নারী শিক্ষা নিয়ে বহু সংগ্রামের কথা আমরা ইতিহাসের পাতায় পড়েছি বহুবার। ইচ্ছে থাকলেও শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেনি এমন বহু নারী আছেন দেশে। এমনকি আমরা আমাদের দিদা ঠাকুমাদের জিজ্ঞেস করলে অনেক সময় নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে বহু বাধার সম্মুখীন হওয়ার গল্প শুনতে পারি। তবে ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে নারী শিক্ষার বিষয়টি আমাদের সামাজিক অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে এক অপরিহার্য বিষয় হিসেবে জড়িত।
আমাদের আধুনিক সমাজে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মৌলিক অধিকার সবার ক্ষেত্রেই সমান ও অভিন্ন। বর্তমান বিশ্ব যে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক পালাবদলে অংশ নিচ্ছে সেক্ষেত্রে নারীও অপরিহার্য অংশীদার। কিন্তু যেসব নারী অজ্ঞানতার অন্ধকারে পিছিয়ে পড়েছে তাদের ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ভূমিকা পালন করা সম্ভব নয়। তাই দাবি উঠেছে নারীদের শিক্ষিত করার।
নারী শিক্ষার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, Historical context of women’s education
প্রাচীন কালের হিন্দু-বৌদ্ধ সাহিত্য সংক্রান্ত বিভিন্ন গ্রন্থে শিক্ষিত নারীর উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে সভ্যতার বিকাশ হওয়ার পাশাপাশি সমাজে পুরুষের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে, ফলে নারী অন্তঃপুরবাসী হয়ে পড়ে। ভারতে ইংরেজ শাসন শুরু হলে পাশ্চাত্য শিক্ষার হাওয়া লাগে দেশে, আর সেই হাওয়ায় নারীগণ আবার শিক্ষার অঙ্গনে আসার সুবর্ণ সুযোগ পায়।
তারপরও কিছু সামাজিক অবক্ষয়ের ফলে বহু নারী পিছিয়ে থেকে যায়। ইউরোপীয় জীবন-ব্যবস্থায় নারী-পুরুষের সমমর্যাদা তথা অবাধ মুক্ত জীবনছন্দ দেশে বসবাসকারী বুদ্ধিজীবীদের মানসে নারী-প্রগতির ভাবপ্রবাহের ঢেউ তোলে। এই পাশ্চাত্য ভাবপ্রবাহে আলোকিত হয়েই বিদ্যাসাগর, রামমোহন প্রমুখ দেশব্রতীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় নারী শিক্ষা ও নারী প্রগতির বিকাশের দরজা খুলে যায়।
কিন্তু তখনও ধর্মীয় কুসংস্কার নারীদের শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগের মুখে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষত মুসলমানদের ক্ষেত্রে। তবে সে বাধা কাটিয়ে মুসলমান নারীদের শিক্ষার অঙ্গনে নিয়ে আসার জন্য বেগম রোকেয়া অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন। নিঃসন্দেহে ইংরেজ আমলে নারী শিক্ষার বিকাশ ঘটেছিল। এই বিকাশের ফল হচ্ছে, প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে সহ-শিক্ষার প্রবর্তন। কিন্তু এতসব অগ্রগতি সত্ত্বেও নারীরা শিক্ষার ক্ষেত্রে ছিল পুরুষদের চেয়ে অনেক অনেক পিছিয়ে।
নারীশিক্ষা বিকাশের পথে বাধাসমুহ, Obstacles to the development of women’s education
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এ বিষয় পরিষ্কার যে নারীশিক্ষার অতীত খুব একটা সুখকর ছিলনা। আমরা সকলেই কম বেশি জানি যে অতীতে নানারকম সমস্যা নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে বাধাবিঘ্নের সৃষ্টি করেছিল। ব্রিটিশ শাসিত অবিভক্ত ভারতের নারীরা একসময় শিক্ষার আলাে থেকে বঞ্চিত ছিল। এর মূল কারণগুলি হল :
- ধর্মীয় অনুশাসন,
- কুসংস্কারে নিমজ্জিত সমাজ;
- পুরুষশাসিত সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি;
- নারীদের ধর্মীয় ভীতি;
- শিক্ষা সম্পর্কে নারীদের উদাসীনতা;
- পরনির্ভরশীলতা।
সমাজে নারী শিক্ষার অভাবে সৃষ্ট সমস্যা, Problems caused by lack of women’s education in the society
