সকলেই হয়তো দেখেছেন, দুধ গরম করার পর দুধের উপর এক ধরনের পাতলা ও হালকা হলুদাভ ক্রিমের আস্তরণ পড়ে থাকে, যা দুধের সর নামেই আমাদের কাছে পরিচিত। এই সরের রয়েছে বহু উপকারী গুণ।
রূপচর্চা বিশেষজ্ঞদের মতে, ত্বক উজ্জ্বল করতে দুধের সর কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। তবে শুধু উজ্জ্বলতা নয় বরং ত্বকের যত্নে বিভিন্নভাবে এর ব্যবহার করা যায়।
আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা দুধের সরের উপকারী ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করবো।
ত্বকের যত্নে দুধের সরের উপকারী ভূমিকা, The beneficial role of Malai in skin care :
অনেকেরই একটি ভুল ধারণা আছে যে সর প্রয়োগে ত্বক ফর্সা হয়, কিন্তু সঠিক ব্যাপার হল ত্বকের স্বাভাবিক রং উজ্জ্বল করার ক্ষেত্রে সহায়তা করে দুধের সর।
সময়ের সাথে ব্যস্ত জীবনযাত্রার অভ্যাস এবং সূর্যের অত্যধিক সংস্পর্শে আসার কারণে ত্বক মলিন হয়ে যায়। এই মলিন ত্বকের যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে দুধের সর বেশ উপকারী।
ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ত্বক উজ্জ্বল করতে সহায়তা করে দুধের সর। এতে থাকা ল্যাক্টিক অ্যাসিড ত্বকের রোদে পোড়াভাব কম করে ও প্রাকৃতিকভাবেই ত্বককে উজ্জ্বল করে তোলে।
ত্বকের কালো দাগ দূর করে
সাধারণত ত্বকের কালো দাগ সহজে দূর হতে চায় না। এ সমস্যা কম করতে দাগের উপর দুধের সর মেখে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, শুকিয়ে গেলে জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
এক্ষেত্রে আরও ভালো ফল পেতে চাইলে সরের সঙ্গে এক চামচ লেবুর রস মিশিয়ে নিয়ে সেই মিশ্রণটি ত্বকের দাগের অংশে লাগিয়ে শুকিয়ে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করে জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
সরে থাকা প্রোটিন দাগ সৃষ্টিকারী মৃত কোষগুলোকে দূর করার পাশাপাশি নতুন কোষ গঠনে সহায়তা করে। তাই কালো দাগ কম হয়ে যায়।
বয়সের ছাপ দূর করতে সহায়ক
আগেকার সময়ে ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখতে বর্তমান সময়ের মত নান রকমের প্রসাধনী পাওয়া যেত না। তখনকার সময়ের নারীরা ত্বক সতেজ রাখতে দুধের সর ব্যবহার করতেন।
এতে থাকে প্রোটিন ও ভিটামিন, যা ত্বকের ‘কোলাজেন’ তৈরি করে ও বয়সের ছাপ দূর করতে সহায়তা করে।
ত্বকের যত্নে কিভাবে সর ব্যবহার করতে হবে? How to use Malai in skin care?
