শৈশবে বা কৈশোরকালে মানুষ কত কিছুই স্বপ্ন দেখে তার সবকিছু কি সার্থক হয় ! কারও ক্ষেত্রে হয়, আবার কারো হয় না। আবার অনেকের ক্ষেত্রে এমনটাও হয় যে, ছোটবেলা যে স্বপ্ন ছিল বড় হতে হতে তা বদলে অন্য কোনো স্বপ্ন মনে জায়গা করে নিয়েছে। তবে সকলে নিজের লক্ষ্য বা স্বপ্ন পূরণে সফলতা অর্জন করতে পারে না।
তবুও সব মানুষেরই স্বপ্ন থাকে, আর থাকাটা দরকার। শৈশব থেকেই জীবনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য একটি বিশেষ লক্ষ্য থাকা উচিত। তোমার জীবনের লক্ষ্য তোমাকে নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি সেই লক্ষ্য পূরণের চেষ্টা থাকাও জরুরী। আমাদের সকলেরই মনে রাখতে হবে, ‘সংসার সিন্ধুতে ধ্রুবতারা সমস্থির লক্ষ্য চাই, লক্ষ্যবিহীন জীবনতরণী কূল নাহি কভু পায়।’
জীবনে লক্ষ্য স্থির করা কেন জরুরি, Why is it important to set goals in life?
জীবনে সার্থকতা পেয়ে দৃঢ় সংকল্প থাকা জরুরি। তবে শুধু লক্ষ্য স্থির করলেই শেষ নয়, সেই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কাজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে তোমাকে মানব জমিনে সোনা ফলাতে হবে, যার জন্য যথাসময়ে বীজ বপন এবং আনুষঙ্গিক পরিশ্রম ও সাধনার প্রয়োজন। জীবনের উদ্দেশ্যকে সার্থক করে তুলতে প্রয়োজন একনিষ্ঠ শ্রমের।
ইংরেজি প্রবাদে বলা হয়েছে, ‘An aimless life is like a boat without a rudder.’ অর্থাৎ জীবনে এগিয়ে হওয়ার পথে নির্দিষ্ট এবং সুপরিকল্পিত পথরেখা থাকা জরুরি। সেই পথরেখাই আমাদেরকে সফলতার তোরণ-দুয়ারে নিয়ে যাবে। তাই জীবনে নির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করা উচিত।
জীবনের লক্ষ্য অনুযায়ী পাঠক্রম নির্বাচন, Selection of courses according to life goals
ছাত্রজীবন হল যেকোনো মানুষের পরিণত-জীবনের প্রস্তুতিপর্ব। সেজন্য ছাত্রাবস্থাতেই জীবনের লক্ষ্য স্থির করে নেওয়া উচিত এবং সেই লক্ষ্যকে সমানে রেখেই শ্রম, নিষ্ঠা, অধ্যবসায় ও একাগ্রতার সাথে জীবনে অগ্রসর হতে হয়।
ভিন্ন মানুষের কর্মজীবন বিকশিত হয় বিচিত্র পথে। কোনো ব্যক্তি পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারে সরকারি কোনো চাকরি, কেউ হতে চায় আইনজ্ঞ, কেউ প্রকৌশলী, কেউ-বা ব্রতী হন শিক্ষকতার পেশায়, কেউ-বা এগিয়ে আসে কৃষি উন্নয়ন সংক্রান্ত কাজের দিকে। তবে বড় হয়ে যে যাই হতে চায় না কেন, ছাত্রদের ক্ষেত্রে বৃত্তি নির্বাচন করা অনেকাংশে শারীরিক সামর্থ্য, শিক্ষাগত, আর্থিক স্বচ্ছলতা ও উপযুক্ত পরিবেশের উপর নির্ভর করে।
অনেক ক্ষেত্রে এমনও হয় যে বিশেষ বৃত্তি বা পেশা গ্রহণ করার জন্য সুনির্ধারিত কোনো পাঠক্রম অধ্যয়ন করার প্রয়োজন হয়। তাই জীবনের লক্ষ্য স্থির করার পাশাপাশি সেই লক্ষ্য অনুযায়ী পাঠক্রমও ঠিক করতে হয়।
