সকলের অতি পছন্দের রসালো একটি ফল হল আনারস। এটি মূলত গ্রীষ্মকালীন ফল, যা খেতে সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর। খুবই জনপ্রিয় একটি ফল হল আনারস। আনারস খেতে যেমন সুস্বাদু, তেমনি পুষ্টিগুণেও ভরপুর। আজকের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমরা আনারস খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো এবং পাশাপাশি এর অপকারিতা সম্পর্কেও তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
আনারসে উপস্থিত পুষ্টিগুণ, Nutrient facts of pineapple
আনারস হল এক প্রকারের গুচ্ছফল। এর বৈজ্ঞানিক নাম হল Ananas comosus (L.) Merr। এই রসালো ফলের আদি জন্মস্থল হল দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বের সর্বত্রই এর চাষ হয়। আনারসের মধ্যে বেশ কিছু পুষ্টিগুণ আছে যা আমাদের দেহের জন্য খুব উপকারী। সেগুলি হল : ক্যালোরি, ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন সি, ভিটামিন বি ৬, ফ্যাট, প্রোটিন, ফাইবার, কার্বোহাইড্রেট, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড, আয়রন, ভিটামিন এ, ভিটামিন কে, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম ইত্যাদি।
আনারস খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত, Benefits of eating pineapple
আনারস খাওয়ার বহু উপকারিতা রয়েছে; কারণ আনারস আমাদের থাইরয়েড গ্রন্থির স্ফীত হওয়া প্রতিরোধ করে, আর্থরাইটিস উপশমে সহায়তা করে, ক্ষুদ্রান্ত্রের জীবাণু ধ্বংসে উপকারী, পাশাপাশি কোষ্ঠকাঠিন্য কমায়। তাছাড়া জরায়ু, স্তন, ফুসফুস, অন্ত্র ও ত্বকের ক্যানসার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক কথায়, দেহের পুষ্টি সাধন এবং দেহকে সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত রাখার জন্য এটি একটি অতুলনীয় এবং কার্যকর ফল।
আনারস খেলে দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় :
আনারসের মধ্যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে, যা আমাদের শরীরকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে, তাছাড়াও এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আমাদের শরীরকে কঠোর পরিস্থিতিতে সুস্থ থাকতে সহায়তা করে, সহজভাবে বলতে গেলে আনারস আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি হতে সাহায্য করে।
সর্দি-কাশি হলে আনারস খাওয়া উচিত :
কেউ যদি সর্দি-কাশিতে ভোগেন তবে তাড়াতাড়ি সুস্থ হবার জন্য আনারস খেতে পারেন, কারণ এর মধ্যে আছে ব্রোমেলিন, যা একটি এনজাইমার। এটি দেহের অভ্যন্তরীণ সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলতেও সাহায্য করে। তাই নিয়মিত আনারস খেলে সর্দি কাশি থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।
হাড়ের উন্নতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে আনারস :
আনারস খেলে আমাদের হাড় শক্ত হয়, কারণ এই রসালো ফলের মধ্যে আছে ক্যালসিয়াম, যা আমাদের হাড়ের গঠনে তথা শক্ত রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ওজন কমানোর জন্য আনারস খেতে পারেন :
আনারস ওজন কমাতে সাহায্য করে। কাঁচা আনারসের রস চর্বি জমতে বাধা দেয়, তাই ওজন কমানোর ক্ষেত্রে এটি বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারে।
ক্যান্সারের ঝুঁকি কম করতে সহায়তা করে :
আনারসের মধ্যে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও এই ফলের মধ্যে এমন কিছু যোগ উপস্থিত যা অক্সিডেটিভ ট্রেস ও প্রদাহ কম করে। এই যৌগগুলির মধ্যে একটি এনজাইম হল ব্রোমেলাইন, যা ক্যান্সার কোষ হত্যা করতে পারে এবং শ্বেত রক্তকণিকার কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
আনারস হজম প্রক্রিয়া উন্নত রাখতে সাহায্য করে :
আনারসের মধ্যে আছে ব্রোমেলাইন নামক হজম সহায়ককারী এনজাইম যা প্রোটিন ভেঙে দেয় ফলে সহজে খাবার হজম হয়ে যায়। বিশেষ করে যাদের অগ্নাশয়ে অপ্রতুলতা আছে তাদের ক্ষেত্রে আনারস খুবই উপকারী।
চোখের জন্য আনারস খুবই উপকারী :
