স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস খুব কম মানুষের আছে। এর একমাত্র কারণ হল আমরা স্বাদ যুক্ত খাবার খেতে বেশী পছন্দ করি, সেটা অস্বাস্থ্যকর হলেও আমরা প্রায়ই সুযোগ পেলেই ভাজাভুজি, চটপটা খাবার খাই। স্বাস্থ্যকর খাবারে তেমন স্বাদ পাওয়া যায় না বলে খিদে পেলেই তো হাতে তুলে নিচ্ছি বার্গার অথবা পিৎজা। অনেকেই ভাবেন পেট ভরলেই শরীরও ভরলো। কিন্তু এ ধরনের খাবারগুলো আমাদের শরীরকে আরও খারাপের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
তাই, শরীরে বাসা বেঁধে চলেছে হাজারো সমস্যা। তাইতো ছুটতে হয় চিকিৎসকের কাছে। এমন অবস্থায় একটা কথা মনে পড়ে ” An apple a day keeps the doctor away.”। কথাটার মানে এক কথায় বলতে গেলে দিনে একটা আপেল আপনাকে চিকিৎসকের থেকে দূরে অর্থাৎ রোগমুক্ত রাখতে পারে। চলুন তবে জেনে নেওয়া যাক আপেল খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে।
আপেলের পুষ্টিগুণ, Nutrient facts of Apple
আপেল আমাদের সুস্থতার জন্য বেশ উপকারী একটি ফল। এতে আছে ভিটামিন, খনিজ, পেকটিন, কুইক্সিটিন, ফ্ল্যাভোনয়েড ইত্যাদি। বাজারে সবুজ এবং লাল দুই ধরনের আপেল পাওয়া যায়।
উভয়ের গুণমান প্রায় একই হলেও কিছু পার্থক্যও রয়েছে। সামগ্রিকভাবে চিন্তা করতে গেলে, পুষ্টিগুণের দিক থেকে সবুজ আপেল লাল আপেলের চেয়ে কিছুটা এগিয়ে। সবুজ আপেল ভিটামিন A, B, C, E সমৃদ্ধ। অন্যদিকে লাল আপেল সবুজের তুলনায় বেশি আয়রনযুক্ত। এছাড়াও এতে পটাশিয়াম ও প্রোটিনও বেশি থাকে। অন্যদিকে ডায়বেটিস যাদের আছে তাদের সবুজ আপেল খাওয়াই ভাল। এবার লাল আপেল সবুজের তুলনায় বেশি অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর। প্রতি ১০০ গ্রাম আপেল এ রয়েছে –
- খাদ্যশক্তি- ৫২ কিলোক্যালরি,
- আমিষ ০.২৬ গ্রাম,
- শর্করা ১৩.৮১ গ্রাম,
- ফাইবার ২.৪ গ্রাম,
- চর্বি ০.১৭ গ্রাম,
- ভিটামিন এ ৫৪ আইইউ,
- ভিটামিন সি ৪.৬ মিলিগ্রাম,
- ভিটামিন ই ০.১৮ মিলিগ্রাম,
- পটাশিয়াম ১০৭ মিলিগ্রাম,
- ক্যালসিয়াম ৬ মিলিগ্রাম,
- সোডিয়াম ১ মিলিগ্রাম,
- কোলেস্টেরল ০ মিলিগ্রাম,
- লৌহ ০.১২ মিলিগ্রাম,
- জিংক ০.০৪ মিলিগ্রাম,
- ফসফরাস ১১ মিলিগ্রাম,
- ম্যাগনেসিয়াম ৫ মিলিগ্রাম।
আপেল খাওয়ার উপকারিতা, Benefits of eating Apple
আপেল এর উপকারিতা এবং পুষ্টিগুণ যা আমাদেরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে কাজ করে। নিয়মিত আপেল খেলে রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেকটা কমে যায়। ছোট-বড় সবার পরিচিত এবং প্রিয় একটি ফল আপেল। জেনে নিন আপেল খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে :
১.সাদা ঝকঝকে ও সুস্থ দাঁত পেতে আপেল খাওয়া উচিত :
আপেল খেলে দাঁতের সুস্থতার ক্ষেত্রে দারুণ উপকার পাওয়া যায়। এর কারণ হল, আপেলে চিবিয়ে খেলে আমাদের মুখের ভিতর থাকা ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয়, এর ফলে সেই ব্যাকটেরিয়াগুলো আর দাঁতের কোনও ক্ষতি করতে পারেনা। তাই বলে, শুধু আপেল খেয়ে দাঁতের সুস্থতা পেয়ে যাবেন এমন আশা করা ঠিক না। রোজ নিয়মিত ব্রাশ ব্যবহার করে দাঁত পরিষ্কার করা জরুরি।
২. ক্যান্সারের প্রবণতা দূর করে:
আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর ক্যান্সার রিসার্চ-এর বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, আপেল খেলে অগ্ন্যাশয়ে ক্যান্সারের সম্ভাবনা প্রায় ২৩% হারে কমে যায়, এর কারণ হল আপেলের মধ্যে থাকে প্রচুর পরিমাণে ফ্ল্যাভোনল। অন্যদিকে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা আপেলের মধ্যে ট্রিটারপেনয়েডস নামক উপাদানের উপস্থিতি পেয়েছেন।
এই উপাদানটি লিভার, স্তন এবং কোলোনের মধ্যে ক্যান্সারের কোষের বৃদ্ধিতে বাধা দেয়। ন্যাশানাল ক্যান্সার ইন্সটিটিউট ইন দ্য ইউ এস- এর গবেষণায় দেখা গেছে যে, আপেলের মধ্যে যে পরিমাণে ফাইবার থাকে, তা মলাশয়ের ক্যান্সার রোধে সাহায্য করে।
৩. ডায়াবেটিসের সমস্যা কমায় :