দুধ জ্বাল দেওয়ার পর সর তুলে রাখুন, রোজ রাতে মুখে মেখে নিলেই উজ্জ্বল ত্বক পাওয়ার গ্যারান্টি রয়েছে। নিখুঁত ত্বকের স্বপ্ন পূরণ করতে দুধের সর হতে পারে একটি কার্যকরী সমাধান।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, মুখে দুধের সর মাখলে এটি ত্বককে ময়েশ্চারাইজ করতে, ত্বক উজ্জ্বল করতে এবং ত্বকের বয়স বাড়াতে সাহায্য করে।
ত্বকের যত্নে কিভাবে সর ব্যবহার করতে হবে তা জেনে নিন :
- ক্লিনজার হিসেবে দুধের সর :
প্রথমে মুখ ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিন, যাতে ত্বকের মধ্যে জমে থাকা ধুলোবালি, ময়লা, তেল দূর হয়ে যায়।
এরপর দুধের সর নিন এবং ভাল করে ত্বকের উপর লাগিয়ে রাখুন, ১০-২০ মিনিট রেখে হালকা গরম জল দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন। এরপর শুকনো তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে নিন।
রোজ রাতে দুধের সর দিয়ে এভাবে মুখ পরিষ্কার করলে দুধের সরের মধ্যে থাকা ল্যাকটিক অ্যাসিড ত্বককে এক্সফোলিয়েট করতে সাহায্য করে।
- দুধের সর ও মধু দিয়ে তৈরি ফেসপ্যাক :
মধুর মধ্যে আছে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণ তাই দুধের সরের সঙ্গে মধু মিশিয়ে ত্বকে লাগালে আপনার ত্বকের বার্ধক্য প্রতিরোধ হবে। পাশাপাশি ত্বকের আর্দ্রতা বজায় থাকবে।
এরজন্য ২ চামচ দুধের সরের সঙ্গে ১ চামচ মধু মিশিয়ে নিয়ে একটি ফেসপ্যাক তৈরি করে ভাল করে মুখ ও গলায় লাগান। মিনিট পনেরো রাখার পর ত্বকে প্যাক শুকিয়ে গেলে জল দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন।
দুধের সর ও মধুর ফেসপ্যাক আপনার ত্বকে কোনও ক্ষত থাকলে, সেটাও দূর করে দেবে।
- দুধের সর ও হলুদ ফেসপ্যাক :
হলুদ যুগ যুগ ধরে রূপচর্চায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছে। হলুদের মধ্যে আছে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য। তাই আপনি যদি দুধের সরের সঙ্গে হলুদ মিশিয়ে ত্বকে লাগান, সেক্ষেত্রে আপনার ত্বকের বর্ণ উজ্জ্বল হবে।
এই ফেসপ্যাক কিছুদিন ব্যবহার করে আপনি নিজেই অনুভব করবেন আপনার ত্বকের জেল্লা কতটা বেড়ে গিয়েছে। এর জন্য ২ চামচ দুধের সরের সাথে ১ চিমটে পরিমাণ হলুদ পেস্ট মিশিয়ে নিয়ে ত্বকের উপর লাগান। ২০ মিনিট রেখে মুখ ধুয়ে ফেলুন। এই ফেসপ্যাকটি আপনি চাইলে প্রতিদিন ব্যবহার করতে পারবেন।
- সর দিয়ে নাইট ক্রিম :
ত্বকের যত্নে দুধের সর দিয়ে নাইট ক্রিম ব্যবহার করতে পারেন। এই নাইট ক্রিম ব্যবহার করে ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা দূর করা যায়।
রাতে দুধে সর দিয়ে নাইট ক্রিম ব্যবহার করলে ত্বকের কোমল ভাব বজায় রাখতে পারেন। সর দিয়ে নাইট ক্রিম তৈরির করার জন্য দুধের সর, গোলাপজল, অলিভ অয়েল, অ্যালোভেরা ও গ্লিসারিন একসাথে মিশিয়ে নিয়ে একটি পেস্ট বা মিশ্রন তৈরি করুন। এই নাইট ক্রিমটি কিছুদিন ব্যবহার করলে ত্বকের যত্নে ভালো ফলাফল পাবেন।
ত্বকের যত্ন নিতে সর ব্যবহার করার নিয়ম, Rules for using Malai to take care of the skin :
■ এক টেবিল চামচ লেবুর রসের সাথে দুধের সর মিশিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করে ত্বকের উপর লাগিয়ে রাখুন। এরপর ১০ থেকে ২০ মিনিট পর সেটা শুকিয়ে গেলে পরিষ্কার জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
