গ্রিন টি বর্তমানে স্বাস্থ্য সচেতন জনগণের নিত্যদিনের খাদ্যতালিকায় একটা অংশ হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা থেকে দূরে থাকতে অনেকেই আজকাল গ্রিন টি পান করছেন। নিঃসন্দেহে এর বহু স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে, তবে গ্রিন টি সেবনের কিছু ক্ষতিকর দিকও আছে। এসব কিছু নিয়ে আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা আলোচনা করবো।
গ্রিন টি বা সবুজ চায়ের বৈশিষ্ট্য, Features of green tea :
গ্রিন টির মধ্যে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন A, B, B5, D, E, C, H; সেলেনিয়াম, ক্রোমিয়াম, জিংক, ক্যাফেইন, মেঙ্গানিজ, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ছাড়াও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে সবুজ চায়ের নিম্নে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্য থাকে :
- গ্রিন টি ক্যান্সারের ঝুঁকি কম করতে পারে।
- গ্রিন টি ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাসের মতো অণুজীবের বিরুদ্ধে কাজ করে।
- গ্রিন টি হার্টের স্বাস্থ্য উন্নত করতে সহায়তা করে।
- গ্রিন টি আর্থ্রাইটিসের প্রভাব কম করার ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে।
- গ্রিন টি প্রদাহ কমাতে সাহায্য করতে পারে।
- গ্রিন টি খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কম করতে পারে।
গ্রিন টি খাওয়ার উপকারিতা, Benefits of consuming green tea :
গ্রিন টি সেবনের বিভিন্ন উপকারিতা সম্পর্কে জেনে নিন :
- গ্রিন টি ওজন কমাতে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি ভাল পানীয়, এর কারণ এটি কম ক্যালোরিযুক্ত পানীয়। এটি বিপাক এবং চর্বি ভাঙ্গন বাড়ায় এবং লিপিড শোষণকে বাধা দেয়। তাই ওজন কমানোর প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে খাবারের আগে এবং পরে গ্রিন টি খাওয়া যেতে পারে।
- গ্রিন টি এর প্রদাহ বিরোধী এবং স্ট্রেস-প্রতিরোধকারী বৈশিষ্ট্যগুলির কারণে চুল পড়া, খুশকি, টাক পড়া এবং সোরিয়াসিস প্রতিরোধের জন্যও উপকারী হতে পারে ।
- গ্রিন টি নিয়মিত পান করার অভ্যাস মানবদেহের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে।
- নিয়মিত গ্রিন টি পান করলে ধমনী শিথিল হয় এবং দেহে রক্ত প্রবাহের মাত্রা ভালো থাকে।
- নিয়মিত গ্রিন টি পান করলে ত্বকের রোদে পোড়াভাব কমে, চুল ও ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ে। সূর্যের ক্ষতিকর বেগুনি রশ্মির প্রভাব থেকেও ত্বককে রক্ষা করতে পারে এই পানীয়।
- গ্রিন টি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়।
- রক্তে কোলেস্টোরেলের মাত্রা কমাতে গ্রিন টি একটি জাদুকরি পানীয় হিসেবে বিবেচিত।
- গ্রিন টি-তে পলিফেনল পাওয়া যায়। এগুলি শরীরে ক্রমবর্ধমান ক্যান্সার কোষগুলিকে বৃদ্ধি করা রুখে দেয়। তাই ক্যান্সারের ঝুঁকি এড়াতে গ্রিন টি পান করতে পারেন।
- গ্রিন টি খেলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে। এর কারণ হল এই চায়ের মধ্যে থাকা বিভিন্ন উপকারী উপাদান দেহে ইনসুলিনের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে।
গ্রিন টি খাওয়ার সঠিক সময়, Right time to consume green tea :
খাবার খাওয়ার সাথে সাথেই গ্রিন টি পান করা উচিত নয়। খাবার খাওয়ার কমপক্ষে ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা পরে অথবা আগে গ্রিনটি পান করুন। সকালে খালি পেটে কখনোই গ্রিন টি পান করবেন না।
গ্রিন টি পান করার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো সকালে বা বিকেলে হালকা কিছু খাবার পর। গ্রিন টির উপকারিতা পুরোপুরি পেতে মধুর সঙ্গে গ্রিন টি পান করতে পারেন।
গ্রিন টি খেলে কি ক্ষতি হয়? Does green tea harm?