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে সবুজ আপেল ডায়বেটিস রোগীদের জন্য উপকারী। প্রতিদিন যদি একটা করে আপেল খান, তবে ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা ২৮% কমে যায়। এমনটা হওয়ার কারণ হল, আপেলের মধ্যে যে ফাইবার থাকে, তা রক্তে শর্করার পরিমাণ সঠিক রাখতে সহায়তা করে। তাই নিত্যদিনের ডায়েটে আপেল যোগ করতে পারেন।
৪. কোলেস্টেরল কম করে :
আপেলের মধ্যে থাকে ফাইবার, যা অন্ত্রের মধ্যে জমে থাকা ফ্যাট কমাতে সাহায্য করে। এর ফলে কোলেস্টেরলের মাত্রাও সঠিক থাকে। শরীরে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কম থাকলে হৃদযন্ত্রের কোনও ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। এই আশঙ্কা কম করতে সহায়তা করে আপেল। তাই রোজ আপেল খাওয়া উচিত।
৫. রক্তচলাচল স্বাভাবিক রাখতে সহায়তা করে :
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে আপেলের মধ্যে থাকা ফাইবার কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে। অন্যদিকে আপেলের খোসার মধ্যে তাকে ফেনলিক উপাদান যা, রক্তনালিকার থেকে কোলেস্টেরল দূর করে হার্টে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।
৬. গল- ব্লাডারের স্টোন সারাতে সাহায্য করে :
পিত্তথলির মধ্যে অতি পরিমাণে কোলেস্টেরল ও প্রোটিন জমে গেলে গলস্টোন হয়, যার কারণে হজমের সমস্যা, পেট ব্যাথা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। গলস্টোন কমানোর জন্য চিকিৎসকরা সাধারণত ফাইবার সমৃদ্ধ ফল বা খাদ্য খাওয়ার উপদেশ দিয়ে থাকেন। সেই সঙ্গে গলস্টোন সারাতে ওজন কম করা এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানোর জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। প্রসঙ্গত, এই সব কাজে সহায়তা করে আপেল। তাই নিয়মিত আপেল খাওয়া উচিত।
৭. ডায়ারিয়া এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে :
পেটের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে আপেল। অনেকের পেট পরিষ্কার হয় না, মল ত্যাগের সময় মনে হয় যেন একবারে পরিষ্কার হয় নি, তাই বার বার বেগ পায়। এবার কারও ক্ষেত্রে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাও দেখা যায়। এই দুই সমস্যার একটাই ওষুধ। তা হল, আপেল, যা খেলে হজম শক্তি বৃদ্ধি হয় এবং সেই সঙ্গে কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাও দূর হয়।
৮. ওজন কমাতে সাহায্য করে :
এমন বহু মানুষ আসেন যারা অতিরিক্ত ওজনের কারণে জর্জরিত। ওজন তথা মেদের কারণে নানারকম রোগ শরীরে বাসা বাঁধতে শুরু করে। ডায়াবেটিস, হাড়ের রোগ কত কিছুই না হয় অতিরিক্ত ওজনের কারণে। তাই সেই সমস্ত রোগকে বিদায় জানাতে হলে নিয়ম করে রোজ আপেল খাওয়া উচিত, কারণ ফলটিতে আছে ফাইবার যা আপনার পেটকে ভরা রাখতে সাহায্য করে কোনও ক্যালরি ছাড়াই, ফলে সহজে খিদে ভাব অনুভব হয় না। এর ফলে ওজনও নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
৯. লিভার সুস্থ রাখে :
আমরা যা কিছু খাই, তার মধ্যে এমন বহু ক্ষতিকারক পদার্থ থাকে যার প্রভাবে আমাদের লিভারের ক্ষতি হতে পারে। দেহের সুস্থতার জন্য লিভারকে সুস্থ রাখা খুবই জরুরী। লিভারকে ১০০ শতাংশ সুস্থ রাখতে পারে আপেল। এটি খুব সহজেই লিভারে জমা হওয়া ক্ষতিকারক উপাদানদের বের করতে সাহায্য করে এবং লিভারকে সুস্থ রাখে। তাই লিভারকে সুস্থ রাখতে নিয়মিত আপেল খাওয়া উচিত।
১০. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে :
আপেলের মধ্যে আছে এক প্রকার অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, যা কুয়েরসেটিন নামে পরিচিত। এই বিশেষ উপাদানটি আমাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে এবং আমাদের শরীরকে রোগ মুক্ত রাখতে সাহায্য করে।
শেষ কথা, Conclusion
আপেলের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করার পর বুঝতেই পারছেন যে এই ফল আমাদের স্বাস্থের জন্য কতটা উপকারী। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে দুধের সাথে কখনো আপেল খাওয়াবেন না। কারও ক্ষেত্রে আপেল খেয়ে কোনো শারীরিক অসুবিধা যেমন অ্যাসিডিটি বোধ হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।