শীতকাল রচনা, Essay on Winter Season in Bengali

শীতকাল রচনা

ভারত তথা বাংলায় আমরা ঋতুর অস্তিত্ব সম্পর্কে শৈশবকালে জেনেছি। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত; এই ছয় ঋতুর মধ্যে সবচেয়ে ঠাণ্ডা ঋতু হল শীত ঋতু। হেমন্তকাল শেষে শুরু হয় শীতকাল। শীতকাল ঋতুচক্রের পঞ্চম ঋতু। শীতের সকালগুলো  বেশিরভাগ মানুষের লেপ-কম্বলের নিচেই কেটে যায়।  এমনকি সূর্যও যেন এই ঋতুতে কুয়াশা ও মেঘের আড়ালে থেকে বিশ্রাম নেয় বলে মনে হয়। কবির কথায় বলা যায়,

“চুপি চুপি কোথা থেকে এলো আজ শীত,
গুন গুন গায় পাখি শীত শীত শীত ।
কৃষকেরা ধান কেটে পায় খুঁজে সুখ
পিঠাপুলি খাবে তাই উজ্জ্বল মুখ । 
রাখালেরা বাঁশি নিয়ে সুর তুলে গায়
চারদিকে মাঠগুলো ধানে ছেয়ে যায় । “

শীতের সময়কাল, Shiter somoykal

ভৌগোলিকভাবে, শীতকাল আসে যখন পৃথিবীর অক্ষ সূর্য থেকে সবচেয়ে দূরে বলে মনে হয়। ইংরেজি বছরের ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি মাস এবং বাংলা বছরের পৌষ থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত শীত ঋতুর সময়কাল। তবে ভারতে সাধারণত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাস ধরে শীতকাল থাকে। শীতকালে দিনের দৈর্ঘ্য বাড়তে থাকে এবং রাতের দৈর্ঘ্য কমতে থাকে।

শীতের সময়কাল

সকলের প্রিয় ঋতু শীতকাল, Everyone’s favorite season;  winter

কিছু মানুষের কাছে শীত কাল কিছুটা নিস্তেজ এবং বিরক্তিকর বলে মনে হয়, যেহেতু ঠান্ডা থাকার কারণে আমাদের ঘরের বাইরে চলাফেরা করতে অসুবিধা হয়ে যায়, কম্বল আর বিছানা ছেড়ে যেন কোথাও যাওয়ার ইচ্ছেই করে না।

আবার কারো কারো মতে শীত ঋতুই পর্যটনের জন্য সেরা ঋতু, প্রয়োজনে ভারী পোশাক পরে যাওয়ার হলেও সমস্যা নেই, কিন্তু পরিবেশ ঠাণ্ডা থাকে বলে কোথাও ঘুরতে গেলেও গরম কালের মত অস্বস্তি বোধ হয় না। তাছাড়া আজকাল শীতের কাপড়গুলো ভিন্ন ভিন্ন ধাঁচের পাওয়া যায়, তাই সেগুলোর মধ্য দিয়ে ফ্যাশনের কোনো কমতি থাকে না, ফলে শীতের কাপড়ে ঘুরতে যাওয়া নিয়েও করো কোনো দ্বিধা থাকে না। তাই এই ঋতু অনেকেরই প্রিয় সময়কাল। 

সকলের প্রিয় ঋতু শীতকাল

শীতকালের ফুল ও ফল, Winter flowers and fruits

শীতকাল হল এমন একটি ঋতু, যখন সমস্ত গাছ তাদের সৌন্দর্য হারায় এবং গাছের পাতা এবং ফুল সব ঝরে যায়। তবুও কিছু ফুল আছে যা শীতকালেই ফোটে। শীতকালীন কিছু ফুল হল : ডালিয়া ফুল, সূর্যমুখী, চন্দ্রমল্লিকা, কসমস, জিনিয়া, গাঁদা, গোলাপ, ক্যামেলিয়া, লিলি, পদ্ম ইত্যাদি।

তাছাড়া শীতের সময়ে পাওয়া যায় এমন বিভিন্ন ফল ও সবজি হল কমলালেবু, আপেল, পেয়ারা, আঙুর, ডালিম-সহ একাধিক ফল; অন্যদিকে সবজির ক্ষেত্রে থাকে গাজর, বিট, বিনস, ব্রকোলি, টমেটো, ক্যাপসিকাম, শিম ইত্যাদি পুষ্টিকর সবজি। কমলালেবু ছাড়াও শীতকালে যে সব ফল বাজার মাতিয়ে রাখে সেটি হল শাঁকালু, সবেদা। উক্ত দেশী ফল খেতে যেমন ভাল তেমনই এর পুষ্টিগুণও অনেক।

