বাঙালিদের খাবারে আলু না থাকলে ঠিক যেন জমে না। হোক সে মাছের ঝোল কিংবা আলু দিয়ে সবজি রান্না। আলু ছাড়া খাবার ভাবাই যায় না। সব তরকারিতেই কয়েক টুকরো আলু দিয়ে দিলে যেন স্বাদ কয়েক গুণ বেড়ে যায় । তাছাড়া আলু দিয়ে হরেক রকম সুস্বাদু খাবারও খুব সহজেই তৈরি করে নেওয়া যায়। তবে অনেকেই ভাবেন যে তারা আলু খেলেই মোটা হয়ে যাবেন। আসলেও কি তাই? জেনে নেব আজকের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে। আজকের এই পোস্টে আলুর উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
আলু সম্পর্কে বিশেষ কিছু তথ্য, valuable information about Potato
আলু হল সোলানেসি নামক নাইটশেড পরিবারের বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। আলু বিভিন্ন রঙ, আকার এবং আকৃতিতে দেখা যায়। সারা বিশ্বে এখন ৫০০০ এরও বেশি জাতের আলু রয়েছে, বিভিন্ন স্থানে এগুলো চাষ করা হয়। পেরুর ইনকা ইন্ডিয়ানরা প্রথম আলু চাষ করতে শুরু করেছিলেন 8,000 খ্রিস্টপূর্বাব্দের সময় থেকে। আলু বিভিন্ন প্রকারের হয়, যেমন : রাসেল আলু, সাদা আলু, রাঙা আলু, ফিঙ্গারিং আলু, বেগুনি আলু, হলুদ আলু, ছোটো আলু ইত্যাদি।
আলুর পুষ্টিগুণ, Nutrient facts of potato
আমাদের দেহের সুস্থতার জন্য জরুরী বহু পুষ্টি উপাদান আলুর মধ্যে বর্তমান। তাই আলু খেলে আমাদের দেহের পুষ্টির চাহিদা মিটবে এবং আমরা বিভিন্নভাবে এর উপকারিতা পেতে পারি। তবে আগে জেনে নেওয়া জরুরী যে আলুতে কি কি পুষ্টি উপাদান থাকে।
• ১০০ গ্রাম আলুর পুষ্টিগুণ:
• ক্যালরি :৯০
• ফ্যাট: ০.১ গ্রাম
• পটাশিয়াম: ১৭%
• ম্যাঙ্গানিজ: ১০%
• ম্যাগনেসিয়াম :৮%
• প্রোটিন: ২.৫ গ্রাম
• কার্বোহাইড্রেট: ২৮.৬ গ্রাম
• ফাইবার: ২.৮ গ্রাম
• ভিটামিন সি: ১৮%
• ভিটামিন বি ৬: ১৮%
• নিয়াসিন:৮%
• ফসফরাস: ৮%
• শর্করা :১৯ গ্রাম
• ভিটামিন এ : ৪০ ইউনিট
• আয়রন : ০.৭মিলিগ্রাম
• ক্যালসিয়াম : ০.১১ মিলিগ্রাম
আলুর উপকারিতা, Benefits of potato
আলু খাওয়া নিয়ে অনেকের মনেই বিভিন্ন রকম সংশয় থাকে। বিশেষ করে মোটা হয়ে যাওয়ার ভয় তো বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই বর্তমান। তবে অনেকেই হয়তো আলু খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না। আসুন তবে বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক আলুর উপকারিতা সম্পর্কে।
১. ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে আলু।
অনেকেই ত্বকের যত্নে ঘরোয়া উপকরণ ব্যবহার করতে পছন্দ করেন, কারণ বাজারজাত বিভিন্ন প্রোডাক্ট অনেক সময় আমাদের ত্বকের ক্ষতি করে। সেক্ষেত্রে আলুর ব্যবহার করা যেতে পারে, কারণ আলুর মধ্যে ভিটামিন সি রয়েছে, যা ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। ভিটামিন C ত্বকের ক্ষতি রোধ করার ক্ষেত্রে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। অন্যদিকে কোলাজেন হল ত্বকের সুস্থতার সহায়ক, ভিটামিন সি কোলাজেন ও ত্বকের গঠন উন্নত করতে সহায়ক, ফলে সহজে বলিরেখা দেখা দেয় না।
২. আলু উচ্চ রক্তচাপ কম করতে সহায়ক।
আমাদের মধ্যে অনেকেই জানেন যে আলু উচ্চ রক্তচাপ কম করতে সাহায্য করে। যে সকল ব্যক্তি উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যায় ভুগছেন তাদের জন্য আলু খুবই উপকারী, কারণ, আলুর মধ্যে আছে পটাশিয়াম, যা আমাদেরকে হাইপারটেনশন থেকে দূরে রাখে, ফলে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা অনেকটাই কমে যায়।
৩. আলু খাবার হজম করতে সাহায্য করে।
আলুর মধ্যে ফাইবার থাকে, যা হজম শক্তি বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে।
৪. রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়ক আলু।
আলুর মধ্যে আছে প্রতিরোধ স্টার্চ যা তন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার পুষ্টির উৎস। স্টার্চ রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ উন্নত করে ও স্বাস্থ্য সুবিধার সাথে যুক্ত থাকে। ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির স্টার্চ যুক্ত খাবার খাওয়া দরকারি যা আর কিনা রক্তের শর্করা কে নিয়ন্ত্রণ করে।
৫. আলু ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে সাহায্য করে।
