মেথির সাথে আমরা সকলেই খুব পরিচিত। আমাদের সকলের বাড়ির রান্নাঘরে এই উপাদান অবশ্যই উপস্থিত থাকে। বলতে গেলে রান্নায় প্রায় রোজই এর ব্যবহার হয়। মেথি বীজ খুবই ছোট, কিন্তু এই ছোট্ট বীজের মধ্যেই লুকিয়ে আছে গুণের ভান্ডার।
- 1 মেথির বিভিন্ন নাম ~ Different names of fenugreek
-
2
মেথির উপকারিতা ~ Health benefits of Fenugreek seeds in Bengali
- 2.1 মাতৃদুগ্ধ বৃদ্ধিতে সহায়ক
- 2.2 পুরুষদের টেস্টোস্টেরনের ওপর প্রভাব
- 2.3 রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
- 2.4 চুলের যত্নে মেথির উপকারিতা
- 2.5 ঝকঝকে ত্বক পেতে মেথির ব্যবহার
- 2.6 ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে
- 2.7 কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে
- 2.8 বুকে জ্বালাপোড়া হওয়া রোধ করে
- 2.9 মহিলাদের ঋতুকালীন ও প্রসবজনিত সমস্যার সমাধানে মেথি কার্যকরী
- 2.10 ক্যান্সারকে দূরে রাখে
- 3 অন্যান্য উপকারিতা
- 4 মেথি খাওয়ার নিয়ম জেনে নিন ~ How to eat Fenugreek seeds in Bangla
- 5 সব শেষে
বেশিরভাগ মানুষই এ নিয়ে অবগত যে মেথি খুবই উপকারি একটি মশলা। তবে শুধু তাই নয়, আমাদের শরীরের নানা সমস্যার সমাধানেও মেথির ব্যবহার করা সম্ভব। তবে এর আগে জেনে নেওয়া ভালো যে মেথি কোন কোন সমস্যায় উপকারী ভূমিকা পালন করে। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা মেথির বিভিন্ন উপকারিতা সম্পর্কে তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
মেথির বিভিন্ন নাম ~ Different names of fenugreek
মেথি সারা ভারতে বিভিন্ন নামে পরিচিত। বাংলা, হিন্দি, গুজরাটি, পাঞ্জাবি এবং মারাঠি ভাষায় একে মেথি বলা হলেও সংস্কৃতে এটি মেথিকা হিসেবে পরিচিত। অন্যদিকে এটি কন্নড় ভাষায় মেন্টিয়া হিসেবে পরিচিত, তেলেগুতে মেন্টুলু, মালয়ালম ভাষায় ভেন্তিয়াম, তামিলে ভেন্ডায়াম, ল্যাটিন ভাষায় ট্রিগোনেলা ফোয়েনাম গ্রিকাম এবং ইংরেজিতে ফেনুগ্রিক নামে পরিচিত। তবে নাম ভিন্ন হলেও সকল দেশের মানুষের জন্য এই উপাদানের কাজ একই।

মেথির উপকারিতা ~ Health benefits of Fenugreek seeds in Bengali
আমাদের কারও এ বিষয় অজানা নয় যে মেথি একটি ভেষজ উপাদান। তাই এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। অন্যদিকে এই উপাদানটি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপাদেয়। তবে এর ব্যবহার আমাদের রান্নাঘর পর্যন্তই শুধু সীমাবদ্ধ নয় বরং এই ভেষজ আয়ুর্বেদিক ও ইউনানী ওষুধ তৈরিতেও কাজে লেগে থাকে। তাই মেথি খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে সকলেরই বিস্তারিতভাবে জেনে রাখা ভালো।
মাতৃদুগ্ধ বৃদ্ধিতে সহায়ক
সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুর বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় মায়ের বুকের দুধ, এ ব্যাপারে আমরা সবাই জানি যে এটি পুষ্টির সবচেয়ে বড় উৎস। তবে অনেক মায়ের ক্ষেত্রে স্তন্যদানের জন্য প্রয়োজনীয় দুধ পেতে বেগ পেতে হয়। শিশুকে পান করানোর জন্য বুকে যথেষ্ট পরিমাণ দুধ আসতে অনেক মায়েরই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হয়। তবে ওইসব ওষুধের থেকে নিরাপদ ও প্রাকৃতিক বিকল্প হতে পারে মেথি খাওয়া। গবেষণায় দেখা গেছে যে, মেথি দানা মিশিয়ে ভেষজ চা পান করার ফলে বুকের দুধ বেড়ে যায়, যা নবজাত শিশুর ওজন বাড়াতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
