মিঠাই বা মিষ্টি কথাটি শুনলেই মনে হয় চিনির বা গুড়ের রসে ভেজানো ময়দার গোলার কথা কিংবা দুধ- চিনি একসাথে মিশিয়ে তৈরি করা বিভিন্ন আকৃতির ছানা অথবা ময়দার টুকরোর আকারে তৈরি খাবারের কথা।
বাঙালিদের খাওয়া-দাওয়ায় মিষ্টি বা মিঠাই হল একটি অতি জনপ্রিয় উপকরণ। বেশিরভাগ মানুষ খাবারের শেষে মিষ্টি জাতীয় কিছু খেতে পছন্দ করেন। বলাই বাহুল্য যে বাঙালির কোন উপলক্ষ-অনুষ্ঠানই মিষ্টি ছাড়া পূর্ণতা পায় না। মিষ্টির নাম শুনলেই বাঙ্গালীদের জিভে জল আসে। আজ এই প্রতিবেদনে এমনই কিছু মিষ্টি বা মিঠাই নিয়ে আলোচনা করবো যা বাংলাদেশে তথা বাঙালি মহলে ব্যাপক জনপ্রিয়।
ঐতিহ্যবাহী মিঠাই তৈরি, Traditional sweet making
মিঠাই নির্মাণ করা একটি বিশেষ কলা। অনেকেই হয়তো জানেন যে যারা মিষ্টি তৈরী করে তাদেরকে বলা হয় ময়রা। এলাকাভিত্তিক বহু মিঠাইয়ের প্রসিদ্ধি রয়েছে, তবে এছাড়াও ব্যক্তিগতভাবেও অনেক মিষ্টিশিল্পী বিশেষ কোনো মিষ্টি তৈরির জন্য খ্যাতিমান হয়েছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ বিশেষ কিছু মিঠাই তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেছেন সেখানকার ময়রারা। ক্রমে তাদের নিষ্ঠা ও সৃজনশীলতায় ঐতিহ্যবাহী হয়ে উঠেছে সেই সব মিঠাই। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মন্ডা :
বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলার একটি বিখ্যাত মিষ্টি হল মুক্তাগাছার মন্ডা। ১৮২৪ সালে রাম গোপাল পাল প্রথম এই মিষ্টি তৈরি করেন।
নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি :
বাংলাদেশের নেত্রকোণা জেলার একটি প্রসিদ্ধ মিষ্টি। এটি আকারে বালিশের মত বড় না হলেও দেখতে অনেকটা বালিশের মত, এবং এর উপরে ক্ষীরের প্রলেপ থাকাতে এটি আবরণীসমেত বালিশের মত দেখায়।
এই মিষ্টি গয়ানাথের বালিশ নামেও পরিচিত। নেত্রকোণা শহরের বারহাট্টা রোডের ‘গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’-এর স্বত্বাধিকারী গয়ানাথ ঘোষ শত বছরেরও বেশি সময় আগে বালিশ মিষ্টি উদ্ভাবন করেন। এই মিষ্টিতে ব্যবহৃত প্রধান উপকরণ হল ছানা, ময়দা, চিনি, ইত্যাদি। এ অঞ্চলে বালিশ মিষ্টির ঐতিহ্য নিয়ে প্রচলিত বহু ছড়া যুগ যুগ ধরে চলছে আমজনতার মুখে মুখে। এমন একটি লোকজ ছড়া হল- ‘‘জাম, রসগোল্লা পেয়ে শ্বশুর করলেন চটে নালিশ, আশা ছিল আনবে জামাই গয়ানাথের বালিশ”।
নাটোরের কাঁচাগোল্লা :
এটি বাংলাদেশের নাটোর জেলায় উৎপন্ন দুধ দিয়ে তৈরি এক প্রকার মিষ্টান্ন। এই মিষ্টান্নটি গরুর দুধ থেকে প্রাপ্ত কাঁচা ছানা থেকে প্রস্তুত করা হয় বলে এটি কাঁচাগোল্লা বলে পরিচিত। ২০২৩ সালের ০৮ আগস্ট বাংলাদেশের ১৭ নং জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে নাটোরের কাঁচাগোল্লা। নাটোর শহরের লালবাজারের মধুসূদন পাল এই মিঠাইয়ের উদ্ভাবক। কাঁচাগোল্লার স্বাদ রসগোল্লা, পানিতোয়া, এমনকি অবাক সন্দেশকেও হার মানিয়ে দেয়।
টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম :
বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ী নামক স্থানে উৎপন্ন একটি বিখ্যাত মিঠাই যা বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তান ছাড়াও সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশেই বিখ্যাত। খাঁটি চমচম তৈরির জন্য সুনাম ছিল টাঙ্গাইল শহর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরের এ গ্রাম। চমচমকে বাংলাদেশের সকল মিষ্টির রাজা বলা হয়। এটি ছানার তৈরি একপ্রকার মিঠাই। এটি প্রস্তুতের উপকরণসমূহ হলো ময়দা, ননী বা মাখন, চিনি, জাফরান, লেবুর রস, এবং নারকেল। প্রায় দু’শো বছর আগে যশোরথ হাল নামে এক কারিগর প্রথম এ মিঠাই তৈরি করেন।
কুমিল্লার রসমালাই :
ছোট ছোট আকারের রসগোল্লাকে চিনির সিরায় ভিজিয়ে তার উপর জ্বাল-দেওয়া ঘন মিষ্টি দুধ ঢেলে রসমালাই বানানো হয়। অনেকেরই এই মিষ্টি খুব পছন্দ। বলাই বাহুল্য যে বাংলাই হল এই সুস্বাদু মিঠাইয়ের উৎপত্তি স্থল। বাংলাদেশের কুমিল্লার এবং ভারতের কলকাতার রসমালাই খুবই বিখ্যাত।
নওগাঁর প্যারা সন্দেশ :
নওগাঁর প্যারা সন্দেশ বাংলাদেশের নওগাঁ জেলায় উৎপন্ন দুধ দিয়ে তৈরি এক প্রকার মিষ্টান্ন। দুধের ক্ষীর দিয়ে প্যারা সন্দেশ বানানো হয়। বর্তমানে জামালপুরের সরিষাবাড়িতে এই নামে মিষ্টি তৈরী হয়। তবে সেটার সাথে স্বাদে, আকৃতিতে, প্রস্তুত প্রণালীতে নওগাঁর প্যারা সন্দেশের কিছু অমিল আছে। প্রথম দিকে শুধু পূজা মণ্ডপের দেব-দেবীর উপাসনার জন্যই এই সন্দেশ তৈরি করা হতো। পরবর্তীতে এই সন্দেশ শুধু দেব-দেবীর আরাধনার মধ্যে সীমাবন্ধ থাকেনি। বর্তমানে দেশের গণ্ডি পেড়িয়ে প্যারা সন্দেশের সুখ্যাতি বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে।
যশোরের নলেন গুড়ের প্যারা সন্দেশ :
দুধের ছানায় নলেন গুড় মিশিয়ে তৈরি করা এই সন্দেশ ভোজন রসিকদের জিভে জল আনার মতো। যশোরের নলেন গুড়ের সন্দেশ শত শত বছর ধরে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে। এই সন্দেশের ইতিহাস অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, কলকাতার ভিমনাগ প্রথম যশোর থেকে নলেন গুড় নিয়ে তা দিয়ে সন্দেশ তৈরি শুরু করেন। এটি ১৮০০ সালের দিকের ঘটনা। বর্তমানে এটি দেশ তথা বিদেশেও বিখ্যাত।
গুঠিয়ার সন্দেশ :
বাংলাদেশের বরিশালের গুঠিয়া নামক স্থানে উৎপন্ন বিশেষ এক ধরনের সন্দেশ। গুঠিয়ার সন্দেশ ১৯৬২ সালে প্রথম প্রস্তুত করেন সতীশ চন্দ্র দাশ নামক একজন ময়রা। গুঠিয়া নামক স্থানে উৎপত্তি বলে এটি গুঠিয়ার সন্দেশ নামেই পরিচিত হয়ে ওঠে।
সিরাজদিখানের পাতক্ষীর :
বাংলাদেশের বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জ জেলার একটি জনপ্রিয় ও বিখ্যাত মিষ্টান্ন। কলাপাতায় মোড়ানো এই মিষ্টান্ন হচ্ছে সাধারণ ক্ষীরের একটি বিশেষ সংস্করণ। এই ক্ষীর তৈরি করার পর পাতায় মুড়িয়ে পরিবেশন করা হয় বলে এর নামকরণ করা হয় পাতাক্ষীর। মুঘল আমলে ঢাকাবাসীর খাদ্যতালিকায় পাতক্ষীরের নাম পাওয়া যায়। মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান উপজেলার সন্তোষপাড়া গ্রামে উৎপন্ন বিখ্যাত এ মিঠাই। সর্বপ্রথম জনৈক পুলিনবিহারী দেব তার স্ত্রীকে নিয়ে পাতক্ষীর তৈরি করেন এবং তার উত্তরসূরীরা এ ধারা অব্যহত রেখেছেন।