পাঠক্রম নির্বাচন করার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। একজন ছাত্রের যে বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে তাকে সেই বিষয় নিয়েই পড়াশুনা করতে দেওয়া যুক্তিসংগত। তবে অধ্যয়ন মূলক বিষয়গুলোর প্রতি কেবল আগ্রহ থাকলেই চলবে না, সেই বিষয়গুলো নিতে পড়াশুনা করার মধ্য দিয়ে জীবনের লক্ষ্যকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে।
আমার জীবনের লক্ষ্য, My aim in life
ছেলেবেলা থেকে আমার জীবনের একটি লক্ষ্য যে আমি একজন সুদক্ষ কৃষক হব। আমার লক্ষ্য জেনে প্রথমে অনেকেই উপহাস করতেন। আবার অনেকে আমার এই লক্ষ্যকে সামান্য এবং দীন বলে মনে করতেন, আমি তাদের দোষ দিই না, কারণ এমন চিন্তাধারা রাখা তাদের দোষ নয়, দোষ হল তাদের দৃষ্টির সংকীর্ণতার। তবে পারিপার্শিক বিভিন্ন বিষয় মূল্যায়ণ করে বুঝতে পারা যায় যে উন্নত বিশ্ব ও কৃষির উন্নয়নের সাথে জড়িত দেশ ও জাতির উন্নয়ন।
এখনো কৃষক শব্দ শুনলে বেশিরভাগ মানুষই দেশের গতানুগতিক ধারার মান্ধাতার আমলের সেই কৃষকদেরকে মনে করে, যাদের কোনো শিক্ষা নেই, আধুনিকতার সাথে কোনো পরিচয় নেই, ঠিক ভাবে দুই বেলা দুই মুঠো খাবার পেট ভরে খাওয়ার মতও অবস্থা নেই, আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই তাদের কথা। কিন্তু আমি সেই রকম কৃষক হওয়ার কথা ভাবিনি। বরং আমি বর্তমানের আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে একজন শিক্ষিত, সুদক্ষ, বিজ্ঞাননির্ভর প্রগতিশীল কৃষক হতে চাই।
আমাদের বিশ্বের উন্নত দেশগুলো আজকের সময়ে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রথা অবলম্বন করে চাষ-আবাদ করার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে নিয়ে এসেছে বিপুল পরিবর্তন। আর এই উন্নতি সেইসব দেশের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করেছে। তাইতো উন্নত দেশগুলোতে দারিদ্রতা নেই বললেই চলে। ঠিক ওইভাবেই আমিও আমার দেশের জমিকে সোনার ফসলে ভরে দিতে চাই।
আমি চাই আমার এই দেশ থেকে দরিদ্রতার অভিশাপ যেন সরে যায়। আমি একজন সুদক্ষ কৃষক হয়ে ঘটাতে চাই কৃষিবিপ্লব। বঙ্কিমচন্দ্রের অবিস্মরণীয় পংক্তিগুলোর মধ্য দিয়ে আমার লক্ষ্যের মর্ম ব্যাখ্যা করতে বলা যায়, “দেশের মঙ্গল কাহার মঙ্গল?/ তোমার আমার মঙ্গল দেখিতেছি, কিন্তু তুমি আমি কি দেশ? /তুমি আমি দেশের কয়জন? /আর এই কৃষিজীবী কয়জন? /তাদের ত্যাগ করিলে দেশে কয়জন থাকে? / হিসাব করিলে তাহারাই দেশ-দেশের অধিকাংশ লোকই কৃষিজীবী।”
কৃষক হওয়ার লক্ষ্য স্থির করার নেপথ্যে কারণ, Reasons behind setting the goal of becoming a farmer
