ভেটকি মাছ সম্পর্কে যাবতীয়, Details about Bhetki Fish in Bengali

ভেটকি মাছ সম্পর্কে যাবতীয়

ভেটকি বাঙালিদের মধ্যে অতি পরিচিত একটি মাছ। মাছের বাজারে গেলে কমবেশি সারা বছরই এই মাছ চোখে পড়ে। অনেকেরই প্রিয় মাছ এটি। তার কারণ এটি খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু। তাছাড়া এই মাছ দিয়ে নানা রকম পদ রান্না করা যায়। বাড়িতে কখনো ঝাল তরকারি, আবার কখনো পাতুরি। এক কথায় বাঙালির ঘরে এই মাছের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।

কিন্তু এই মাছ খেলে কী হয়? এর পুষ্টিগুণ কতটা? এসব বিষয় কি কখনও খোঁজ নিয়েছেন? না নিয়ে থাকলে আজকের এই প্রতিবেদন শেষ অবধি পড়ুন।

ভেটকি মাছের বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস, Scientific classification of Bhetki fish :

জগৎ: Animalia

পর্ব: Chordata

শ্রেণী: Actinopterygii

বর্গ: Perciformes

পরিবার: Latidae

গণ: Lates

প্রজাতি: L. calcarifer

ভেটকি মাছের বর্ণনা, Description of Bhetki fish :

ভেটকি মাছ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া যায়। এই মাছ অঞ্চল বিশেষে Sea bass এবং অস্ট্রেলিয়ায় বারামুণ্ডি (ইংরেজি: Barramundi) নামে পরিচিত। বাংলাদেশে ও ভারতে এই মাছ কোরাল ও ভেটকি এই দুই নামে পরিচিত।

ভেটকি মাছের পুষ্টি গুণাগুণ

অন্যদিকে বাংলাদেশের খুলনা অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ একে পাতাড়ি মাছও বলে। ভেটকি সাধারণত লম্বাটে ও চাপা ধরনের হয়। এদের নিচের চোয়াল উপরের চোয়ালের চেয়ে কিছুটা বড় আকারের হয়ে থাকে। এই মাছের পিঠের দিকটা কিছুটা সবুজ রঙের এবং পেটের দিক রুপালি রঙের হয়।

ভেটকি মাছের বিস্তৃতি, In which country is Bhetki fish available?

ভেটকি মাছ হল মিষ্টি জলের মাছ। এটি ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয়, বাংলাদেশ, চীন, তাইওয়ান, জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং পাপুয়া নিউগিনি প্রমুখ অঞ্চলে পাওয়া যায়। তাছাড়া এশিয়ার উত্তরাঞ্চল, কুইন্সল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চল এবং পূর্ব আফ্রিকার পশ্চিমাঞ্চলেও এই মাছ বিস্তৃত।

ভেটকি মাছের পুষ্টি গুণাগুণ, Nutritional value of Bhetki fish :

ভেটকি মাছে এমন কিছু উপাদান রয়েছে, যেগুলি শরীরের উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। আট থেকে আশি, সকলেই এই মাছ খেলে উপকার পাবেন।

এ মাছে আছে উন্নতমানের ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড, যা আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এছাড়াও, হৃদরোগের ঝুঁকি কম করে দেয় এবং রক্তের চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।

ভেটকি মাছে ভিটামিন A, B এবং D রয়েছে, পাশাপাশি খনিজ পদার্থ, ক্যালসিয়াম, জিংক, লৌহ, পটাশিয়াম, ম্যাগনিসিয়াম এবং সিলেনিয়ামও যথেষ্ট পরিমাণে থাকে। বলাই বাহুল্য যে, উক্ত উপাদানগুলো আমাদের শরীর গঠন ও বৃদ্ধির কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

ভেটকি মাছে ফ্যাট বা স্নেহজাতীয় পদার্থের পরিমাণ অত্যন্ত কম। স্যাচুরেটেড ফ্যাট নেই। কোলেস্টেরলের পরিমাণ মাত্র ৭০ মিলিগ্রাম। তাই ব্যালান্সড ডায়েটে রাখতেই পারেন এই মাছ।

ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিডের গুরুত্বপূর্ণ ভাণ্ডার ভেটকিমাছ। এই উপাদানটি ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমিয়ে হৃদরোগ, ক্যানসার এবং অন্যান্য মস্তিষ্কের অসুখের আশঙ্কা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

এই মাছের কিছু উপাদান দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি করতে এবং গাঁটের ব্যথা কমাতেও সাহায্য করে। তাই সব মিলিয়ে ভেটকিকে মহৌষধি হিসাবেও ধরা হয়।

ফ্যাটি অ্যাসিডের গুরুত্বপূর্ণ ভাণ্ডার ভেটকিমাছ

কিছু কিছু নিউরোলজিস্ট- এর ধারণা অনুযায়ী, যদি ছোট বেলা থেকে ভেটকি মাছ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন, তবে তা বাচ্চাদের মানসিক বিকাশ ঘটাতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ভেটকি মাছের চাষ পদ্ধতি, Bhetki Fish farming method :

ভেটকি মাছের কাঁটা কম, তাই দেশে-বিদেশে এর চাহিদা প্রচুর। এর কারণ অনেকেই আছেন যারা কাঁটার ভয়ে মাছ খেতে চান না। কিন্তু খেতে সুস্বাদু এবং কম কাঁটা যুক্ত এই মাছ অনেকেরই পছন্দের তালিকায় আছে। বলাই বাহুল্য যে, উপকূলীয় অঞ্চলে ভেটকি চাষের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

দেখা গেছে যে, বাংলাদেশে স্বাদুপানি এবং উপকূলীয় অঞ্চলের আধা-লবণাক্ত ও লবণাক্ত জলে ভেটকি চাষ করা যায়। অন্যদিকে, দেশে ও বিদেশে এই মাছের প্রচুর চাহিদা থাকার কারণে এর উৎপাদন ও রপ্তানির সুযোগও ক্রমে বেড়েই চলছে।

ভেটকি মাছ লবণাক্ততা সহিষ্ণু হওয়ার ফলে এটি নদী, নদীর মোহনা এবং উপকূলীয় এলাকার জলাভূমিতে খুব সহজেই চাষ করা যায়। মাছগুলো সহজেই জলে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।

তাছাড়া এদের বেশি ঘনত্বেও চাষ করা যায়। অন্যদিকে ভেটকির বৃদ্ধির হারও বেশি হয়। প্রতি ৬ মাস থেকে ২ বছরের মধ্যে এদের প্রতিটির ওজন ৩৫০ গ্রাম থেকে ৩ কেজি পর্যন্ত হয়। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে এ মাছের চাহিদা বেশি, তাই বর্তমান সময়ে বিভিন্ন স্থানে যেমন বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট প্রমুখ অঞ্চলে এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এর চাষ হচ্ছে।

ভেটকি মাছের প্রজনন, Breeding of Bhetki :

ভেটকি মাছের প্রজনন

ভেটকি সারা বছর ডিম পাড়ে। তাই প্রায় সারাবছর এগুলো বাজারে দেখা যায়। তবে এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস এদের মূল প্রজননকাল হিসেবে বিবেচিত হয়। এ সময় নদী বা জলাশয় থেকে এক সেন্টিমিটার আকারের অনেক পোনা ধরা পড়ে।

প্রজননের বিষয়টা আরেকটু খোলসা করে বলতে গেলে, বর্ষার শুরুতে পুরুষ ভেটকি স্ত্রী ভেটকির সাথে মিলেনের জন্য নদ-নদীর নিম্ন অববাহিকায় আসে। ভরা পূর্ণিমা এবং অসাবস্যার শুরুতে জোয়ারের জল আসার সময় ৫ কেজি থেকে ১০ কেজি ওজনের প্রতিটি স্ত্রী ভেটকি ২১ লাখ থেকে ৭১ লাখ পর্যন্ত ডিম পাড়ে।

তারপর এই ডিমগুলো এবং রেণু পোনা জোয়ারের জলে ভেসে নদীর মোহনায় চলে আসে। রেণু পোনাগুলো মোহনা থেকে ক্রমে নদীর উচ্চ অববাহিকার দিকে ভেসে আসে। পরে এগুলো যখন পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় পৌঁছায় তখন সেগুলো আবার ডিম পাড়ার জন্য সাগরের দিকে ফিরে যায়।