আলু ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে দেয়, তবে এর জন্য কিভাবে আলুর ব্যবহার করতে হবে সেটা জেনে নিতে হবে। আলুর পেষ্ট তৈরি করে মধুর সঙ্গে ভালো করে মিশিয়ে নেওয়ার পর সেটা নিয়মিত মাখলে ত্বকের উজ্জ্বলতা বেড়ে উঠবে। আলুর মধ্যে থাকা খনিজ, যথা পটাশিয়াম, জিংক, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস ইত্যাদি ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ানোর কাজ করে।
৬. আলু ওজন বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
অনেকের মনেই প্রশ্ন থাকে যে আলু আদৈ ওজন বাড়িয়ে দেয় কি না ! তবে এর উত্তর হবে, হ্যাঁ, আলু আমাদের শরীরে ওজন বাড়াতে সাহায্য করে। যেহেতু আলুর মধ্যে আছে কার্বোহাইড্রেট, সেহেতু যে সব ব্যক্তির ওজন কম, তাদের জন্য আলু খুবই উপকারী।
৭. পেটের জ্বালাপোড়া হওয়ার সমস্যা থেকে মুক্তি দেয় আলু।
আলু পটাশিয়াম, ভিটামিন B6, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ, যা আমাদের পাচনতন্ত্রের সমস্যা দূর করে এবং পেটে জ্বালা পোড়ার অনুভূতি থেকে মুক্তি দেয়। গেটে বাত ও আর্থ্রাইটিসের ক্ষেত্রেও রোগীরা আলুর পুষ্টিগুণ থেকে বেশ উপকার পেয়ে থাকেন।
৮. দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কম করে দেয় আলু।
আলু আমাদের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। আলুর মধ্যে থাকা ক্যারোটিনয়েড, ফ্ল্যাভোনয়েড এবং ফেনোলিক অ্যাসিড দেহের ক্ষতিকর অনুগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং আমাদের শরীরে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। যখন আমাদের শরীরে ফ্রি রেডিক্যাল জমা হয় তখন সাধারণত ডায়াবেটিস তথা ক্যান্সারের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগগুলির ঝুঁকি বেড়ে যায়। আলুতে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট থাকে যা এইসব দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি কম করতে সাহায্য করতে পারে।
৯. আলু কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।
আলুতে থাকে ফাইবার, তাই আলু খেলে কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যা দূর হয়।
১০. আলু পাথর হওয়া বন্ধ করে
সাধারণত বেশি প্রোটিনযুক্ত খাবার খাওয়ার ফলে আমাদের কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা বেড়ে যায়, কারণ হাই-প্রোটিন যুক্ত খাবার আমাদের শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু এইসব সমস্যার সমাধান করতে আলু খাওয়া উচিত, কারণ আলুর মতো মূল জাতীয় সবজি প্রোটিনের প্রভাবে সৃষ্ট পাথরগুলোকে কিডনিতে জমতে বাধা দেয়। আলুর মধ্যে থাকা ম্যাগনেসিয়াম কিডনিতে ক্যালসিয়াম জমে পাথর হওয়া থেকে আটকানোর ক্ষেত্রে দারুন ভালো কাজ করে।
আলুর অপকারিতা, Disadvantages of eating potato
শুধু উপকারিতা সম্পর্কে জানাই যথেষ্ট নয়, যেকোনো উপকারী খাবার খাওয়ার অপকারিতা সম্পর্কেও অবগত থাকা জরুরি। কথায় আছে সাবধানতার কোনো মার নেই। তাই আলুর খাওয়ার অপকারিতা কি তাও বুঝতে হবে। অপকারিতা ব্যাপারে প্রথমেই বলতে হয় যে, আলুর মধ্যে আছে হাই গ্লাসেমিক, যা আমাদের রক্তে থাকা শর্করার মাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
প্রতিদিন যদি কেউ বেশি পরিমাণে আলু খায় তবে রক্তের শর্করা এবং ইনসুলিনের মাত্রা বেড়ে যাবে। ফলে ডায়াবেটিস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। তাই কেউ যদি ডায়াবেটিস রোগী হন তবে তাদের আলু খাওয়া কম করে দেওয়া উচিত। আলু যদি কুঁচকে যায় বা আলুর কোনো অংশ সবুজ থাকলে, অথবা অঙ্কুরিত আলুর মধ্যে সোলানিন নামক একটি বিষাক্ত যৌগ থাকে, যা রক্তের সঞ্চালনে বাধা তথা শ্বাসকষ্টের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, তাছাড়াও এর প্রভাব মাথাব্যথা বা অনেক সময় ডায়রিয়াও হতে পারে। অন্যদিকে স্থূলতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের আলু এড়িয়ে চলা ভালো। তাদের ক্ষেত্রে আলু খেলেও পরিমাণ মতো খাওয়াই উচিত।
পরিশেষে, Conclusion
অন্য সবার থেকে বাঙ্গালীদের কাছে আলুর গুরুত্ব খুব বেশি। যেমন রান্নার ক্ষেত্রে বলা যায় যে আলু যেন একদম দৈনন্দিন সাথী। তবে আরো বিভিন্নভাবে আলু ব্যবহার করা হয়। আজকের এই প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে আমরা আলুর উপকারিতা এবং অপকারিতা সম্পর্ক জেনে নিলাম। তবে আলুর ভালো দিক খারাপ দিক বিচার করে পরিমাণ মতো খাওয়াই উত্তম।