টমেটো মূলত শীতের ফল, তবে এখন সারা বছরই এটি বাজারে পাওয়া যায়। তবে শীতের সময় ফলন হওয়া এই সবজির স্বাদই আলাদা। সালাদ হিসেবে হোক কিংবা রান্না করা টমেটো, দুটোই খুব সুস্বাদু। যেকোনো সবজি তরকারিতে টমেটো যেন স্বাদ বর্ধকের কাজ করে। বেশিরভাগ মানুষই টমেটো খেতে পছন্দ করেন। তবে এটি খেলে কি কি উপকার পাওয়া যায় তা হয়তো অনেকেরই অজানা। তবে শুধু উপকারই নয়, এটি খাওয়া কারও ক্ষেত্রে অপকারীও হয়ে উঠতে পারে। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা টমেটোর উপকারিতা ও অপকারিতা নিয়ে আলোচনা করবো।
টমেটো তে থাকা উপকারী উপাদান, Beneficial ingredients in tomatoes
টমেটো আমরা সব ভাবেই খেয়ে থাকি। কেউ কাঁচা খেতে পছন্দ করে কেউ সালাদের সাথে। যেভাবেই খেয়ে থাকুক না কেন টমেটোর উপকারিতা সব জায়গাতেই আছে। টমেটোতে থাকে ভিটামিন A কে, B1, B3, B5, B6, B7 ও ভিটামিন C সহ নানা প্রাকৃতিক ভিটামিন। এ ছাড়া এতে আছে ফোলেট, আয়রন, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্রোমিয়াম, কোলিন, কপার এবং ফসফরাসের মতো খনিজ। টমেটোতে লাইকোপিনও পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যায়। এর পাশাপাশি এতে পর্যাপ্ত পরিমাণে কোলেস্টেরল কমানোর মত উপকারী উপাদানও থাকে। তবে টমেটোর সবচেয়ে ভালো বৈশিষ্ট্য হল এটি রান্না করার পরেও এর পুষ্টিগুণ বজায় থাকে।
টমেটো খাওয়ার উপকারিতা, benefits of eating tomatoes
নিয়মিত টমেটো খাওয়ার বেশ কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে, সেগুলি হল :
- ১. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হলে অবশ্যই টমেটো খেতে পারেন। ভিটামিন C সমৃদ্ধ টমেটো আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক এবং স্ট্রেস হরমোনও কমায়। এ কারণে নিয়মিত টমেটো খাওয়ার অভ্যাস করলে শরীরের শক্তি বাড়ে এবং শরীর সুস্থ থাকে।
- ২. শরীরের রক্তশূন্যতা দূর করতেও কার্যকরী ভূমিকা পালন করে টমেটা। কোনো ব্যক্তি যদি নিয়মিত দু-একটি করে টমেটো খায় তবে তার শরীরে রক্তের কণিকা বৃদ্ধি পায়, ফলে রক্তশূন্যতা রোধ হয়। এ ছাড়া টমেটো রক্ত পরিষ্কার করার কাজ করে, পাশাপাশি হজমে সহায়তা করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
- ৩. টমেটোতে থাকে লাইকোপিন, যা ত্বকের ক্লিনজার হিসেবে কাজ করে। আমাদের ত্বক পরিষ্কার করা ও ত্বককে সতেজ রাখতে সহায়তা করে টমেটো।
- ৪. টমেটোতে থাকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন K এবং ক্যালসিয়াম। গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রতি ১০০ গ্রাম টমেটোতে ১১০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে। এই কারণে কেউ যদি নিয়মিত টমেটো খায় তবে তার হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। তাছাড়া দাঁতের সুস্থতার জন্যও উপকারী।
- ৫. টমেটো হল ভিটামিন A এবং ভিটামিন C এর ভালো উৎস, আর এই দুটি উপাদান শরীরকে ক্ষতিকারক ফ্রি র্যাডিক্যাল থেকে মুক্তি দিতে সহায়তা করে, ফলে শরীর সুস্থ থাকে।
- ৬. টমেটোতে থাকা ভিটামিন A এবং ভিটামিন B এবং পটাশিয়াম আমাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। সেই সঙ্গে রক্তচাপও নিয়ন্ত্রণে রাখতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
- ৭. টমেটোতে থাকে ক্রোমিয়াম নামক এক ধরনের খনিজ যা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। তাই এটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও উপকারী ফল হিসেবে বিবেচিত।
- ৮. টমেটোতে থাকা বিভিন্ন উপকারী উপাদানের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ২টি উপাদান হলো ভিটামিন C ও আয়রন, যা গর্ভাবস্থায় খুবই উপকারী। তাই গর্ভবতী মহিলাদের টমেটো খাওয়া উচিত।
- ৯. টমেটো ধূমপানজনিত ক্ষয় পূরণে সহায়তা করে। যারা ধূমপানের আসক্তির কারণে বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন তাদের অবশ্যই টমেটো খাওয়া উচিত, কারণ এতে থাকা কিউম্যারিক এ্যাসিড ও ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড ধূমপান জনিত ক্ষতিপূরণে সাহায্য করে। এক কথায় যারা ধূমপান করেন তাদের জন্য টমেটো উপকারি একটি খাদ্য।