পুরুষদের টেস্টোস্টেরনের ওপর প্রভাব
পুরুষেরা টেস্টোস্টেরন হরমোন বাড়ানোর জন্য মেথি খেতে পারেন। গবেষণা অনুযায়ী জানা যায় যে, এই হরমোন বাড়ানোর জন্য মেথি ইতিবাচক ভূমিকা রাখে, এতে যৌনআকাঙ্ক্ষা বাড়ে।

রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও মেথি সহায়ক হতে পারে। মেথির মধ্যে হজম শক্তি বৃদ্ধি করার এবং দেহের অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট ও সুগার শোষণ করে নেওয়ার ক্ষমতা আছে। এটি খেলে শরীরের ইনসুলিন নিঃসরণের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্তরা দিনে দুইবার ৫ গ্রাম করে মেথির গুড়া খেলে, তাদের রক্তে শর্করার হার নিয়ন্ত্রিত হয়। পাশাপাশি পেটের মেদও কমে।
চুলের যত্নে মেথির উপকারিতা
আজকাল অনেকেরই চুল পড়ার সমস্যা হচ্ছে। তবে অনেকেই হয়তো জানেন না যে চুলের গোড়া মজবুত করতে ও চুল পড়া কমাতে মেথির জুড়ি মেলা ভার। এই ভেষজে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-A এবং ভিটামিন-C থাকে, যা চুলকে শক্তিশালী করে তোলে। মেথিতে উপস্থিত লিথিসিন নামক পদার্থ চুল ঝরে পড়া প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। অন্যদিকে মাথার খুশকি দূরীকরণেও মেথির ভূমিকা রয়েছে। এতে ভিটামিন-E থাকে যা চুলের জন্য খুব উপকারী। মেথিতে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি জেলোটিন পাওয়া যায় যা আমাদের চুলের ঔজ্জ্বল্যতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও চুল কালো রাখার ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা রয়েছে, কারণ মেথির গুঁড়া মেলানিন উৎপাদনে সহায়তা করে, আর এই মেলানিন চুলের কালো রঙ ধরে রাখে।
ঝকঝকে ত্বক পেতে মেথির ব্যবহার
মেথি ব্যবহার করে সহজেই ঝকঝকে ও উজ্জ্বল ত্বক ফিরিয়ে আনা সম্ভব। ত্বকের বলিরেখা তৈরির জন্য দায়ী বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান মেথি দূর করে। এছাড়াও এটি চোখের নীচের কালো দাগ বসতে দেয় না। মেথিতে এন্টি- ব্যাকটেরিয়াল পদার্থ থাকে, যা ত্বকের গভীর স্তর পর্যন্ত যায়। ফলে দীর্ঘদিন এটি ব্যবহার করলে ব্রণের দাগের হাত থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে
গবেষণা করে দেখা যায়, মেথি খাওয়া ফলে চর্বিজাতীয় খাদ্যগ্রহণ ও ক্ষুধা কমে যায়। ফলে শরীরের মেদ কমানো সহজ হয়।
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে
কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে মেথি রক্তে কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইডের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে।
বুকে জ্বালাপোড়া হওয়া রোধ করে
বেশ কিছু মানুষের প্রায়ই বুক জ্বালাপোড়া করার সমস্যা হয়, তবে গবেষণায় দেখা গেছে যারা মেথি সেবন করেন তাদের এ ধরনের সমস্যা কম হয়। এই উপাদানের কার্যকারিতার সাথে অ্যান্টাসিডের কার্যকারিতার মিল রয়েছে।