সমাজে শিক্ষিত নারীদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। বলতে গেলে পরিবার থেকে শুরু করে কোনো একটি রাষ্ট্রের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই শিক্ষিত নারী খুব প্রয়ােজন। শিক্ষিত নারী নিজের শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যমে তার সতীর্থ পুরুষকে সহায়তা প্রদান করতে সক্ষম, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। বলাই বাহুল্য শিক্ষিত নারী দেশের জন্য এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ভিত্তি তৈরিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে। নারী শিক্ষার অভাবে সমাজের অগ্রগতি কিভাবে বাধাগ্রস্ত হয় জেনে নিন :
- ১. নারী শিক্ষার অভাবে যেকোনো শিক্ষিত জনগােষ্ঠী গড়ে তােলার ক্ষেত্রে সমাজ বহুলাংশে পিছিয়ে থাকছে;
- ২. নারী শিক্ষার অভাবে বহু ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা কাটছে না;
- ৩. অশিক্ষিত নারী কর্মহীন বিবেচনায় দেশের জন্য এক বােঝা হয়ে আছে:
- ৪. স্বাধীনতা ও শিক্ষার অভাব থাকায় নারীদের প্রকৃতিপ্রদত্ত গুণাগুণ বিকশিত হচ্ছে না;
- ৫. নারী সম্প্রদায় শিক্ষিত না হলে তারা নিজের অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে পারবে না।
উন্নত দেশে নারীদের অবস্থান, Status of women in developed countries
নারীদের অবস্থান উন্নত দেশে সুদৃঢ়। এর প্রধান কারণ নারী শিক্ষার উপর গুরুত্বারােপ। উন্নত শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীতে সেখানে কোনােও ভেদাভেদ নেই। বিভিন্ন দেশ যেমন : আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি, কানাডা প্রভৃতি দেশের নারীরা প্রায় সকল ক্ষেত্রেই পারদর্শী। এসব দেশের নারীরা স্বাধীনচেতা, স্বাধীনভাবে তাদের চলাফেরা।
সমাজে নারী শিক্ষার গুরুত্ব কি, Importance of women education
সমাজে তথা দেশের উন্নতির জন্য নারী শিক্ষার গুরুত্ব কতটা সে সম্পর্কে কোনাে সন্দেহ নেই, কারণ নারীদের সংখ্যা দেশের মােট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক পরিমাণ। সেই হিসাবে তাদের অশিক্ষার অন্ধকারে রেখে জাতিকে উন্নতির পথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এ নিয়ে বিদ্রোহী কবি লিখেছেন:
“রাজা করিতেছে রাজ্য শাসন, রাজারে শাসিছে রানি, রানির দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি।”
শিক্ষিত জননী হিসেবে নারীর ভূমিকা, Role of women as educated mothers
একজন মাতা যদি সুশিক্ষিতা হন তবে তিনি জন্ম দিতে পারেন একজন সুশিক্ষিত সন্তানকে। সেই সন্তান ভবিষ্যতে এক আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। এ কথা সকলেই জানেন যে ছেলে-মেয়েদের উপর পরিবারের অন্যদের তুলনায় তাদের মায়ের প্রভাবই বেশি পড়ে। মায়ের থেকেই সন্তান আচার-আচরণ, আদব-কায়দা ইত্যাদির শিক্ষা পায়। তাই নেপােলিয়ন বলেছিলেন,
“আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তােমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।”
স্বাবলম্বী হতে নারীদের জীবনে শিক্ষার গুরুত্ব, Importance of education in the life of women to become independent
স্বাবলম্বী হতে গেলে নারীদের শিক্ষিত হওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। একটা সময় এমন ছিল যখন বেশিরভাগ নারী জীবনের প্রায় সবকিছুর জন্য স্বামীদের উপর নির্ভরশীল ছিল। সেই নারীরা ছিলেন অবহেলিতা ও নির্যাতিতা। নিজ ঘরেই তাদের সব কিছু সীমাবদ্ধ হয়ে থেকে গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানের আধুনিক সমাজের নারীরা শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি এক একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষিকা, পুলিশ অফিসার ইত্যাদি সম্মানজনক পেশার সাথে যুক্ত, এমনকি বহু নারী সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত। এভাবেই নারীরা আজ নিজেকে সম্পূর্ণরূপে স্বাবলম্বী করে তুলতে পারছেন।
নারী শিক্ষা প্রসারের উপায়গুলো কি, What are the ways to promote women’s education?
