শীতের দিনে রোদে বসে কমলা খাওয়ার রীতি হয়তো সকল বাঙালির ঘরেই আছে। আমাদের মধ্যে প্রায় সকলেরই হয়তো ছোটবেলায় এভাবে কমলা খাওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে আজকালের শিশুরা জুস করে বা ফ্রুট সালাদ বানিয়ে কমলা খেতে বেশি পছন্দ করে। চিরাচরিতভাবে হয়তো এখনের দিনে আর কমলা খেতে দেখা যায় না কাউকে। তবে যেভাবেই খাওয়া হোক না কেন, খাওয়া জরুরী, কারণ কমলা খাওয়ার অনেক উপকারিতা রয়েছে।
এটি ভিটামিন C এর অন্যতম উৎস। তাই কমলা খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। এছাড়াও শরীরের নানা উপকার পাওয়া যায় কমলা খাওয়ার মাধ্যমে। ছোট-বড় সবার জন্যই এটি বেশ উপকারী। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা কমলা খাওয়ার বিভিন্ন উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করবো।
কমলার পুষ্টিগুণ, nutrient facts of oranges
- টক- মিষ্টি দুটো স্বাদই পাওয়া যায় কমলায়। তাছাড়া এই ফল বেশ রসালো হয়। তবে অনেকেই হয়তো কমলার পুষ্টিগুণ সম্পর্কে সঠিকভাবে জানেন না। ১০০ গ্রাম কমলায় আছে :
- ভিটামিন B ০.৮ মিলিগ্রাম,
- ভিটামিন C ৪৯ মিলিগ্রাম,
- ক্যালসিয়াম ৩৩ মিলিগ্রাম,
- পটাসিয়াম ৩০০ মিলিগ্রাম,
- ফসফরাস ২৩ মিলিগ্রাম।
- জেনে রাখা ভালো যে দৈনিক যতটুকু ভিটামিন ‘C’ আমাদের দেহের জন্য প্রয়োজন হয়, তার প্রায় সবটাই একটি কমলা থেকে পাওয়া যায়।
কমলা খাওয়ার উপকারিতা, benefits of oranges
ছোটবেলায় মা বা দিদা – দাদুর থেকে কমলার উপকারিতা সম্পর্কে কিছু তথ্য হয়তো অনেকেই শুনেছেন। যেমন : কমলা খেলে ত্বক ভালো থাকে, চোখের জন্য ভালো ইত্যাদি। তবে এগুলো ছাড়াও আরো বেশ কিছু উপকারিতা রয়েছে এই সুস্বাদু ফলের। সেগুলো হল :
১. কমলা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
শীতের সময়ে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিকের থেকে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। এইসময় নানা রকম ভাইরাসের আক্রমণে আমরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে পারি। কিন্তু শীতের দিনে প্রতিদিন যদি কমলা খাওয়া হয় তাহলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। এর কারণ হল, কমলায় থাকে ভিটামিন C, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফাইবার, ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন A এবং ভিটামিন B। এই সব পুষ্টি উপাদানগুলো আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
২. কমলা আমাদের মস্তিষ্ককে শক্তিশালী করে তোলে
আমাদের মস্তিষ্ক শক্তিশালী করতে সাহায্য করে এমন একটি উপকারী ফল হল কমলা। এই ফল নিয়মিত খাওয়ার ফলে তা মস্তিষ্কের ক্ষমতা বৃদ্ধির কাজ করে। কমলায় থাকে ফ্লেভনয়েডস যা আমাদের মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা ঠিক রাখার পাশাপাশি এবং যেকোনো কাজে বা পড়াশুনায় মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে। তাই বড় হোক কিংবা ছোট, সকল বয়সের মানুষেরই নিয়মিত এই ফল খাওয়া উচিত।
৩. কমলা চোখ ভালো রাখে
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, কমলায় থাকে প্রচুর ভিটামিন এ, আর এই ভিটামিন যে চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সহায়ক সেটা আমাদের মধ্যে অনেকেই জানেন। ক্যারোটিনয়েড সমৃদ্ধ একটি ফল কমলা। কমলার মধ্যে থাকা ভিটামিন এ চোখের শ্লেষ্মা ঝিল্লি স্বাস্থ্যকর রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বলাই বাহুল্য চোখের ক্ষমতা বাড়াতে কমলা বিশেষভাবে কার্যকরী। তাই নিয়মিত কমলা খাওয়ার ফলে তা চোখের সমস্যা সহজে দূর করে দেয়। তাই চোখ ভালো রাখতে প্রতিদিন কমলা খাওয়ার অভ্যাস করুন।
৪. ত্বক ভালো রাখতে নিয়মিত কমলা খান
আমাদের ত্বক ভালো থাকুক এটা সকলেই চাই। তাছাড়া সকলেরই নিজের ত্বক ভালো রাখা খুব জরুরি। এর কারণ আমাদের সুন্দর ত্বক যে কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্যই প্রকাশ করে তা না, বরং এটি আপনার সুস্থতারও প্রকাশ করে। তাই এমন সব খাবার খেতে হবে যেগুলো ত্বকের জন্য উপকারী। আর তেমনই একটি উপকারী ফল হল কমলা যা ত্বকের জন্য বেশ উপকারী। নিয়মিত কমলা খাওয়ার ফলে তা ত্বককে ভেতর থেকে ভালো রাখার কাজ করে। সেইসঙ্গে ত্বকের দাগ-ছোপ দূর করে এবং ত্বককে রাখে উজ্জ্বল।