- ১০. টমেটোতে প্রচুর পরিমানে ফাইবার থাকায় এটি কোষ্ঠকাঠিন্যজনিত সমস্যা দূর করেতে সাহায্য করে। তাই যাদের এধরনের সমস্যা রয়েছে তারা প্রতিদিন খাবার তালিকায় টমেটো রাখতে পারেন।
- ১১. টমেটো ক্যানসার প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। টমেটোতে থাকা লাইকোপেন ক্যান্সারের কোষ বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। তাই সপ্তাহে ১০টি বা তার থেকে বেশি টমেটো খাওয়া উচিত, এতে ক্যানসারের আশঙ্কা অনেকটা কমে যায়।
- ১২. টমেটোতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন A থাকে, তাই নিয়মিত টমেটো খাওয়ার ফলে আমাদের চোখের দৃষ্টি খুবই ভালো থাকে। এক কথায় টমেটো চোখ সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
ত্বকের যত্নে টমেটো, tomatoes for skin care
- ত্বকের যত্নে অনেকেই টমেটোর ব্যবহার করে থাকেন। রূপচর্চায় বিভিন্নভাবে টমেটোর ব্যবহার করা যায়। যেমন :
- টমেটোর রস রোজ স্নানের আগে মুখে, গলায় ও ঘাড়ে লাগিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দিন, তারপর জল দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে নিন। এতে রোদে পোড়া দাগ ছোপ দূর হয়ে যাবে।
- একটি টমেটো অর্ধেক কেটে নিয়ে একটি টুকরোর কাটা অংশের দিকে অল্প চিনি দিয়ে মুখে ভালোভাবে ঘষুন। এটি প্রাকৃতিক স্ক্রাবারের কাজ দেবে।
- টমেটোর রসের সঙ্গে বাদাম দুধ মিশিয়ে নিয়ে ত্বকে ভালোভাবে লাগিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দিন। তারপর জল দিয়ে ধুয়ে নিন। এতে ত্বকের পোড়া ভাব দূর হবে।
- শসার রস ও একটা টমেটোর রস ভালোভাবে মিশিয়ে নিয়ে টোনার হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন। মিশ্রণটা রেফ্রিজারেটরে চার দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা সম্ভব।
- উজ্জ্বল ত্বক পেতে টমেটোর রসের সাথে মধু যোগ করুন। এই মিশ্রণটি ভালোভাবে মুখে লাগিয়ে রাখুন এবং ১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। এতে ত্বক উজ্জ্বল হওয়ার পাশাপাশি বলিরেখার সমস্যাও কম হয়ে যাবে।
- যদি আপনার ত্বক তৈলাক্ত হয় এবং ত্বকের তেলতেলে ভাব নিয়ে আপনি সমস্যায় ভোগেন তবে টমেটো আপনাকে এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারে। এর জন্য একটা ফ্রেস টমেটো চটকান এবং এর সাথে শসার রস যোগ করুন। এই মিশ্রণটি লাগিয়ে ১৫ মিনিট রেখে ধুয়ে ফেলুন। এতে মুখের তেল তেল ভাব নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
তবে সাবধান থাকবেন যদি টমেটো লাগানোর ফলে ত্বকে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তবে সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডা জল দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন। টমেটো লাগানোর ফলে যেসব সমস্যা দেখা দিতে পারে সেগুলি হল :
- ত্বক রুক্ষ-শুষ্ক হয়ে যায়।
- ত্বকে জ্বালা বা অস্বস্তি হতে পারে।
- সারা মুখ লাল ব়্যাশে ভরে যেতে পারে।
- ত্বকে লালভাব দেখা দেয়।
- একদিন পর ত্বকের নানা স্থানে কালচে ছোপও দেখা যেতে পারে।
টমেটো খাওয়ার অপকারিতা, Disadvantages of eating tomatoes
টমেটো খাওয়ার ব্যাপারে যদিও তেমন বেশি সতর্কতা নেই। তবে অরিরিক্ত কোন কিছুই ভালো না। তাই পরিমাণ মত খাওয়াই শ্রেয়। যদিও টমেটোতে অ্যালার্জি হাওয়া একটি বিরল ব্যাপার, তবে অনেকের ক্ষেত্রে টমেটো খাওয়ার ফলে শ্বাস-প্রশ্বাসের অ্যালার্জিজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এছাড়াও যারা হৃদরোগের ঔষধ সেবন করে থাকেন তাদের ডাক্তার সাথে পরামর্শ করেই টমেটো খাওয়া উচিত। অন্যদিকে কারো যদি কিডনিজনিত সমস্যা থাকে তবে তারাও টমেটো খাওয়ার পূর্বে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নেওয়া উচিত। পরবর্তীতে কোনো সমস্যা হওয়ার চাইতে আগেই সাবধান থাকা উচিত।
শেষ কথা, Conclusion
টমেটোর উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো। টমেটোতে আছে নানা পুষ্টিগুণ পাশাপাশি এর সাথে আছে কিছু সতর্কতাও। আশা করি উপরিউক্ত তথ্যগুলো আপনাদের যথেষ্ট কাজে লাগবে।