ভেটকি মাছের একটা অসাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো এই যে, বেশির ভাগ মাছ পুরুষ মাছ হিসেবে প্রাপ্ত বয়স্ক হলেও যদি স্ত্রী মাছের প্রাপ্যতা কম থাকে তবে একটি প্রজনন ঋতুর পর তারা লিঙ্গ পরিবর্তন করে নিয়ে স্ত্রী মাছ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।

ভেটকির পোনাদের প্রাকৃতিক উৎস হল সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল, এদের নদীর মোহনায় সংগ্রহ করা গেলেও বছরের বিভিন্ন সময় এগুলো একই পরিমাণ পাওয়া যায় না। তাই ভেটকি চাষাবাদে বাধা পাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।

তাছাড়া প্রাকৃতিকভাবে যদি পোনা কম পাওয়া যায় তবেই এ মাছের চাষ ঝুঁকির সম্মুখীন হতে পারে। এক্ষেত্রে কৃত্রিমভাবে পোনা উৎপাদন একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।

১৯৭১ সালে থাইল্যান্ডে ভেটকি মাছের কৃত্রিম প্রজনন শুরু হয়। তারপর বদ্ধ পরিবেশে হরমোন ব্যবহারের মাধ্যমে ১৯৭৩ সালে ভেটকি মাছের কৃত্রিম প্রজননে সাফল্য অর্জিত হয়। ১৯৮১ সালে বিজ্ঞানীরা কৃত্রিমভাবে পোনা উৎপাদনে সফল হন।

আজকাল বাংলাদেশেও ভেটকি মাছের কৃত্রিম প্রজনন করা হচ্ছে। এমনকি মাছের পোনা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রিও করা হচ্ছে। ভেটকি মাছ মূলত জীবন্ত মাছ ও চিংড়ি খেয়ে জীবন ধারণ করে। কিন্তু কৃত্রিম প্রজননের ক্ষেত্রে তাদের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের মাধ্যমে এদের সম্পূরক খাদ্যে অভ্যস্ত করা হয়।

ভেটকি মাছের চাষ পদ্ধতি

শেষ কথা, Conclusion :

‘ মাছে ভাতে বাঙালি ‘ কথাটি সকলেই শুনেছেন, তাই বেশিরভাগ বাঙালির খাবারে মাছের গুরুত্ব লক্ষণীয়। যখন মাছ হয় ভেটকি, যা খেতেও সুস্বাদু এবং শরীরের জন্য উপকারী তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই।

সামুদ্রিক যেকোন মাছের স্বাদের থেকে উপকারিতা অনেক বেশি, আর ভেটকি এর ব্যতিক্রম নয়। তবে আমাদের দেশে এটি সামুদ্রিক মাছ বলে পরিচিত নয়, বরং নদী থেকেই জেলেরা এই মাছ ধরে এবং বাজারে বিক্রি করে।

সমুদ্র থেকে আসুক কিংবা নদী থেকে, পুষ্টিগুণ এর কথা ভাবতে গেলে এই মাছ অবশ্যই খাওয়া উচিত। তবে সবার ক্ষেত্রে মাছের পুষ্টি একইভাবে কাজ নাও করতে পারে, সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নিতে পারেন।

Frequently Asked Questions

ভেটকি মাছের অন্য নামগুলো কি?

seabass, কোরাল, Barramundi ইত্যাদি।

ভেটকি মাছ ওজনে কত বড় হয় ?

প্রতি ৬ মাস থেকে ২ বছরের মধ্যে এদের প্রতিটির ওজন ৩৫০ গ্রাম থেকে ৩ কেজি পর্যন্ত হয়।

ভেটকি মাছের প্রজননের সময় কখন?

এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস এদের মূল প্রজননকাল

RIma Sinha

Rima Sinha is working as a writer and also as a journalist. she got her bachelor of arts degree from Tripura University. She has also completed Master of Arts in Journalism and mass communication from Chandigarh University.

Recent Posts