ইয়াস ঘূর্ণিঝড় রচনা, Yaas Cyclone Essay in Bengali 

ইয়াস ঘূর্ণিঝড় রচনা

২০২১ সালে বাংলার উপকূল লক্ষ্য করে দাপটের সাথে ধেয়ে এসেছিল অতি ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’। এটি আন্দামান সাগরে তৈরি হওয়া একটি অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়। এই ঝড় প্রভাবিত অঞ্চলগুলো হল ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা; তাছাড়া বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়েছিল। 

ইয়াস ঝড়ের নামকরণ করেছে কোন দেশ, Which country named Yaas cyclone ?

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার সাইক্লোন সংক্রান্ত আঞ্চলিক সংস্থা,’ এসকাপ ‘এর তালিকা অনুসারে ওমান দেশ ‘ইয়াস’ নামটি প্রস্তাব করেছিল – যার অর্থ হল ‘হতাশা’। পারসি ভাষা থেকে উক্ত শব্দটি এসেছে। ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমার, ওমান, পাকিস্তান, কাতার, সৌদি আরব, শ্রীলঙ্কা-সহ ১৩টি দেশ নিয়ে গঠিত কমিটি এই নাম ঠিক করেছিল। 

ইয়াস ঝড়ের নামকরণ করেছে কোন দেশ

ইয়াসের তাণ্ডব আশঙ্কা করে আগাম সরকারি উদ্যোগ, Anticipating the rampage of Yaas, government initiatives

ইয়াস ঝড়ের তাণ্ডবে ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা ছিল বলে এই Super cyclone টি ধেয়ে আসার আগেই পূর্ব উপকূলবর্তী রাজ্যগুলিকে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে অবিলম্বে এই অঞ্চলগুলিতে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো তৈরি করে ফেলার নির্দেশ ও দেওয়া হয়েছে রাজ্যের মুখ্যসচিবদের নিকট।

ইয়াসের তাণ্ডব আশঙ্কা করে আগাম সরকারি উদ্যোগ

উপকূলে এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে করোনা সংক্রমণ লাফিয়ে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও ছিল। এর কারণ ছিল একই সঙ্গে ঝড়, বন্যার ফলে শিবিরে আশ্রয় দিতে হতে পারে বহু মানুষকে আর সেক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা সেই সময়ে খুবই কঠিন হয়ে পড়বে। সেজন্যই কেন্দ্র থেকে রাজ্যের মুখ্যসচিবদের কাছে নির্দেশ এসেছিল যাতে উপকূলবর্তী এলাকায় আগে থেকেই ‘হেলথ সেক্টর ইনসিডেন্ট কমান্ড সিস্টেম’, ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম চালু করে দেওয়া হয়।

তাছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার উদ্দেশ্য নিয়ে উপকূলবর্তী অঞ্চলে আগেই ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান তৈরি রাখতে বলা হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড় আসার পূর্বেই যেন উপকূলের বসতি থেকে স্থানীয় জনগণকে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যাওয়া হয় সেজন্য ডিএম প্ল্যান তৈরি করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন স্বাস্থ্যসচিব।

ঝড়ের মোকাবিলায় প্রস্তুতি ও প্রভাব, Jhorer mokabilay prostuti

ভারত

ভারতের কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রক ঝড়ের তান্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎ পরিষেবা পুনরুদ্ধার করার জন্য ট্রান্সফর্মার ও জেনারেটরের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। অন্যদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রক ভ্যাকসিন পরিপূরক ও কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় যাতে কোনও রকম বাধা না আসে তা নিশ্চিত করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।

এদিকে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রকও টেলিকম টাওয়ারগুলো ও এক্সচেঞ্জকে নজরদারীতে রেখেছিল। ঘূর্ণিঝড়টির জন্য প্রস্তুতি নিতে প্রধানমন্ত্রীও জরুরি বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। উপকূলবর্তী এলাকায় এনডিআরএফ ৬৫ টি দল মোতায়েন করা হয়, এছাড়াও ২০ টি রিজার্ভ দল ছিল। এসব ছাড়াও উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও উপকূলরক্ষী বাহিনীর দলসমূহ পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার উপকূলীয় জেলাসমূহে মোতায়েন করা হয়েছিল।

