিচালনা ও সংরক্ষণ করা ছিল ইউএনডিপি কর্তৃক সূচিত এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করার বিভিন্ন পদক্ষেপ, Various measures to conserve wildlife
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রচার করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপগুলি হল :
- সরকারের পক্ষ থেকে পশু শিকারে নিষেধাজ্ঞার বিভিন্ন আইন তৈরি। কেউ আইন ভেঙে এ ধরনের কাজ করার চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া। শিকার করলে বড় ধরনের জরিমানা দেওয়ার আইন তৈরি করা।
- ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রাকৃতিক আবাসস্থল সংরক্ষণের জন্য অনেক প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য নির্মাণ করা।
- বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীদের বংশবৃদ্ধির জন্য আবাসস্থল সরবরাহ করা।
- দূষণ এবং অন্যান্য অমানবিক কার্যকলাপ থেকে বন্যপ্রাণীর প্রাকৃতিক বাসস্থানের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। এর কারণ দূষণ প্রাণীদের প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করতে পারে। তাই, বনের কাছাকাছি শিল্প কাজ নিষিদ্ধ রাখা।
- পশুদের সুরক্ষা এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য মাংস খাওয়ার হ্রাস ক্রমবর্ধমানভাবে প্রচার করা।
উপসংহার, Conclusion
বন্যপ্রাণী এবং গাছপালা আমাদের প্রকৃতিতে সৌন্দর্য যোগ করে। তাদের স্বতন্ত্রতা, কিছু পাখি এবং প্রাণীর সুন্দর শব্দ, পরিবেশ এবং বাসস্থানকে খুব আনন্দদায়ক এবং বিস্ময়কর করে তোলে।তাই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে ইতিবাচক মনোভাব থাকতে হবে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সরকার ইতিমধ্যেই বেশ কিছু নীতি, পরিকল্পনা এবং উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে।
যেসব প্রাণী ও উদ্ভিদ তাদের নিজস্ব আবাসস্থলে টিকে থাকতে অক্ষম বা বিলুপ্তির মুখে রয়েছে তাদের পরীক্ষাগারে বা নির্দিষ্ট রিজার্ভে প্রাক-নির্ভর ব্যবস্থা অনুসরণ করে রক্ষা করা উচিত। বন্য প্রাণী এবং গাছপালাকে সংরক্ষণ করা আমাদের কর্তব্য, কারণ এর উপর বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নির্ভর করছে।