এখনকার সময়ে বেশিরভাগ মানুষ স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন। স্বাস্থ্য বজায় রাখতে মানুষ বিভিন্ন প্রয়াস করে থাকে। এরমধ্যে একটি হল জলপাই তেলের ব্যবহার। তবে এই তেল বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে অলিভ অয়েল বলেই খ্যাত।
সুস্বাস্থ্যের জন্য আজকাল বেশিরভাগ চিকিৎসকই জলপাই তেল বা অলিভ অয়েল খাওয়ার পরামর্শ দেন, কারণ, বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের জন্য জলপাই ফলের তেল, পাতা, শিকড় ইত্যাদি উপাদেয়। তবে শুধু অলিভ অয়েল নয়, কাঁচা জলপাইয়েরও বহু গুণ রয়েছে, যার সম্পর্কে হয়তো অনেকেই জানেন না। আজকের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমরা জলপাইয়ের উপকারিতা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
জলপাই বৈজ্ঞানিক নাম এবং আকার, Structure and scientific name of olive
জলপাইয়ের বোটানিক্যাল নাম ল্যাটিন ভাষায় হল Olea europaea এবং এটি Oleaceae পরিবারের একটি উদ্ভিদ। জলপাই ফলের আকার উপবৃত্তাকার আবোগ এটি ১-২ সেমি লম্বা হয়। ফলটির রং প্রাথমিক পর্যায়ে সবুজ থাকে, তারপর ধীরে ধীরে এতে লালচে ভাব আসে এবং পরিপক্ক হওয়ার পর এটি বেগুনি বা নীলাভ কালো রঙের হয়।
সাধারণত কাঁচা জলপাই দিয়ে আচার তৈরি করা হয়। আবার অনেকে রান্নায় এর ব্যবহার করে থাকেন। জলপাইয়ের ফল থেকে তেল বের করা যা দেখতে পরিষ্কার এবং স্বচ্ছ হয়, এটি হালকা সোনালি রঙের এবং এর হালকা গন্ধ আছে। এই তেল খাবারে ব্যবহার করা হয় আবার অনেকে চুল ও ত্বকের যত্নে এর ব্যবহার করেন, উভয়ের জন্যই এটি উপকারী।
জলপাই এর উপকারিতা ও ব্যবহার, Usage and benefits of olive
জলপাই আমাদের দেশের খুব পরিচিত একটি ফল, অনেকেরই খুব পছন্দের ফল এটি। এই ফল, গাছের পাতা, বীজ সবকিছুই উপকারী। বিভিন্ন ভাবে এগুলোর ব্যবহার করা যায়। সাধারণত, জলপাই/ অলিভ তেলের ব্যবহার সবচেয়ে জনপ্রিয়, কারণ এই তেলের উপকারিতাও অসংখ্য। চুলের জন্য হোক কিংবা হাড়ের গঠন ভালো রাখার জন্য, বহু ক্ষেত্রে এর উপকার রয়েছে। তবে জলপাইয়েরও বহু উপকারিতা রয়েছে, আসুন সে সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক :-
কানে ব্যথা হলে :
কানের ব্যথা হলে ৫ মিলি জলপাই পাতার রস গরম করে নিয়ে তাতে কয়েক ফোঁটা মধু মিশিয়ে কানে ১-২ ফোঁটা দিলে কানের ব্যথা ভালো হয়।
মুখের আলসার নিয়াময়ে
জলপাই ফল জলে সিদ্ধ করে এর ঘন নির্যাস তৈরি করে সেটা দিয়ে গার্গল করলে মুখের ঘাও নিরাময় হয়। তাছাড়া এটি দাঁত ও মাড়ির রোগ নিরাময় করে।
চর্মরোগে কার্যকর-
চর্মরোগ তথা মুখের দাগ দূর করার ক্ষেত্রে জলপাই অত্যন্ত কার্যকরী। আবার গুটিবসন্ত ও অন্যান্য ফোড়ায় জলপাইয়ের কাঁচা ফল পিষে লাগালে সেই সমস্যাও নিরাময় হয়। আমবাত, চুলকানি এবং দাদ উপশম করার জন্য জলপাই পাতা পিষে একটি পেস্ট তৈরি করে লাগাতে পারেন। এছাড়া আগুনে যদি শরীরের কোনো অংশ পুড়ে যায় বা ফুসকুড়ি উঠলে সেই অংশে কাঁচা জলপাইয়ের ফল পিষে লাগাতে পারেন। জলপাই গাছের আঠা দাদের উপর লাগালে দাদ নিরাময় হয়।
কাশি ও সর্দি নিরাময়ে :
সকলের বাড়িতে কম বেশি সর্দি কাশির সমস্যা লেগে থাকে। তবে অনেক সময় এই সমস্যা বেড়ে ওঠে যখন বুকে কফ জমা হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে জলপাই আমাদের অনেক সমস্যা সমাধান করে দিতে পারে। অনেকেই এই নিয়ে অবগত নয়, তবে জলপাই তেল বা অলিভ অয়েল বুকে মালিশ করলে সর্দি, কাশি এবং কফজনিত বিভিন্ন সমস্যা নিরাময় হয়।
প্রাকৃতিক প্রসাধনী হিসেবে অলিভ ওয়েল :
অলিভ অয়েলকে অনেকে একটি প্রাকৃতিক প্রসাধনী হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। অলিভ অয়েল মুখে লাগালে ত্বকের মসৃণতা বৃদ্ধি পায়। অলিভ অয়েল ত্বকে ম্যাসাজ করলে ত্বক পুষ্ট হয়। এটি মালিশ করলে ঠোঁট নরম হয় এবং ঠোঁট ফাটা বন্ধ হয়। তাছাড়া অলিভ অয়েল নবজাতক শিশুদের হাড় ও চুলের সুস্থতার ক্ষেত্রেও খুবই উপকারী।