আনারস খেলে আমাদের চোখের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, আনারস আমাদের ম্যাক্যুলার ডিপ্রেশন হওয়া থেকে রক্ষা করে। উক্ত রোগটি হলে চোখের ভিতরে থাকা রেটিনা নষ্ট হয়ে যায় এবং ফলস্বরূপ মানুষ ধীরে ধীরে অন্ধ হয়ে যায়। যেহেতু আনারসে বিটা ক্যারোটিন থাকে, তাই প্রতিদিন আনারস খাওয়ার ফলে ম্যাকুলার ডিপ্রেশন হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৩০% পর্যন্ত কম হয়ে যায়।
ব্রণ ও দাগ কম করতে সাহায্য করে আনারস :
আনারসের মধ্যে ভিটামিন সি প্রচুর পরিমাণে থাকে যা ত্বকের সুস্থতার জন্য অত্যন্ত উপকারী। তাই আনারস খেলে দেহে ভিটামিন সি এর চাহিদা পূরণ হয়, ফলে মুখের দাগ এবং ব্রণ দূর হয়।
আমাদের শরীরে পুষ্টির অভাব পূরণ করে আনারস :
আনারস বিভিন্ন পুষ্টিগুনে ভরপুর, কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস ইত্যাদি আছে, আর আমরা সকলেই জানি যে এইসব উপাদান আমাদের দেহে পুষ্টিগুণের অভাব পূরণ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাই আনারস আমাদের শরীর সুস্থ ও হাইড্রেটেড রাখতে সহায়ক।
কৃমিনাশক হিসেবেও খেতে পারেন আনারস :
অনেকেরই কৃমির সমস্যা থাকে। সেক্ষেত্রে আনারস কৃমির সমস্যা সমাধান করতে সহায়তা করে, কারণ আনারসের রস কৃমিনাশক হিসেবে খুব ভালো কাজ করে। তাই যদি নিয়মিত কিছুদিন আনারসের রস খাওয়া যায়, তাহলে কিছুদিনের মধ্যেই কৃমির উৎপাত কম হয়ে যাবে।
আনারসের অপকারিতা সম্পর্কে জেনে নিন, Disadvantages of eating pineapple
অনেকের প্রিয় ফল আনারস, আবার অনেকেই আছেন যারা এই ফল খেতে পছন্দ করেন না। অনেকে এমনও আছেন যাদের আবার আনারসে অ্যালার্জি আছে। তবে যদি কারো অ্যালার্জির সমস্যা থাকে তবে আনারস খেলে আপনার ত্বকের উপরে চুলকানি বা ফুসুরি ইত্যাদি দেখা যেতে পারে। তাছাড়া আনারসের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে প্রাকৃতিক চিনি বা শর্করা থাকে, যা সুগারে আক্রান্ত রোগীদের জন্য ক্ষতিকর, তাই তাদের আনারস না খাওয়াই ভালো।
খালি পেটে আনারস খেলে পেট ব্যথা হতে পারে। অন্যদিকে রক্ত তরল করার জন্য যে সব ওষুধ বানানো হয়, সেগুলোর বেশ কিছু ওষুধের মধ্যে আনারস ব্যবহার করা হয়। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে আনারস দেহের রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াতে বাঁধা দিতে পারে । তাই যাদের আনারস খেলে এরকম সমস্যায় ভোগেন তারা আনারস থেকে দূরে থাকাই উত্তম। তবে একটা বিষয় জেনে রাখা ভালো যে আনারস আমাদের দাঁতের জন্য ক্ষতিকর। যদি কারো দাঁতে কেভিটিস ও জিংজাইভেটিভস এর মত সমস্যা থাকে তবে তাদের আনারস না খাওয়াই উচিত।
আনারস সম্পর্কে বিশেষ কিছু তথ্য, Interesting facts about pineapple
• খালি পেটে আনারস খাওয়া উচিত নয়। নয়তো পেটের ব্যথা অথবা গ্যাস অম্বল হতে পারে, কারণ আনারস হল একটি অ্যাসিডিক ফল। তবে খাবার খাওয়ার পর অর্থাৎ ভরা পেটে আনারস খেলে গ্যাস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
• অনেকেই আনারস পছন্দ করে, কিন্তু পছন্দের ফল বলে একসাথে বেশি আনারস খাওয়া উচিত না, কারণ এই ফলের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে সুগার থাকে, তাই বেশি আনারস খেলে আমাদের রক্তের শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে, ফলস্বরূপ ডাইবেটিস বা সুগার হওয়ার সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পাবে।
• এই বিষয়ে অনেকেই হয়তো জানেন না যে গর্ভাবস্থায় আনারস খেলে ভ্রুনের ক্ষতি হতে পারে, তাই কোনো গর্ভবতী নারীদের আনারস না খাওয়াই উচিত।
• আনারস ওজন কম করতে সহায়ক। কেননা কাঁচা আনারসের রস দেহে চর্বি জমার বিরুদ্ধে লড়াই করে।
উপসংহার, Conclusion
টাটকা আনারসের জুস শরীরের ক্লান্তি দূর করে ঝরঝরে করে তুলে। তাই এই রসালো ফল খেলে সারাদিন সুস্থ বোধ হয়। তবে অনেকের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যাও দেখা দেয়। তাই সব কিছু জেনে বুঝে সঠিক পরিমাণে আনারস খাওয়া উচিত, কারণ অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। আশা করি আজকের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আপনারা আনারস খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানতে পেরেছেন, পাশাপাশি এর অপকারিতা সম্পর্কেও অবগত হয়েছেন।