ছয়টি ঋতুর মধ্যে বছরের প্রথম ও সবচেয়ে উষ্ণতম ঋতু হল গ্রীষ্মকাল। এই সময় সূর্যের তাপ এত প্রখর হয় যে চারিদিক রুক্ষ ও শুষ্ক হয়ে ওঠে। অনেকের কাছেই গ্রীষ্মের অনুভূতি তেমন মনোরম বলে মনে হয় না। কিন্তু মনোরম না হলেও গ্রীষ্মকাল নানা বৈচিত্র্যে বৈচিত্রময়। সর্বোপরি প্রকৃতির কাছে এই গ্রীষ্মের দান অনেক। এই ঋতুর এমন বহু বৈশিষ্ঠ আছে যার কারণে গ্রীষ্ম ঋতু আমার ভালো লাগে।
গ্রীষ্মকালের সময়সীমা, Summer term
বাংলা বছরের প্রথম ঋতু হল গ্রীষ্মকাল। গ্রীষ্মের সাথেই বছরের বারো মাসের প্রথম মাস শুরু হয়। বৈশাখ ও জৈষ্ঠ্য এই দুই মাস নিয়ে হয় গ্রীষ্মকাল এবং এই ঋতু ইংরেজি এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে মে মাস পর্যন্ত বিরাজ করে। এই সময় সূর্যের উত্তরায়ণ ঘটে, আর আমাদের দেশ পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে আছে, যার ফলে দেশের বিভিন্ন অংশের উষ্ণতা ক্রমশ বাড়তে থাকে।
![গ্রীষ্মকালের সময়সীমা](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2023/12/summ3.jpeg)
গ্রীষ্মের রূপ বর্ণনা, description of Summer
গ্রীষ্মকালে সূর্য তার তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়াতে থাকে। সূর্যের তাপ যেন পুকুর, ডোবা, নদী, খাল বিলের জল শুষে নিতে থাকে। অসহ্য গরমে ও জলের অভাবে মানুষ সহ অন্যান্য প্রাণীরা প্রচণ্ড কষ্ট পায়। মানুষ দুপুরে বাইরের কাজে বেশি পরিশ্রম করতে পারে না, কৃষকেরা মাঠ ছেড়ে ছায়ায় আশ্রয় নেয়। গ্রীষ্মের রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে জীবনানন্দ দাশের কবিতা মনে পড়ে যায়, তিনি লিখেছেন –
“ আকাশে মন্থর মেঘ, নিরালা দুপুর!
-নিস্তব্ধ পল্লীর পথে কুহকের সুর
বাজিয়া উঠিছে আজ ক্ষণে ক্ষণে ক্ষণে!
সে কোন পিপাসা কোন ব্যথা তার মনে!
হারায়েছে প্রিয়ারে কি?- অসীম আকাশে
ঘুরেছে অনন্ত কাল মরীচিকা-আশে?
বাঞ্ছিত দেয়নি দেখা নিমেষের তরে! “
![গ্রীষ্মের রূপ বর্ণনা](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2023/12/summ4-1024x681.jpg)
সত্যিই তো গ্রীষ্মের দুপুরগুলো কত নিরালা হয়, রোদের তাপে সহজে কেউ ঘর থেকে বের হয় না, দূর থেকে ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে ওঠে। এ ঋতুতে দিন বড় আর রাত ছোট হয়। পশ্চিমা মৌসুমি বায়ু এ সময় দেশের উপর দিয়ে বইতে শুরু করে। অন্যদিকে পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে প্রবাহিত হয় শীতল ও শুষ্ক বায়ু। সাথে মাঝে মাঝেই ধেয়ে আসে কাল বৈশাখী।
মহাসাগর থেকে আগত মেঘতাড়িত বায়ুপ্রবাহের সঙ্গে শীতল ও শুষ্ক বায়ু মুখোমুখি পরস্পরের সংস্পর্শে এসে প্রবল ঝড়ের রূপ ধারণ করে। ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের দুটি বায়ুপুঞ্জ দ্বারা সৃষ্ট ঝড়কেই কালবৈশাখী নামে আখ্যায়িত করা হয়, এর ধ্বংসাত্মক রূপ ভূখন্ডের অধিবাসীদের কাছে অতি আতঙ্কের। তবে আতঙ্কের হলেও দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টির অপেক্ষা করে থাকে বহু মানুষ; কৃষকেরা রোদের তাপে চৌচির হয়ে যাওয়া জমির আদ্রতা ফিরে পেতে আশা করে থাকে বৃষ্টির, অন্যদিকে গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে একটু স্বস্তি পাওয়ার আশায় বসে বৃষ্টির কামনা করে।