গ্রিন টিতেও ক্যাফেইন থাকে, আর অতিরিক্ত ক্যাফেইন সেবনে অনিদ্রা, মাথাব্যথা, উদ্বেগ বাড়তে পারে। আয়রন শোষণের পরিমাণও কমিয়ে দেয় ক্যাফেইন। দিনে দু থেকে তিন কাপ গ্রিন টি খেতে পারেন। তবে এর বেশি না খাওয়াই ভালো।
গ্রিন টি কখন খাওয়া উচিত নয়? When should not we consume green tea?
খাওয়ার পরপরই গ্রিন টি পান করা বিপজ্জনক হতে পারে। খুব বেশি গ্রিন টি খেলে লিভারের সমস্যা হতে পারে। রাতে ঘুমানোর আগে গ্রিন টি খাবেন না, এতে ঘুমের সমস্যা হতে পারে।
পাতিলেবু, টমেটোর সঙ্গে গ্রিন-টি খাওয়া উচিত নয়। এর ফলে লিভার এবং কিডনিতে অক্সালেট তৈরি হয়ে স্টোনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। খাবার বা ওষুধের সঙ্গে কখনও গ্রিন টি খাওয়া উচিত নয়।
অনেকে ওজন কমানোর জন্য সকালে পাতিলেবু গরম জল দিয়ে খেয়ে গ্রিন টি পান করেন, যা স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
গ্রিন টি খেলে কি মুখে দুর্গন্ধ হয়? Does green tea cause bad breath?
গ্রিন টি একাধিক উপায়ে আপনার মুখের স্বাস্থ্যের জন্য ভাল। একটি সমীক্ষায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে গ্রিন টি-তে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধের একাধিক কারণের বিরুদ্ধে লড়াই করে ।
বিশেষত, পলিফেনল সালফার যৌগ এবং মৌখিক ব্যাকটেরিয়া হ্রাস করে যা দুর্গন্ধযুক্ত শ্বাসে অবদান রাখে।
গ্রিন টি খেলে কত ক্যালরি খরচ হয়? How many calories are reduced by green tea?
চা পাতার মধ্যে কোনও ক্যালোরি থাকে না। গ্রিন টি, ব্ল্যাক টি যখন আপনি গরম জলে মিশিয়ে খান, তখন অল্প পরিমাণে ক্যালোরি তৈরি হয়। তাও ২৫০ মিলি চায়ে মাত্র ৩ ক্যালোরি থাকে। এই ধরনের চায়ে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
গ্রিন টি ত্বকে ব্যবহার করলে কি হয়? What happens if you use green tea on the skin?
ত্বকে বয়সের ছাপ ঠেকিয়ে রাখতে এই চায়ের ব্যবহার করতে পারেন। গ্রিন টি চামড়া কুঁচকে যেতে দেয় না। ব্রণের সমস্যা সমাধানেও গ্রিন টি-র জুড়ি নেই। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, গ্রিন টি-তে থাকা বিভিন্ন অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট উপাদান ত্বকে ক্যানসারের ঝুঁকি কমায়।
গ্রিন টি খাওয়ার বয়স কত? What is the age to consume green tea?
গ্রিন টি অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে পূর্ণ এবং মাঝারি পরিমাণে সেবন করলে এর অনেক স্বাস্থ্যকর বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটি পান করা শুরু করার কোনো বয়সসীমা নেই । জাপানে শিশুরা অল্প বয়সে গ্রিন টি পান করা শুরু করে।
গ্রিন টি খেলে কি ত্বক ফর্সা হয়? Does green tea make the skin fairer?
গ্রিন টি শুধু স্বাস্থ্য রক্ষায়ই নয় বরং ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধিতেও দারুণ কার্যকর। এ কারণে এখন শুধু পানীয় হিসেবে নয়, এটি ব্যবহার হচ্ছে রূপচর্চার সামগ্রী হিসেবেও।
গ্রিন টি-তে আছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, নানাবিধ এনজাইম, অ্যামিনো অ্যাসিড, ভিটামিন বি-সহ বেশকিছু উপাদান, যা ত্বকের জন্য খুবই উপকারী।
গ্রিন টি খেলে কি আলসার হয়? Does green tea cause ulcer?