আমাশয় সারতে জলপাই উপকারী
আমাশয় বা ডায়রিয়া হলে জলপাই পাতা পিষে এর সাথে বার্লি ময়দা মেশান। এতে কিছু জল যোগ করে মিশ্রণটি নাভিতে লাগালে ডায়রিয়া বন্ধ হয়।
হাড়ের জোড়ে ব্যথায় :
জলপাই তেল বা অলিভ অয়েল ভাঁটা জনিত রোগের বিরুদ্ধে খুবই কার্যকরী। এই রোগগুলি সাধারণত জয়েন্টের ব্যথার সাথে যুক্ত থাকে। তাছাড়া জলপাইয়ের মূল পিষে নিয়ে অস্থিসন্ধিতে লাগালে বাত রোগের ক্ষেত্রে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়।
কোষ্ঠকাঠিন্যের চিকিৎসায় জলপাই পাতা :
বিভিন্ন গবেষণা করে দেখা গেছে যে , জলপাই পাতার নির্যাস পান করলে কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা দূর হয়।
মূত্রনালীর রোগ নিরাময়ে জলপাইয়ের ব্যবহার
প্রস্রাব যদি সাধারণ পরিমাণে না আসে বা প্রস্রাবের সময় কোনোও ধরনের জ্বালাপোড়া বা ব্যথা অনুভব হয়, তবে এক্ষেত্রে জলপাই পাতার ঘন নির্যাস খুব উপকারী। ৫-১০ মিলি নির্যাস পান করলে প্রস্রাবের সব ধরনের অসুবিধায় উপকার পাওয়া যায়।
ক্ষত নিরাময় করে
কোনোও ভাবে ক্ষত হওয়া কোনো স্থানে জলপাই বা অলিভ সিড অয়েল লাগালে তা দ্রুত সেরে যায়। কাঁচা জলপাই পিষে ঘা বা পুরাতন ক্ষতের উপর লাগালে সেই ক্ষত সেরে যায় ।
ঘামের গন্ধ দূর করতে জলপাইয়ের পাতার ব্যবহার :
জলপাই পাতা শুকিয়ে নিয়ে সেগুলোকে পিষে নিন। তারপর এই পাউডার নিয়মিত শরীরে ঘষলে ঘামও কম হয় এবং ঘামের ফলে যে দুর্গন্ধ হয় সেটাও দূর হয়।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে :
গবেষণা অনুসারে, জলপাইয়ে থাকে অ্যান্টিডায়াবেটিক বৈশিষ্ট্য যা শরীরে ইনসুলিনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে। এই ফল ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলি কম করতে বা প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে।
ক্যান্সারের চিকিৎসায়
জলপাইয়ের মধ্যে ক্যান্সার দমনকারী বৈশিষ্ট্য আছে। তাই এটি ক্যান্সার প্রতিরোধের ক্ষেত্রে উপকারী।
জলপাই খাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং সতর্কতা, Side effects and precautions
জলপাই ব্যবহারে বহু উপকারিতা থাকলেও, এর সেবন বা ব্যবহারে ক্ষেত্রে অনেকের ক্ষতিও হতে পারে। যেকোনো ক্ষেত্রে জলপাই ব্যবহার করার সময় কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে, সেগুলি হল :
১. জলপাই ফল দিয়ে তৈরি মুরব্বা গরম জলের সাথে খেলে ডায়রিয়া হয়।
২. অলিভ অয়েল ত্বকে লাগালে ব্রণের সমস্যা দেখা দিতে পারে। অলিভ অয়েল ভারী হয় বলে ত্বকে খুব সহজে শোষিত হয়ে যায় না, যার ফলে ত্বকের উপরে থাকা তেলের আস্তরণে ধুলোবালি ও ময়লা জমে, তাই এর ফলস্বরূপ ব্রণ হতে পারে। তাই মুখে অলিভ অয়েল লাগিয়ে সেটা হালকা করে ঘষে মিশিয়ে নিতে হবে এবং হালকা গরম জলে পাতলা সুতি কাপড় বা তুলা দিয়ে মুখ মুছতে হবে।
৩. অতিরিক্ত জলপাই খাওয়ার ফলে অনেকের মাথাব্যথা হতে পারে।
৪. জলপাই খাওয়ার ফলস্বরূপ অনিদ্রার সমস্যা হতে পারে।
৫. পাকা জলপাই চোখের জন্য ক্ষতিকর।
৬. জলপাই দিয়ে তৈরি করা আচার খাওয়ার ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে পারে।
৭. অনেকেই হয়তো জানেন না, তবে অলিভ অয়েল শুষ্ক ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। গবেষণায় দেখা গেছে যে, জলপাই তেল ত্বকের প্রাকৃতিক আর্দ্রতা দূর করে দেয়। তাই মুখের সৌন্দর্য বাড়াতে চাইলেও এটি খুব সাবধানে ব্যবহার করা উচিত।
উপসংহার, Conclusion
আজকের এই প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে আমরা জলপাই সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। অনেকেই জলপাই খেতে ভালোবাসেন, সেটা আচার বানিয়ে হোক কিংবা তরকারির মধ্যে দিয়েই হোক না কেনো, তাছাড়া অনেকে নিয়মিত জলপাইয়ের তেলে রান্না করেন। নিঃসন্দেহে এর উপকারিতা অনেক কিন্তু অপকারিতা সম্পর্কেই সচেতন থাকা জরুরি। আশা করি উপরে দেওয়া তথ্যগুলো আপনাদের অনেক কাজে লাগবে।