মহিলাদের ঋতুকালীন ও প্রসবজনিত সমস্যার সমাধানে মেথি কার্যকরী
মেথির মধ্যে সাইটো-ইস্ট্রোজেন নামক এক বিশেষ উপাদান থাকে যা নারীদের দেহে প্রোলাকটিন নামক হরমোনটির মাত্রা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। উক্ত হরমোন মহিলাদের দেহকে সুগঠিত করতে সহায়তা করে। এছাড়াও ঋতুকালীন বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করতে খুবই কার্যকরী এই উপাদান। গবেষণার মাধ্যমে বিশেষজ্ঞরা মহিলাদের জরায়ুর সংকোচন ও প্রসারণের যন্ত্রণা কম করতেও মেথির অবদান প্রমান করেছেন। তবে অতিরিক্ত মেথি খেলে গর্ভপাত বা অপরিণত শিশুর জন্মদানের আশঙ্কাও দেখা দিতে পারে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মেথি সেবন করতে হবে।
ক্যান্সারকে দূরে রাখে
সাধারণত রক্তে টক্সিক উপাদানের মাত্রা বাড়লে ক্যান্সার কোষের জন্ম নেওয়ার আশঙ্কাও থাকে। সেক্ষেত্রে ক্যান্সারকে দূরে রাখতে মেথি বীজের গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এর মধ্যে থাকা ক্যান্সার প্রতিরোধী উপাদান রক্তে ভাসতে থাকা টক্সিক উপাদানগুলোকে আমাদের শরীর থেকে বের করে দিতে সহায়তা করে, ফলে শরীরে ক্যান্সার কোষের জন্ম নেওয়া প্রতিরোধ হয়, তাই সম্ভব হলে নিয়মিত মেথিশাক কিংবা মেথি বীজ খাওয়া উচিত।
অন্যান্য উপকারিতা
উক্ত সমস্যাগুলো ছাড়াও আমাদের দেহে আরো বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা মোকাবিলায় মেথি কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। যদিও দেহের অন্যান্য সমস্যায় মেথির ব্যবহার নিয়ে সিদ্ধান্তে আসার মতো পর্যাপ্ত গবেষণা এখনই হয়নি। তবে প্রাথমিক গবেষণা অনুযায়ী বলা যায় যে, মেথি বেশ কিছু ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করেতে পারে।
মেথি খাওয়ার নিয়ম জেনে নিন ~ How to eat Fenugreek seeds in Bangla
শুধু মেথির বীজ যে রান্নায় ব্যবহার হয় তা নয়, বরং মেথি গাছের সবুজ পাতাও শাক হিসেবে খাওয়া হয়। তবে আমরা মেথি রান্নার মসলা হিসেবে সবথেকে বেশি খেয়ে থাকি।
কিন্তু আমাদের জেনে রাখা ভালো যে রান্নায় ব্যবহার করতে হলেও মেথিকে তিন থেকে চার ঘণ্টা জলে ভিজিয়ে রাখা উচিৎ। এভাবে ভালো ফল পাওয়া যায়।
তবে এই উপাদান অন্যভাবেও সেবন করা যায়; যেমন, এক গ্লাস গরম জলে কয়েক দানা মেথি ভিজিয়ে ১০ মিনিট রেখে থিতিয়ে নিতে পারেন। এবার এর মধ্যে লেবু আর মধু মিশিয়ে সেই তরলটি পান করুন। সকালে খালি পেটে মেথির জল খেলে ওজন কমাতে সহায়তা হয়, কারণ এতে মেদ ঝরে যায়।
এছাড়াও বিভিন্ন রান্না যেমন রুটি, পরোটা, তরকারির ঝোল ইত্যাদিতে মেথি পাতা ব্যবহার করলে খাবারের স্বাদ বেড়ে যায়। এভাবে স্বাদ বাড়ার পাশাপাশি এটি শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানেরও যোগান দিবে।
সব শেষে
বেশ কয়েক দশক ধরে দেশ ও বিদেশে মেথি নিয়ে একাধিক গবেষণা করা হয়েছে, এতে দেখা গেছে যে মেথি বীজে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন, উপকারি উপাদান, ভাল কোলেস্টেরল, ডায়াটারি ফাইবার এবং আরও বেশ কিছু দেহের জন্য প্রয়োজনীয় খনিজ এবং মিনারেল। উক্ত উপাদানগুলো নানাভাবে শরীরের উপকারে আসে। তাই সুস্থ থাকতে চাইলে অবশ্যই নিয়মিত মেথির ব্যবহার করতে হবে।