৫. হৃদযন্ত্র ভালো রাখতে উপকারী কমলা
হৃদযন্ত্র ভালো রাখার জন্য প্রত্যেকেরই যথেষ্ট যত্নশীল হতে হবে। সেজন্যই নিয়মিত কমলা খেতে হবে, এর কারণ হল কমলা খেলে তা আপনার হৃদযন্ত্র সুস্থ রাখে এবং যাদের হৃদরোগ জনিত সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্যও কমলা বেশ উপকারী। হার্টের গুরুতর সমস্যা প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে কমলা বেশ উপকারী, তাই প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় অবশ্যই কমলা যোগ করতে পারেন।
৬. ত্বকের বলিরেখা দূর করে
কমলায় রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ানোর পাশাপাশি বলিরেখা দূর করে, ফলে আপনার ত্বক তারুণ্য ধরে রাখে বহু বছর ধরে। তাই চামড়া টানটান রাখতে অবশ্যই কমলা খাওয়া উচিত। তবে এটা শুধু মেয়ে বা মহিলাদের ক্ষেত্রেই নয় পুরুষদের ক্ষেত্রেই একই উপকার পাওয়া যায়।
৭. শরীরে প্রাণশক্তি ধরে রাখতে সহায়ক কমলা
আমাদের শরীরে অনেক সময় ভিটামিন ‘C’- র ঘাটতি দেখা দেয়। তখন শরীর হয়ে পড়ে নির্জীব। সেক্ষেত্রে কমলা খেলে এই ঘাটতি পূরণ হয়। এর কারণ হল কমলায় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘C’ রয়েছে, যা ত্বকের সজীবতা ফিরিয়ে আমার পাশাপাশি দেহে কর্মস্পৃহা ধরে রাখতে সহায়ত করে। তাই নিয়মিত কমলা খাওয়া উচিত।
৮. কমলা ব্লাড সুগার ও ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করে
কমলায় রয়েছে ভিটামিন B6 ও ম্যাগনেসিয়াম, আর এই উপাদানগুলো রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাই কমলা খেলে ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাছাড়াও কমলায় রয়েছে প্রচুর আঁশজাতীয় উপাদান, যা ব্লাডসুগার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। অন্যদিকে কমলায় থাকা দ্রবণীয় ফাইবার সরাসরি শরীরের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
৯. কমলা ওজন কমাতে সাহায্য করে
কমলা ‘ক্যালরি ফ্রি’ ফল হিসেবে পরিচিত। এই ফলের মধ্যে আছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, যা পেট পরিষ্কার রাখতে সহায়ক তথা হজমেও সাহায্য করে। অন্যদিকে কমলার মধ্যে থাকা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদানগুলো শরীরের বাড়তি মেদ কমাতে সাহায্য করে। মানুষের জন্য অত্যাবশ্যক পুষ্টি যেমন থিয়ামাইন, নিয়াসিন, ভিটামিন বি সিক্স, ম্যাগনেশিয়াম এবং কপার রয়েছে কমলায়। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রেখে শরীরকে সুস্থ সবল রাখতে কমলা খাওয়া উচিত।
১০. কমলা ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসেবেও পরিচিত
কমলায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন, এর পাশাপাশি এতে আলফা ও বেটা ক্যারোটিনের মতো ফ্ল্যাভনয়েড অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সহ অন্যান্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যৌগ রয়েছে যা ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। কমলার উপস্থিত উচ্চমাত্রার পুষ্টিগুণ ফ্ল্যাভনয়েড ফুসফুস এবং ক্যাভিটি ক্যান্সার প্রতিরোধে বিশেষভাবে কার্যকর। তাছাড়া বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে কমলা ব্রেস্ট ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার ও স্কিন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
সতর্কতা, precautions
- দুধের সাথে কমলা না খাওয়া উচিত, এতে অ্যাসিডিটি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- দুধের শিশুদের বা ১-২ বছর বয়সী শিশুকে কমলা বা কমলার রস না খাওয়ানোই ভালো।
- দিনে একটার বেশি কমলা না খাওয়া উচিত।
- কমলা খাওয়া গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মহিলাদের জন্য উপকারী। তবে সীমিত পরিমাণে ব্যবহার করা উচিত, অন্যথায় এটি শরীরের ক্ষতি করতে পারে।
শেষ কথা, Conclusion
উপরিউক্ত আলোচনার কমলার বিভিন্ন উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আমাদের ত্বক সহ দেহের সুস্থতার ক্ষেত্রেও যথেষ্ট উপকারী এই গোলাকার রসালো ফল টি। তবে কমলা খাওয়ার ফলে যদি কারও স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কোনও অনিয়ম হয়, তাহলে অবিলম্বে আপনারা এই ফল সেবনের পরিমাণ সীমাবদ্ধ করুন এবং প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করুন।