সামাজিক সকল বাধা ছিন্ন করে দিয়ে নারীসমাজকে শিক্ষার আলোতে উদ্ভাসিত করার লক্ষ্যে প্রচলিত ধারার পাশাপাশি প্রয়োজন বিশেষ ধরনের শিক্ষা প্রদানের পরিকল্পনা। সে ক্ষেত্রে গণমাধ্যম ব্যবহার করে তাতে লোকরঞ্জনমূলক শিক্ষা কর্মসূচি, কর্মমুখী শিক্ষা কর্মসূচি ইত্যাদির আয়োজন করা যেতে পারে। সব দিক বিবেচনা করে নারী শিক্ষা সম্প্রসারণে নিম্ন পদক্ষেপগুলো নেওয়া প্রয়োজন :
- (১) সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কোনো স্কুলগামী ছাত্রী কোনোও ভাবে নির্যাতনের শিকার না হয়। এক কথায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্বিঘ্নে যাতায়াতের উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত, প্রয়োজনে তাদের জন্য বিশেষ পরিবহন ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।
- (২) সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচির পদক্ষেপ হিসেবে প্রতিটি নারীর প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্যে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ। এজন্যে বিভিন্ন কর্মসূচি যেমন গ্রাম পর্যায়ে মেয়ে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বিবেচনা করতে ছোট ছোট স্কুল স্থাপন করতে হবে, পাশাপশি দেখতে হবে যেন ছাত্রীদের বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব খুব বেশি না হয়। রক্ষণশীল এলাকার ক্ষেত্রে মেয়েদের জন্য হবে আলাদা স্কুল।
- (৩) শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সরকারের পক্ষ থেকে যে বিশেষ উপবৃত্তি চালু আছে তা যেন যথাযথভাবে কাজে লাগানো হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা।
- (৪) ধর্মীয় বাধা, সামাজিক কুসংস্কার, আর্থিক দারিদ্র্য ইত্যাদি অন্তরায় কাটিয়ে নারীদের শিক্ষার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসার জন্যে সামাজিক প্রণোদনা সৃষ্টি করতে হবে। এক্ষেত্রে গণমাধ্যম এবং বিভিন্ন সামাজিক-সংস্কৃতিক সংগঠনকে কাজে লাগানো যায়।
উপসংহার, Conclusion
নারীশিক্ষা আমাদের মতাে দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সমাজে নারীদেরকে পশ্চাতে রেখে দেশের তথা সমাজের উন্নতির প্রত্যাশা করা দুরাশারই শামিল। এর কারণ হিসেবে কবি লিখেছেন, “কোনাে কালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।”
তাই অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে নারীকে মুক্ত করা খুব জরুরী। আর শিক্ষাই খুলে দেবে নারীদের জন্য মুক্তির পথ। দেশের মােট জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। সেজন্যই আমাদের এই নারীসমাজকে অশিক্ষিত রেখে জাতীয় উন্নয়নের কথা কল্পনা করা যায় না।