■ দুধের সর গোলাপজলের সাথে মিশিয়ে মুখে ব্যবহার করলে ব্রণ দূর হয়ে যায়। তাই ব্রণ কম করার জন্য গোলাপজল অথবা গোলাপের পাপড়ির সাথে দুধের সর মিশিয়ে ব্যবহার করতে পারেন।
■ ২ চা চামচ মুলতানি মাটি ও অল্প পরিমাণ দুধের সর মিশিয়ে একটি ফেসপ্যাক তৈরি করে নিন, এবার এই ফেসপ্যাকটি ত্বকে লাগিয়ে ১৫ থেকে ২০ মিনিট রাখুন। ফেসপ্যাকটি শুকিয়ে গেলে ঠান্ডা পরিষ্কার জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
■ মুখের রুক্ষ ভাব দূর করতে চাইলে বেসনের সাথে দুধের সর মিশিয়ে একটি ফেসপ্যাক তৈরি করে নিতে পারেন। এরজন্য ৩ চা চামচ বেসন নিয়ে তার সাথে ৫ গ্রাম দুধের সর মিশিয়ে ফেসপ্যাক তৈরি করে ব্যবহার করুন।
■ ত্বকের আদ্রতা বজায় রাখতে দুধের সর ও মধু একসাথে মিশিয়ে নিয়ে একটি ফেসপ্যাক বানাতে পারেন। এর ব্যবহার ত্বকের আদ্রতা ঠিক থাকবে এবং ত্বকের ক্ষতও দূর হবে।
■ দুধের সর এর সাথে কমলা লেবুর খোসা শুকিয়ে গুঁড়ো করে নিয়ে ত্বকে ব্যবহার করতে পারেন। এতে করে ত্বকের কোমল ভাব ফিরে আসবে এবং ত্বক নরম হবে।
সর খেলে কি উপকার পাওয়া যায় ? What are the benefits of consuming Malai?
■ প্রতিদিন নিয়মিত দুধের সর খাওয়ার ফলে শরীর স্বাস্থ্য ভালো থাকে এবং অবসাদ দূর হয়।
■ আমাদের দেহের হাড় মজবুত রাখতে সহায়তা করে দুধের সর। শরীরের পেশি শক্তি বজায় রাখতেও এটি সাহায্য করে, কারণ দুধের সরে থাকে ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজ ও ক্যালসিয়াম।
■ কিছু ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে দুধের সর খেলে কাশি দূর করা যায়। তবে দুধের সর এর সাথে কিছু উপাদান মেশাতে হবে, যেমন : নারিকেল গুড়া, এলাচ, গোল মরিচ ইত্যাদি উপাদান। সবকিছু একসাথে মিশিয়ে গরম করে খেলে কাশি কমানো সম্ভব।
তবে অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত দুধের সর খেলে ওজন বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদি কারো দুধ খেলে সমস্যা বোধ হয় তাদের ক্ষেত্রে সর খাওয়ার ক্ষেত্রেও সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত।
শেষ কথা, Conclusion :
আশা করি আজকের এই প্রতিবেদন থেকে আপনারা সর খাওয়ার তথা ত্বকে ব্যবহার করার উপকারিতা সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। দুধের সর থেকে ভালো উপকারিতা পেতে চাইলে এটা নিয়মিত সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করুন। এই ধরনের পোস্ট আরো পেতে চাইলে চোখ রাখুন আমাদের ওয়েবসাইটে।
Frequently Asked Questions :
উত্তরঃ মুখে দুধ দিলে মুখের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দূর করা যায়। বিশেষ করে মুখের ব্রণের সমস্যা, মুখের লালচে ভাব ও ক্ষত নিরাময় করা যায়।
উত্তরঃ মুখে দুধের সর লাগালে বিভিন্ন ধরনের উপকারিতা পাওয়া যায়। দুধের সর মুখের উজ্জ্বলতা বাড়াতে সাহায্য করে। তাছাড়াও দুধের সর দিয়ে ফেসপ্যাক বানালে সেটি ব্যবহার করলে মুখের কালো দাগ দূর করা যায় এবং কোমলতা ফিরিয়ে আনা যায়।
উত্তরঃ দুধের সর খেলে সরাসরি ওজন বাড়ে না। তবে অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত দুধের সর খেলে ওজন বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সাধারণভাবে দুধের সর খেলে ওজন বাড়ে না।