আমার অন্যান্য সহপাঠীদের ক্ষেত্রে কেউ ডাক্তার হতে চায়, কেউ আবার ইঞ্জিনিয়ার, কেউ হতে চায় ম্যাজিস্ট্রেট, কেউ-বা অর্থনীতি সংক্রান্ত কাজের দিকে আকৃষ্ট। সকলের ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করে দেখলাম যে চাকরিকেই নিজের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে স্থির করেছে সবাই। আমাদের দেশে চাকরিপ্রিয়তা খুব বৃদ্ধি পেয়েছে, পাশাপাশি সকলের মধ্যে কৃষি বিমুখতা দেখা দিয়েছে, অথচ একটা সময় ছিল যখন বেশিরভাগ মানুষেরই কর্মসংস্থান এবং আয়ের পথ ছিল কৃষি।
এক কথায় বলতে গেলে কৃষি ছিল আমাদের দেশের অর্থনীতির মূল উৎস। কিন্তু এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে আজকের যুব সমাজ এই কৃষিকাজকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে নারাজ। আমি মনে করি যে এটা আমাদের কর্তব্য দেশকে উন্নতির পথে নিয়ে যাওয়া এবং কৃষি ব্যবস্থাকে আরো শ্রীসম্পন্ন অবস্থায় নিয়ে যাওয়া। কবিগুরুর কথায় বলতে গেলে,
‘ফিরে চল ফিরে চল মাটির টানে’। আমি এই কথাগুলোর মত মাটির কোলেই ফিরে যেতে চাই।
কৃষক হওয়ার লক্ষ্যের সাথে দেশের অবস্থার যোগসূত্র, Linkage of country status with goal of becoming a farmer:
আজকের সময়ে আমাদের দেশ শিল্পবিধ্বস্ত, কৃষি ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্দশাগ্রস্ত। ক্ষমতার চাইতে অতিরিক্ত উৎপাদন করে দেশের কৃষি আজ সর্বস্বান্ত। তাছাড়া কৃষকদের মধ্যে শিক্ষার অভাব তথা বিভিন্ন কৃষি পদ্ধতি সম্পর্কে অজ্ঞতা থাকার কারণে তারা সঠিকভাবে ফসল উৎপাদন করতে অক্ষম হয়ে পড়েন। সঠিক পদ্ধতি জানা থাকলে অল্প জমিতেও বেশি ফসল উৎপন্ন করা যায়, কিন্তু কৃষকেরা এসব নিয়ে বিভিন্ন তথ্য জানেন বা বলে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করে ফসল তথা মাটির ক্ষতি করছেন।
উন্নত সারের ব্যবহার সম্পর্কে আজও তাদের মধ্যে অনেকেই অজ্ঞ। উন্নত বীজ সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে এখনও তাদের উদাসীনতা রয়ে গেছে। একথা অস্বীকার করার নয় যে কৃষকদের উন্নতি ব্যতীত কৃষিপ্রধান এই দেশের সামগ্রিক উন্নতি সম্ভব নয়। তাই আমি মনে করি যে কৃষকদের কৃষি সংক্রান্ত সকল জ্ঞান থাকা জরুরী এবং আমি এই বিষয়ের সকল জ্ঞান অর্জন করে কৃষির উন্নতির মাধ্যমে দেশকেও উন্নতির পথে নিয়ে যেতে চাই।
উপসংহার, Conclusion
যেকোনো দেশের সমৃদ্ধি সাধনার মূল চাবিকাঠি হল কৃষিসাধনা। কৃষিই দেশের উন্নয়নের রুদ্ধদ্বার খুলে দিতে পারবে। দরিদ্রতা মিটিয়ে মানুষের মুখে হাসি ফোটাবে। যদি একজন সুদক্ষ কৃষক হওয়ার ক্ষেত্রে আমার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি না থাকে তবে আমার বিশ্বাস যে আমি এ বিষয়ে নিশ্চয়ই সফল হব। কৃষি ক্ষেত্রে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় উন্নত যন্ত্র ব্যবহার করে আমি কৃষকদেরকে কম পরিশ্রম করেও বেশি ফসল উৎপাদনের ব্যবস্থা করে দিতে চাই।