ময়মনসিংহের টক জিলাপি :
ত্রিশ বছর আগে বাংলাদেশের এক জিলাপির কারিগর জাকির হোসেন এই মিঠাই প্রথম তৈরি করেন, তিনি সাধারণ জিলাপিই বানাতেন। একদিন ভারী বৃষ্টি হওয়ায় কারণে বিক্রি কম হওয়ায় তাঁর সকালে জিলাপি তৈরির কিছু মণ্ড অবশিষ্ট থেকে যায়। তিনি সেই মন্ডের সাথে মাষকলাইয়ের ডাল, চালের গুড়া ও তেঁতুলের টক মিশিয়ে জিলাপি তৈরি করে তিনি তার পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে খান। তাদের প্রশংসার ফলে তিনি বাণিজ্যিকভাবে হোটেল মেহেরবানে টক-মিষ্টি জিলাপি বিক্রি করা শুরু করেন।
মেহেরপুরের সাবিত্রী মিষ্টি :
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মেহেরপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী একটি মিঠাই হল সাবিত্রী। সাবিত্রী মিষ্টির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো স্বাভাবিক তাপমাত্রায়ও এর স্বাদ দীর্ঘদিন ধরে অটুট থাকে। ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ রাজত্বকালে মেহেরপুর শহরের জনৈক বাসুদেব, সাবিত্রী নামক এ মিষ্টি তৈরি করেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানামুখী :
বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার এক বিশেষ তথা বিখ্যাত মিঠাই এটি। ছানার তৈরি চারকোণা ক্ষুদ্রাকার এবং শক্ত, এর উপর জমাটবাঁধা চিনির প্রলেপযুক্ত এই মিঠাই দেখলেই যেন মুখে জল চলে আসে।
ফেনীর খন্ডলের মিষ্টি :
এটি বাংলাদেশের ফেনী জেলার খন্ডল নামক স্থানে উৎপন্ন একটি মিষ্টি। এর বিশেষত্ব হল বাংলাদেশের অন্যান্য সব মিষ্টি ঠান্ডা বা স্বাভাবিক তাপমাত্রায় খাওয়া হলেও খন্ডলের মিষ্টি ঠান্ডা খাওয়ার পাশাপাশি গরম গরমও খাওয়া হয়। কুমিল্লার যোগল চন্দ্র দাস নামে এক ব্যক্তি এই বিশেষ মিঠাইয়ের উদ্ভাবক।
উক্ত মিষ্টিগুলো ছাড়াও বাংলার আরো বেশ কিছু জনপ্রিয় মিঠাই রয়েছে, সেগুলি হল :
- গাইবান্ধার রসমঞ্জরী
- রাজবাড়ীর চমচম
- যশোরের জামতলার মিষ্টি
- বিক্রমপুর ও কলাপাড়ার রসগোল্লা
- বগুড়ার দই (মূলত শেরপুর) ও গৌরনদীর দই
- যশোরের খেজুরগুড়ের সন্দেশ
- সিরাজগঞ্জের রাঘবসাই, পানতোয়া,ধানসিঁড়ির দই
- নওগাঁর রসমালাই
- কুষ্টিয়ার মহিষের দুধের দই
- গুলশানের সমরখন্দের রেশমী জিলাপী
- রাজশাহীর রসকদম
- চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জের আদি চমচম
- খুলনা ও মুন্সিগঞ্জের অমৃতি
- শিবগঞ্জের (চাঁপাইনবাবগঞ্জ) চমচম, প্যারা সন্দেশ
- কিশোরগঞ্জের তালরসের পিঠা (চিনির সিরায় ভেজানো)
- লক্ষ্মীপুরের রামগতির মহিষের দুধের দই
- যশোরের খেজুর রসের ভিজা পিঠা
শেষ কথা, Conclusion
মিঠাই নিয়ে লেখাগুলো পড়ে হয়তো অনেকেরই মুখে জল চলে এসেছে। আবার হয়তো উল্লেখিত বেশ কিছু মিষ্টির নাম আপনারা প্রথমবার জানতে পেরেছেন। আশা করি এই প্রতিবেদন পড়ে আপনাদের ভালো লেগেছে। এমন বিশেষ তথ্য সম্পন্ন লেখা পেতে চোখ রাখুন আমাদের ওয়েবসাইটে।