গ্রিন টি-তে ট্যানিন থাকে যা পেটে অ্যাসিড বাড়াতে পারে যার ফলে পেটে ব্যথা হতে পারে। পেটে অতিরিক্ত অ্যাসিড থাকলে বমি বমি ভাব অনুভব হতে পারে। এই সবই কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
পেপটিক আলসার বা অ্যাসিড রিফ্লাক্সে আক্রান্ত রোগীদের সকালে প্রথমে গ্রিন টি না খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
রাতের খাবারের পর গ্রিন টি খেলে কি হয়? What happens when green tea is consumed after dinner?
গ্রিন টি তে উচ্চ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং পলিফেনল উপাদান রয়েছে। খাওয়ার ঠিক পরে গ্রিন টি পান করার পর এটি একটি অনুঘটক হিসাবে কাজ করে, উৎপাদনকে ত্বরান্বিত করে সেইসাথে গ্যাস্ট্রিক জুস, লালা এবং পিত্ত সহ অনেকগুলি হজম এনজাইমের উদ্দীপনা হজম প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে।
খালি পেটে কি গ্রিন টি খাওয়া উচিত? Should you consume green tea on an empty stomach?
গ্রিন টি-তে ট্যানিন নামে পরিচিত পলিফেনল রয়েছে যা পাকস্থলীর অ্যাসিড বাড়ায়, যার ফলে পেটে ব্যথা, বমি বমি ভাব, জ্বালাপোড়া বা এমনকি কোষ্ঠকাঠিন্য হয়। খাওয়ার মাঝে বা খাওয়ার পরে গ্রিন টি পান করতে হবে। সকালে খালি পেটে গ্রিন টি পান করলে লিভারের ক্ষতি হতে পারে।
গ্রিন টি খাওয়ার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয়, Points to note about green tea consumption :
- অনেকেরই রাতে গ্রিন টি খাওয়ার অভ্যাস রয়েছে। সেক্ষেত্রে মনে রাখবেন যে, কফিতেই শুধু ক্যাফিন থাকে না, গ্রিন টিতেও প্রচুর পরিমাণে ক্যাফিন রয়েছে। তাই রাতে গ্রিন টি খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
- দিনে ২০০ মিলির বেশি পরিমাণ গ্রিন টি খেলেই আপনার অনিদ্রা, হজমজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- কোনো কিছু খাওয়ার পরপরই গ্রিন টি পান করতে যাবেন না। গ্রিন টিতে থাকা ট্যানিন পেটে অ্যাসিডের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, যা শরীরে হিতে বিপরীতই ডেকে আনতে পারে।
- গ্রিন টি সেবন করা নিরাপদ, তবে এর অত্যধিক সেবনে বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা, অম্বল, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন বা উচ্চ ক্যাফেইন সামগ্রীর সাথে যুক্ত অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে।
শেষ কথা, Conclusion :
গ্রিন টি স্বাস্থের উন্নতির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। ওজন কমানো থেকে, ফিট থাকা, ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখা থেকে শুরু করে মন শান্ত রাখা, গ্রিন টি পানের অনেক উপকারিতা রয়েছে।
তবে উপরে উল্লেখিত উপকারিতার পাশাপাশি এই চা পান করার ক্ষতিকর বিষয়গুলোর দিকেও লক্ষ্য রাখা জরুরি। আশা করি উপরিউক্ত আলোচনার মাধ্যমে আপনারা গ্রিন টির উপকারী এবং অপকারী দিকগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন।
Frequently Asked Questions
দিনে ৩-৫ বার গ্রিন টি খেতে পারেন, তবে তার বেশি নয়। গ্রিন টিতে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট যেমন থাকে, তেমনই কিন্তু ক্যাফিনও থাকে। বেশি গ্রিন টি খেলে অনিদ্রার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
গবেষণায় জানা গেছে যে নিয়মিত গ্রিন টি খেলে শক্তির মাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি সহনশীলতাও বৃদ্ধি পায়।
আপনি যদি গ্রিন টি পান করে সর্বাধিক স্বাস্থ্য সুবিধা পেতে চান তবে সাধারণত এক কাপ গ্রিন টি খাওয়ার পরে কমপক্ষে 1-2 ঘন্টা দুধ পান না করার পরামর্শ দেওয়া হয়।