গ্রীষ্মকাল শুরু হওয়ার সময় থেকেই কালবৈশাখীর দেখা পাওয়া যায়, এছাড়াও এই ঋতুর সময়কাল জুড়ে হঠাৎ হঠাৎ হালকা বৃষ্টি এসে ভূপৃষ্ঠকে ঠাণ্ডা করে দিয়ে যায়। কিন্তু তাও কেনো জানিনা আমার গ্রীষ্মকাল খুব ভালো লাগে, এসময় দুপুরে স্নান সেরে ঘরে বসে বাড়ির সবাই মিলে গল্প করে, লুডো খেলে সময় কাটানোর মুহূর্তগুলো কত যে স্মৃতি তৈরি করে।
গ্রীষ্মে ফোটা ফুল, flowers that bloom in summer
গ্রীষ্মকালে গাছে গাছে কত যে ফুল ফুটে। ফুল গাছ হোক কিংবা ফল গাছ, প্রায় সকল গাছই ভরে ওঠে রং বেরংয়ের ফুলে। অর্জুন, ইপিল ইপিল, কনকচূড়া, করঞ্জা, কামিনী, ক্যাজুপুট, গাব, জারুল, জ্যাকারান্ডা, তেলসুর, দেবদারু, নাগকেশর, নাগেশ্বর, নিম, পরশপিপুল, পলকজুঁই, পাদাউক, পারুল, পালাম, বনআসরা, বরুণ, বাওবাব, বেরিয়া, মাকড়িশাল, মিনজিরি, মুচকুন্দ, মেহগনি, রক্তন, সোনালু, স্বর্নচাঁপা ইত্যাদি ফুল গ্রীষ্মের প্রকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। এইসব ফুলের মধ্যে আমার স্বর্নচাঁপা খুব পছন্দ, কারণ এটি দেখতে যেমন সুন্দর এর সুগন্ধ তেমনি ছড়িয়ে থাকে চারপাশে।
![গ্রীষ্মে ফোটা ফুল](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2023/12/summ6.jpeg)
গ্রীষ্মকালীন ফল, summer fruits
গ্রীষ্মের শেষ দিকে গেছে গেছে ঝুলে থাকে সুস্বাদু রসালো ফল। আম, জাম, জামরুল, কাঁঠাল, আনারস, পেয়ারা, লিচু, তরমুজ, আমড়া প্রভৃতি ফল। গ্রীষ্মকাল ফলের ঋতু, তাইতো বাজারে হাটে ফল বিক্রেতাদের মধ্যেও ব্যস্ততা দেখা যায়। গ্রীষ্মকালে গরম পরিবেশ হওয়ার কারণে ঘাম হয় বেশি, তাই দেহে প্রয়োজনীয় খনিজ ও পুষ্টিকর উপাদানের ঘাটতি মেটাতে সকলেই কম বেশী রসে পূর্ণ ফল তথা ফলের রস পান করতে আগ্রহী থাকে।
![গ্রীষ্মকালীন ফল](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2023/12/summ2.jpeg)
গ্রীষ্মের ফলগুলোর মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় ফল হল আম, কারণ আম কাঁচা এবং পাকা দুই অবস্থায় খাওয়া যায়। বিকেলে বাড়ির সবাই মিলে বারান্দায় বসে কাঁচা আম দিয়ে তৈরি ভর্তা খাওয়ার মজাই আলাদা। তবে পাকা আমও খেতে খুব ভালো লাগে আমার।
গ্রীষ্মের পার্বণ, summer festivals
গ্রীষ্মের শুরুই হয় পার্বণের মধ্য দিয়ে। বাংলা বর্ষ গ্রীষ্ম দিয়েই শুরু হয়। গ্রীষ্মের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখ অর্থাৎ বাংলা নববর্ষের-এর প্রথম দিন হিসেবে উদযাপিত হয়। এছাড়াও এ ঋতুতে হিন্দুরা জামাইষষ্ঠীসহ আরো বেশ কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। বাড়িতে সবাই মিলে আনন্দের সাথে এইসব অনুষ্ঠান- আচরণ পালন করে।
বিশেষত পহেলা বৈশাখ এর কথা বলতে গেলে, এই সময় বহু পরিবার একসাথে উৎযাপন করার সুযোগ পায়, এমনও আছেন যারা একই পরিবারের হলেও সারা বছর ধরে দেখা করার সুযোগ পায় না, কিন্তু নববর্ষের শুভদিন একসাথে কাটায়। এই বিষয়টা খুব ভালোলাগে আমার। এছাড়াও গ্রীষ্মকালে বাঙালির শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। বৈশাখ মাসের ২৫ তারিখে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন পালন করা হয় যা শুধু বাংলারই নয় সমগ্র ভারতের অন্যতম উৎসব। অন্যদিকে গ্রীষ্মের প্রথম দিক থেকেই গ্রামে গ্রামে বৈশাখী মেলা বসে।
![গ্রীষ্মের পার্বণ](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2023/12/summ5.jpeg)
গ্রীষ্মের উপকারিতা, positive sides of summer season
আমার মতে গ্রীষ্মকালের সবচেয়ে উপকারী দিক হল এসময় দিন বড় হয়, যার হওয়ার কারণে মানুষের হাতে অনেক সময় থাকে, ফলে মানুষ তাড়াহুড়ো না করে আস্তে – ধীরে বিশ্রাম নিয়েও অনেক কাজ করতে পারে। এছাড়া গ্রীষ্মকালে প্রচুর সবুজ শাকসবজি ও ফলমূল পাওয়া যায়, আর শাকসবজি খাওয়ার ফলে আমাদের দেহ পুষ্টি পায়, এবং সুস্বাস্থ্য বজায় থাকে। অন্যদিকে এই ঋতু ভ্রমণের জন্য একদম সঠিক। গ্রীষ্মের মরশুমে বিদ্যালয়ের গ্রীষ্মকালীন ছুটি থাকে, তাই এসময় অনেকে পরিবারের সাথে সমুদ্র সৈকতে বা পাহাড়ে বেড়াতে যান।
বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে গ্রীষ্মের রূপ পরিবর্তন, nature of Summer season changes due to global warming
গ্রীষ্মের এত কিছু ভালো বিষয় নিয়ে আলোচনা করলেও এই ঋতুর কিছু খারাপ দিকও রয়েছে। ইদানিং কালে সকলেই হয়তো লক্ষ্য করেছেন যে গ্রীষ্মকালের উত্তাপ পূর্বের তুলনায় অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ক্রমে এটি আমাদের বায়ুমণ্ডল ও ভূপৃষ্ঠকেও উত্তপ্ত করে তুলছে। গ্রীষ্মকালে প্রচণ্ড রোদের তাপ থাকার কারণে মানুষ সহ বিভিন্ন প্রাণীরা প্রচণ্ড গরমে কষ্ট অনুভব করে। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড উত্তাপে এসময় খালবিল, নদীনালা সব শুকিয়ে যায়। চারিদিক দেখা দেয় জল সংকট। এছাড়াও জলের অভাবে চাষ আবাদেও বেশ ক্ষতি হয়। তাই কবি সুকুমার রায় তাঁর কবিতায় লিখেছেন,
“ঐ এল বৈশাখ, ঐ নামে গ্রীষ্ম, খাইখাই রবে যেন ভয়ে কাঁপে বিশ্ব!”
অন্যদিকে এই সময় মশা মাছির উৎপাতও বেড়ে যায়, যার ফলে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, কলেরা প্রভৃতি রোগ হওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ে। তাছাড়া গ্রীষ্মকালে বৈশাখ মাসে প্রায়দিনই বিকালে কাল বৈশাখী ঝড় হয়, যার কারণে ঘরবাড়ি নষ্ট হয় তথা জীবনহানিও ঘটে। তবে একটা ব্যাপার লক্ষ্যনীয় যে এখনকার সময়ে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে গ্রীষ্মে গরম তথা রোদের তাপে অসহনীয়তা ক্রমে বেড়ে উঠছে।
![বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে গ্রীষ্মের রূপ পরিবর্তন](https://okbangla.com/wp-content/uploads/2023/12/summ7.jpeg)
তাছাড়া চারদিকে দূষণ যেভাবে বাড়ছে এর ফলে আবহাওয়া পরিবর্তনেও প্রভাব পড়ছে, যার ফলস্বরূপ পূর্বের সময়ের মত গ্রীষ্মকাল উপভোগ করা সম্ভব হয় না, বরং এখন গ্রীষ্মকালের তাপ প্রবাহের দাপট এই ঋতুর মাধুর্য্যকে ম্রিয়মাণ করে দেয়। তাই বলা যায় যে আজকের সময়ে গ্রীষ্মকাল উপভোগ করা কঠিন, আমাদের কাছে এই ঋতু যেন এক অভিশাপ স্বরূপ।
উপসংহার, Conclusion
গ্রীষ্মকালের তাপ এবং দাবদাহ কষ্ট দিলেও একটা কথা বলতেই হয় যে, গ্রীষ্মকালের জন্যই আমরা বর্ষাকাল ও শীতকালের আমেজ অনুভব করতে পারি। তাছাড়া গ্রীষ্ম ঋতু বয়ে আনে রং ও প্রাণের বাহার তাই তো কবিগুরুর কথায় বারবার প্রতিবার বলবো “এসো হে বৈশাখ এসো এসো”।