শীতকালের ফুল ও ফল

শীতকালীন বিভিন্ন রোগ, Various winter diseases

 অন্যান্য ঋতুর তুলনায় শীতের সময় আমরা কাশি এবং সর্দির মত সমস্যায় বেশি জর্জরিত হই। একটু ঠাণ্ডা লাগলেই জর সর্দি দেখা দেয়। তাছাড়াও শীতের সময়ে দেখা দেয় এমন সব রোগগুলো হল নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, হাঁপানি, সর্দি-জ্বর ও ডায়রিয়া ইত্যাদি। 

জিশুখিষ্টের জন্মকাল, Winter and Christmas

শীতকালের সময়েই ইংরেজি নতুন বছরের সূচনা হওয়ায় এই ঋতুকে খুবই প্রতীকী মনে করা হয়। ক্রিসমাসের প্রাক্কালে, আমাদের মধ্যে অনেকেই বাড়িতে বিভিন্ন ভাবে ক্রিসমাস ট্রি সাজাই এবং যীশুখ্রিস্টের কাছে প্রার্থনা করি যেন আমাদের সামনে একটি সমৃদ্ধ নতুন বছর আসে। ক্রিসমাসের পরই মানুষ সম্পূর্ণ ইতিবাচক এবং প্রাণবন্ত শক্তির সাথে একটি নতুন সূচনাকে স্বাগত জানায়।

জিশুখিষ্টের জন্মকাল

শীতকাল আমার কিভাবে কাটাই, How do we spend Winter season ?

শীতকালে ঘরে বসেই বিভিন্নভাবে আনন্দ উপভোগ করা যায়। সকালে ঘুম ভাঙলেও লেপমুড়ি দিয়ে আরো কিছুক্ষণ বিছানায় পড়ে থাকার কাজ তো শীতের দিনে অনেকেই করে থাকেন। শীতের সকালে রোদও যেমন একটু আলস্য দেখিয়ে দেরিতে ওঠে, সূর্যের কিরণ এর মধ্যে যে হালকা তেজ থাকে সেটা ঠাণ্ডা হাওয়ার মাঝে যেন বেশ আরাম প্রদান করে। তাই কবি লিখেছেন, ” আমি তো দেখেছি ভাই ভোরের সূর্য নাই, শীতের সকাল ভাই আমাকে চেপে ধরল তাই, আমি যতই বলি ছাড় ছাড় ছাড়-ভাই, শীত আমার চিৎকার শোনে নাই।”

শীতকালে বেশিরভাগ মানুষ গরম জলে স্নান করেন, বিশেষ করে শিশু এবং বয়স্করা। স্নানের পর রোদে বসে শরীর গরম করতে করতে কমলালেবু খাওয়ার আনন্দ নেন অনেকেই। গ্রামাঞ্চলের এমন দৃশ্য হয়তো আজও দেখতে পাওয়া যায়। আজকাল বাড়িতে অনেকেই নিজেদেরকে উষ্ণ রাখার জন্য রুম হিটারও ব্যবহার করেন, তাছাড়া শীতের দিনে গরম চা কফির সাথে গরম গরম খাবার খাওয়ার মজাই আলাদা। কোনোদিন হালুয়া তো কোনদিন গরম লুচির সাথে সবজি বা অন্যকিছু।

শীতকাল আমার কিভাবে কাটাই

ঘরে বসে গায়ে কম্বল চাপিয়ে অনেকেই এসব খাবার আর গল্পের মধ্য দিয়ে নিজের সন্ধ্যা যাপন করেন। কিছু স্কুল তথা কলেজ ছাত্ররা সাধারণত শীতকালের ছুটি পায় নিজেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। এই ছুটিতে বাড়ির সকলে মিলে পিকনিকের জন্যও পরিকল্পনা করে। প্রচণ্ড শীতে যখন কোনো পাহাড়ি এলাকার ঘুরতে যাওয়া হয়, তখন মনে হয় যেন আমরা পৃথিবীতেই স্বর্গ পেয়ে গেছি। কিছু কিছু পাহাড় বরফের সৌন্দর্যে ভরে থাকে, আর চারিদিকে ছড়িয়ে থাকে কুয়াশার আস্তরণ, যা স্বর্গীয় মুহূর্তের মতো মনে হয়। কবির কথায় শীতকালকে বর্ণনা করে বলা যায়,

“সাদা কুয়াশার পাদদেশে, শীত এলো আমার দেশে। শীতের উষ্ণতায় ভরছে মন।”