ঝড়ের মোকাবিলায় প্রস্তুতি ও প্রভাব

অন্যদিকে সাবধানতার সঙ্গে উত্তর রেল নতুন দিল্লি থেকে ভুবনেশ্বর ও পুরীগামী বেশ কিছু ট্রেন বাতিল করা হয় এবং পশ্চিম রেল ও দক্ষিণ রেল ওড়িশাগামী ও ওড়িশা থেকে যাত্রা করার ট্রেনসমূহ বাতিল রাখা হয়। 

বাংলাদেশ

বাংলাদেশ সরকার জরুরি প্রতিক্রিয়ার জন্য ১১৪ টি মেডিকেল দল মোতায়েন করে এবং ৩৪৯ টি আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করেছিল। কোভিড-১৯-এর স্বাস্থ্য বিধিনিষেধ বজায় রাখতে সেই আশ্রয়কেন্দ্রসমূহে জনগণের ধারণ সক্ষমতা অর্ধেক হিসেবে সমন্বিত করা হয়।

ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’-এর প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ, Extent of damage caused by Cyclone Yas

অনুমানের আগেই প্রবল শক্তিতে স্থলভূমিতে আছড়ে পড়েছিল ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। ২০২১ সালের ২৭ মে অর্থাৎ বৃহস্পতিবার স্থলভূমিতে ঝড়ের তান্ডব শুরু হবে বলে অনুমান করা হয়েছিল, কিন্তু বুধবার সকালেই উড়িষ্যার বালাসোরে হানা দেয় ঝড়ের তান্ডব, সাথে ছিল বৃষ্টির প্রবলতাও। ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’-এর স্থলভাগে আছড়ে পড়ার সময় সর্বোচ্চ বেগ ছিল ১৫৫ কিলোমিটার।

ঘূর্ণিঝড় 'ইয়াস'-এর প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ

তবে এই ঝড়ের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল ঘণ্টায় ১৮৫ কিলোমিটারের। কিন্তু পরিকল্পনা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার কম গতিতে ওড়িশা উপকূলে আছড়ে পড়েছিল অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’। ফলে তাণ্ডব চললেও ওড়িশায় বড়সড় ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়েছিল। তবে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে এবং উপকূলবর্তী একাধিক গ্রাম জলবন্দি হয়ে গিয়েছিল।

অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গেও ঘূর্ণিঝড়ের দাপট অনেকটাই কম ছিল ইয়াসের সাথে ভরা কোটালের যুগলবন্দিতে পূর্ব মেদিনীপুর এবং দুই ২৪ পরগনার উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ ও ভরা কোটালের ধাক্কায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল গঙ্গাসাগর, ফলে পার্শ্ববর্তী একাধিক এলাকায় জমে গিয়েছিল জল।

ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ ও ভরা কোটালের ধাক্কায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল গঙ্গাসাগর

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ফুঁসছিল সমুদ্র এবং নদী, যার জেরে বানভাসী হয়ে যায় বিভিন্ন এলাকা। দক্ষিণ ২৪ পরগনা উপকূলবর্তী একাধিক এলাকায় বাঁধ ভেঙে যায় এবং বেশ কিছু গ্রামে জল ঢুকে যায়। অন্যদিকে গঙ্গার জলস্তর বেড়ে গিয়ে বেলুড় মঠের মধ্যে জল ঢুকে যায়। তবে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারীরা বহু মানুষকে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়, এবং অনেকজনকে জলমগ্ন অঞ্চল থেকে উদ্ধার করে।

ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’-এর দাপটে ওড়িশায়ও দু’জনের মৃত্যু হয়। ওড়িশার বিশেষ ত্রাণ কমিশনার প্রদীপ জেনা জানিয়েছিলেন, “পূর্বাভাসের তুলনায় দুর্বলভাবে আছড়ে পড়ায় বড়সড় ক্ষতি এড়ানো গিয়েছে।” পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখার ফলে বেশ সহজেই উদ্ধার ও ত্রাণ কার্য পরিচালনা করা সম্ভব হয়েছিল।

 ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের তান্ডব শুরু হওয়ার আগেই সমুদ্রের ঢেউ মানুষের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করে দিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের দিঘার সমুদ্রে ৩০ ফুট উচ্চতায় ঢেউ উঠছিল, যার ফলে নদীর বাঁধ ভাঙার সম্ভাবনা ক্রমে বেড়ে গিয়েছিল, শেষ অবধি ঝড়ের কবলে পড়ে জলোচ্ছ্বাস আরো বেড়ে ওঠে এবং উপকূলবর্তী গ্রামে জল ঢুকতে শুরু করে।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের তান্ডব শুরু হওয়ার আগেই সমুদ্রের ঢেউ মানুষের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করে দিয়েছিল

বন্যা, Flood

ইয়াস ঘূর্ণিঝড়ের সাথে ভরা কোটালের যুগলবন্দি হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু অঞ্চলে বন্যা দেখা দেয়। বেশ কিছু বাড়িঘর জলে তলিয়ে যায়, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সেইসব অঞ্চল পরিদর্শন করে ত্রাণ ও ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া মানুষদের সাহায্যের ব্যবস্থা করেছিলেন। পূর্বাভাস অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়টি উড়িষ্যায় বালেশ্বরের দক্ষিণ এবং ধামরার উত্তরাঞ্চল দিয়ে আঘাত হেনেছিল। অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড়ের সাথে জলোচ্ছাসের প্রভাবে উড়িষ্যা ও পূর্ব মেদিনীপুর এলাকার ব্যাপক অংশ জলের নিচে চলে যায়। 

অন্যদিকে ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশের উপর তেমন প্রভাব ফেলেনি; তবে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, ভোলা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেলী, চাঁদপুর ও চট্টগ্রাম জেলায় ও এর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোতে ভারী ও অতি ভারী বর্ষণ হয়েছিল, সাথে ছিল ঝড় ও হাওয়ার প্রভাব। তবে আবহাওয়াবিদদের আশঙ্কা ছিল যে, ঘূর্ণিঝড় ইয়াস অতিক্রমকালে পূর্ণিমা থাকায় উপকূলীয় অঞ্চলে জোয়ারের জল বেড়ে গিয়ে আশেপাশের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। সেই আশঙ্কা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল বলে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। 

শেষ কথা, Conclusion

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের তীব্রতা অনুমানের তুলনায় কম হলেও এর সাথে ভরা কোটালের প্রভাব থাকায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছিল, নাহলে কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকার মিলিত ভাবে যে সব ব্যবস্থা নিয়েছিল তাতে হয়তো ঝড়ের কবলে পড়ে কারও প্রাণহানি হতো না বরং সহজেই এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলা করা সম্ভব হত।

প্রতিবছরই এমন একটি ঘূর্নিঝড় এপার বাংলা তথা ওপার বাংলার বুকে থাবা বসায় এবং বহু মানুষের ক্ষতি করে, প্রাণহানি ঘটায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে কেউ চাইলেও আটকাতে পারবে না, কিন্তু নিজেকে এইরূপ দুর্যোগ থেকে দূরে রাখার ব্যবস্থা অবশ্যই করা সম্ভব। তাই আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী সকলেরই সাবধান হয়ে যাওয়া উচিত। যাতে এইরূপ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকা যায়।

Oindrila Banerjee

Oindrila Banerjee, a master's graduate in Modern History from Calcutta University, embodies a diverse range of passions. Her heart resonates with the rhythm of creative expression, finding solace in crafting poetic verses and singing melodies. Beyond her academic pursuits, Oindrila has contributed to the educational realm, serving as a teachers' coordinator in a kindergarten English medium school. Her commitment to nurturing young minds reflects her belief in the transformative power of education. Oindrila's guiding principle in life, encapsulated in the motto, "There are two ways of spreading light: to be the candle or the mirror that reflects it,"

Recent Posts