খেজুর, মধ্যপ্রাচ্যের একটি ফল, যা অত্যন্ত সুস্বাদু ও স্বাস্থের জন্য উপকারী উপাদান হিসেবে পরিচিত। খেজুরে রয়েছে বেশ কিছু পুষ্টি উপাদান যা আমাদের শরীরের জন্য অতীব প্রয়োজনীয়। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা খেজুর খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
খেজুরের পুষ্টিগুণ কতটুকু? What is the nutritional value of dates?
খেজুর বিভিন্ন ভিটামিনের উৎস, তবে ভিটামিনের পাশাপাশি খেজুরে আছে ফাইবার এবং পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, কপার এবং সেলেনিয়ামের মতো খনিজ পদার্থ। যদিও খেজুরে প্রচুর পরিমাণে শর্করা থাকে – প্রাথমিকভাবে গ্লুকোজ এবং ফ্রুক্টোজ, তবে এতে ফ্যাট এবং সোডিয়াম কম থাকে।
খেজুরে কোন ভিটামিন থাকে? Vitamins that dates contains
খেজুরে অল্প পরিমাণে ভিটামিন সি এবং ভিটামিন বি(1) থায়ামিন, বি(2) রিবোফ্লাভিন, নিকোটিনিক অ্যাসিড (নিয়াসিন) এবং ভিটামিন এ সহ কমপক্ষে ছয়টি ভিটামিন রয়েছে।
খেজুর খাওয়ার উপকারিতা, Benefits of eating dates
মস্তিষ্কের স্মৃতি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি থেকে শুরু করে কর্মশক্তি বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো, দৃষ্টিশক্তি প্রখর রাখা, পেশির সমস্যা দূর করা, হৃদ্রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কম করা, হিমোগ্লোবিনের অসামঞ্জস্যতা দূর করা ইত্যাদি বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা থেকে দূরে রাখে খেজুর। এছাড়াও খেজুরের সেবন করলে হজমে সমস্যা, ডায়াবেটিস, হাড় ক্ষয়, ত্বকের নানা সমস্যা হওয়ার প্রবণতা দূর হয়। এক কথায় আমাদের দেহের বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে একটি দামি অস্ত্র হতে পারে খেজুর। জেনে নিই এই ফলটি আমাদের শরীরে কীভাবে কাজ করে :
কর্মশক্তি বৃদ্ধি করে :
খেজুরে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক চিনি থাকে, যার কারণে খেজুর খুব দ্রুত শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। অনেকেরই বয়স বৃদ্ধির কারণে ঝিমুনি ভাব দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে প্রতিদিন ৩টি খেজুর খেতে পারেন। তবে ক্লান্তি আপনাকে ঘিরে ধরতে পারবে না।
স্নায়ুতন্ত্রের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি :
খেজুর ভিটামিনে পরিপূর্ণ, তাই এটি মস্তিষ্কের চিন্তাভাবনার গতি বৃদ্ধি করে, পাশাপাশি স্নায়ুতন্ত্রের কর্মক্ষমতাও বাড়ায়। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, ছাত্রছাত্রীর যদি নিয়মিত খেজুর খায় তবে তাদের পড়াশুনা মনে রাখার দক্ষতা অন্যদের তুলনায় ভালো থাকে। এছাড়া কম বয়স থেকেই নিয়মিত খেজুর সেবন করলে বেশি বয়সে সহজে স্মৃতিশক্তি লোপ পায় না।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় :
খেজুর যকৃতের সংক্রমণ দূর করতে উপকারী ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়াও কখনই গলাব্যথা, জ্বর, সর্দি হলে, সেই সমস্যা সমাধানেও খেজুর উপকারী। অ্যালকোহলজনিত বিষক্রিয়ায় খেজুর বেশ উপকারী। দেহে কোনো ধরনের বিষক্রিয়া দূর করতে ভেজানো খেজুর খেলে দ্রুত কাজ করে। এ ছাড়া নিয়মিত খেজুর খাওয়ার অভ্যাসে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।
পেশী মজবুত রাখতে সাহায্য করে :
বয়সের সঙ্গে পেশির নানান জটিলতা দেখা দেয়। পেশির জটিলতা এড়াতে ভালো কাজ করে প্রোটিন, আর খেজুর প্রোটিন সমৃদ্ধ হয় বলে এটি আমাদের পেশি ভালো রাখতে সহায়তা করে। পাশাপাশি শরীরের জন্য অপরিহার্য প্রোটিনও সরবরাহ করে থাকে।
হাড়ের সুরক্ষায় খেজুর উপকারী :
আমরা সকলেই জানি যে ক্যালসিয়াম হাড় গঠনে সহায়ক, আর খেজুরে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম থাকে, যা হাড়কে মজবুত করে রাখতে সহায়তা করে। সেই সঙ্গে দাঁতের মাড়ির স্বাস্থ্যও সুরক্ষিত রাখে।
হৃদ্রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাস :
আজকাল বয়স বাড়ার সঙ্গে হৃদ্রোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকিও বেড়ে যাচ্ছে। এমনকি কম বয়সের মানুষও এই সমস্যায় ভুগছে। এই ঝুঁকি কম করতে পারে খেজুর। খেজুরে থাকে পটাশিয়াম, যা হৃদ্রোগ প্রতিরোধ করতে সহায়ক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কম করে। তাছাড়া, খেজুর খেলে শরীরের খারাপ ধরনের কোলেস্টেরলওর কম হয়ে যায় (এলডিএল) এবং ভালো কোলেস্টেরলের (এইচডিএল) পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
দৃষ্টিশক্তি প্রখর করতে সহায়ক :
খেজুরে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন রয়েছে, যা আমাদের শরীরের পাশাপাশি চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতেও অত্যাবশ্যক। যেমন: বি১, বি২, বি৩ এবং বি৫। এ ছাড়া ভিটামিন A1 এবং C সহ নানা ভিটামিনের উপস্থিতির জন্য খেজুরকে ভিটামিনের শক্তিঘরও বলতে পারেন। খেজুর দৃষ্টিশক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি রাতকানা রোগ প্রতিরোধেও কার্যকর ভূমিকা পালন করে। তাই চোখের সমস্যা থেকে দূরে থাকতে খেজুর খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন।
হিমোগ্লোবিনের সামঞ্জস্যতা বজায় রাখতে সহায়ক :
খেজুরে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকে, যা শরীরে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধি করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কারও শরীরে রক্তাল্পতা দেখা দিলে অথবা কখনও হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি হলে খেজুর খাওয়া উচিত, এতে শরীরের আয়রনের মাত্রা বজায় থাকবে এবং হিমোগ্লোবিনের মাত্রা স্বাভাবিক হবে পাশাপাশি রক্তের কোষও বৃদ্ধি পাবে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে :
ডায়বেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে চিনি খাওয়া নিষেধ হয়, কিন্তু অনেকেই মাঝে মধ্যে মিষ্টি জাতীয় খাবার খেতে পছন্দ করেন, সেক্ষেত্রে খেজুরের মিষ্টতা চিনির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
পরিপাকে সহায়তা ও হজমশক্তি বৃদ্ধি :
বয়স বাড়ার সাথে আমাদের হজমশক্তি কম হতে শুরু করে। তাই খেজুর খাওয়ার অভ্যাস রাখা উচিত, যাতে হজমশক্তি ঠিক থাকে; কারণ, অন্ত্রের কৃমি ও ক্ষতিকারক পরজীবী প্রতিরোধে খেজুর উপকারী ভূমিকা পালন করে। খেজুরে এমন সব পুষ্টিগুণ রয়েছে, যা খাদ্য পরিপাকে সহায়তা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্যও রোধ করে।
ত্বকের যত্ন নিতে খেজুরের ভূমিকা :
বয়সের ছাপ ত্বকেই ধরা পড়ুক এটা অনেকেই চান না, তাই ত্বকের যত্নে খেজুরকে কাজে লাগাতে পারেন। নিয়মিত খেজুর খাওয়ার অভ্যাস করলে ত্বককে শুষ্কতার হাত থেকে বাঁচাতে পারবেন। এছাড়া ত্বকের নানা সমস্যা থেকেও মুক্তি দেয় খেজুর। অন্যদিকে ত্বকের বলি রেখা নিয়ন্ত্রণ করতেও খেজুর সিদ্ধহস্ত। এসব ছাড়াও ত্বকের ফ্যাকাশে ভাব তথা হরমোন সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা কম করতেও খেজুর কার্যকর।
সকালে খালি পেটে খেজুর খেলে যে উপকার পাওয়া যায়, Benefits of eating dates on an empty stomach in the morning
- কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
- মস্তিষ্ক সচল রাখে
- ওজন নিয়ন্ত্রণ
- গর্ভবতী নারীদের জন্য উপকারী
- হিমোগ্লোবিন বাড়ায়
- ত্বককে টানটান করে
- হার্টের সমস্যা দূর করে
- খুসখুসে কাশি দূর করে
- ক্যান্সার প্রতিরোধ করে
- চুলের গোড়া মজবুত করে
খেজুর খাওয়ার সঠিক সময়, Ideal time to eat dates
- সারা রাত ভিজিয়ে রেখে সকালে খেজুর খেতে পারেন।
- রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে খেজুর খাবেন।
- ওয়ার্কআউটে করতে যাওয়ার ৩০ থেকে ৬০ মিনিট আগে দুটি-চারটে খেজুর খাওয়া যেতে পারে।
খেজুর খাওয়ার অনুপযুক্ত সময়, Inappropriate time to eat dates
- বদহজমের প্রবণতা থাকলে।
- খাবার খাওয়ার পর খেজুর খাবেন না।
- ডায়েরিয়ার সমস্যা থাকলে খেজুর খাওয়া উচিত নয়।
- খেজুরে অ্যালার্জি, ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম ও সেন্সিটিভিটির সমস্যা থাকলে খেজুর না-খাওয়াই উচিত।
রাতে ঘুমানোর আগে খেজুর খেলে কি হয়? What happens if you eat dates before going to bed at night?
এটি শরীর সুস্থ রাখতে খুবই সাহায্য করে। রাতে ঘুমানোর আগে দুধের সঙ্গে খেজুর মিশিয়ে খেলে মানসিক প্রশান্তি আসে। তার পাশাপাশি ঘুম ভালো হয়। এতে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা অনেক খানি বাড়ে।
সবচেয়ে পুষ্টিকর খেজুর কোনটি? Which is the most nutritious date?
গবেষকদের মতে শুকনো খেজুরের মধ্যে মরিয়ম খেজুর সবচেয়ে বেশি উপকারী ও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন।
প্রতিদিন কত গ্রাম খেজুর খাওয়া উচিত? How many grams of dates should be eaten every day?
নিয়মিত ৪-৫টি খেজুর খেতে পারেন। এতে স্বাস্থ্য উপকারিতা মিলবে। ৪-৫টি বা ১০০ গ্রাম খেজুরেই মিলবে প্রায় ২৭৭ ক্যালরি। প্রচণ্ড মিষ্টি হওয়ার কারণে এ ফল যদি বেশি খেতে থাকেন; তাহলে ওজন কমার বদলে দ্রুত বাড়তেও সময় লাগবে না।
কোন খেজুর খাওয়া ভালো? Which date is better to eat?
ভিটামিন এবং খনিজ যোগ করার সময় মেডজুল খেজুরগুলি আপনার খাদ্যকে মিষ্টি করার একটি দুর্দান্ত উপায়। মিষ্টি স্ন্যাকসের পুষ্টিগুণ কম থাকে এবং এতে চিনি ও চর্বি থেকে “খালি ক্যালোরি” থাকে। কিন্তু মেডজুল খেজুরের উচ্চ ফাইবার সামগ্রী আপনাকে দীর্ঘ সময়ের জন্য পূর্ণতা অনুভব করতে সহায়তা করে, যা ওজন ব্যবস্থাপনা লক্ষ্যে সহায়তা করতে পারে।
খেজুর খাওয়ার পর জল খেলে কি হয়? What happens after drinking water after eating dates?
খেজুর খাওয়ার পর জল পান করলে খেজুরে থাকা গ্লুকোজ ফ্রুক্টোজে রূপান্তরিত হয়ে দেহে বাড়তি এনার্জি যোগায়। তবে অন্যান্য কোনো ফল খাওয়ার পর জল পান করা উচিত নয়।
শেষ কথা, Conclusion
খেজুরে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও মিনারেল বিদ্যমান, ফলে নানান ধরনের রোগ নিরাময় করার ক্ষমতা রয়েছে এই ফলটির মধ্যে। পাশাপাশি এই ফলের বিভিন্ন পুষ্টিগুণ আমাদের শরীরের প্রয়োজনীয় চাহিদাও মেটায়। তাই প্রতিদিন তিনটি করে খেজুর খাওয়ার অভ্যাস করুন।