শীতের প্রাণীদের প্রতিক্রিয়া, Animal response to winter

কিছু প্রাণী আছে যারা গ্রীষ্মকালে খাবার সংরক্ষণ করে যাতে তারা শীতকালে সেগুলি গ্রহণ করতে পারে, যেমন কাঠবিড়ালিরা এই ধরণের পদ্ধতিতে বসবাস করতে পছন্দ করে। তাছাড়াও এই তালিকায় রয়েছে পিঁপড়েরাও। তবে শীতকালে বেশিরভাগ প্রাণীদের সবচেয়ে সাধারণ কার্যকলাপ হল হাইবারনেশন। এই পদ্ধতিতে, সমস্ত সরীসৃপ প্রাণী গভীর ঘুমে চলে যায় বা নিষ্ক্রিয় পর্যায়ে থাকে যাতে তাদের আবহাওয়ার মুখোমুখি না হতে হয়, নাহলে তাদের বিপাক হ্রাস পায়। অন্যদিকে কিছু লোমশ প্রাণী, যেমন আর্কটিক শিয়াল এবং মেরু ভালুকের সাধারণত শীতকালে শীত সহ্য করার মত ক্ষমতা থাকে এবং তারা এসময় নিজের পশমের রঙ পরিবর্তন করে। 

শীতকালীন পরিবেশ, Winter environment

শীতকালে ভোরবেলা সবকিছু কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকে, দেখলে মনে হবে যেন গাছগুলোও ঘুমিয়ে আছে। সূর্যের কিরণের দেখা পেয়ে পাতায় পাতায় জমে থাকা শিশির কণাগুলো ঝিলিক মেরে ওঠে। ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দুগুলো দেখলে মনে হয় যেন সবুজ ঘাসেরা যেন মাথায় কোনো মণি পরে আছে। কবির কথায়,

“কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে সবুজ দিগন্ত ঘুমিয়ে আছে, মেঠো পথ পেরিয়ে।
সহশায় – শীতের সোনালি সকাল রবি কিরণ – কুয়াশার মায়াজাল ছিন্ন করে, জেগেছে দিগন্তে ঝলমল”

শীতে গাছেদের আমরা লক্ষ্য করি যে সমস্ত পর্ণমোচী, বহুবর্ষজীবী এবং বার্ষিক উদ্ভিদগুলো এই ঋতুতে অস্তিত্বের জন্য অনেক সংগ্রাম করে। তবুও এমন বহু ফসল আছে যা শীতকালে ভালো ফলন দেয় বলে কৃষকের মুখে হাসি ফুটে।

দরিদ্র মানুষের জন্য অভিশাপ, Winter: A Curse for the poor man

 শীতকাল দরিদ্র মানুষের জন্য অভিশাপ স্বরূপ। আবহাওয়ার ঠাণ্ডা থাকে বলে ধনী বা মধ্যবিত্তরা ভারী জামাকাপড় পরতে পারে, কিন্তু দরিদ্রদের ক্ষেত্রে জামাকাপড় এবং কম্বল দ্বারা শীত থেকে সুরক্ষিত থাকার মতো সুবিধা নেই। বিশেষ করে যাদের ঘর নেই, ফুটপাতে থেকে রাত যাপন করে তাদের ক্ষেত্রে এই সময়কাল খুবই কষ্টকর।

প্রায়ই দেখা যায় অনেকে রাস্তার নোংরা আবর্জনা সংগ্রহ করে আগুন জ্বালিয়ে গরম অনুভব করার চেষ্টা করে। একে থাকে খাবারের অভাব, তার উপর শীতের তাণ্ডবে অতীষ্ট বোধ করেন দরিদ্র মানুষেরা।

রাস্তায় বেরোলেই দেখা যায়, দরিদ্র ও হতদরিদ্র মানুষ, যাদের শীতবস্ত্র নেই, শীত নিবারণের জন্য সামান্য একটি কম্বল নেই। তবে এখনকার সময়ে দেখা গেছে যে, প্রতি শীতে অনেক সরকারি তথা বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য দরিদ্রদের মধ্যে খাবার, গরম কাপড় ইত্যাদি সামগ্রী বিতরণ করা হয় থাকে। 

দরিদ্র মানুষের জন্য অভিশাপ

উপসংহার, Conclusion 

 নতুন সূচনার আশায় শরতের পর মানুষ শীতকে বরণ করে নেয়। অনেকের জন্য এই ঋতু আনন্দ নিয়ে আসে, আবার অনেকের জীবনের কষ্ট যেন আরো বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু এই কষ্টের অবসান তো কোনো না কোনোভাবে ঘটবেই। তবুও শীতকাল বিভিন্নভাবে মানুষের জীবনে আনন্দ নিয়ে আসে, যা উপভোগ করার মধ্য দিয়ে সকলে এই ঋতুটিকে অন্তর থেকে অনুভব করে।

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts