কচু আমাদের সকলের খুবই পরিচিত একটি সবজি। দামে বেশ সস্তা এবং সহজলভ্য বলেই হয়তো এটি একটি জনপ্রিয় সবজি। কচুতে আছে নানারকম ভিটামিন এবং বেশ কিছু ঔষধি গুণ যা আমাদের দেহে পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। আজ এই প্রতিবেদনে আমরা কচু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
কচুর বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস, Scientific classification of taro:
- জগৎ: উদ্ভিদ
- শ্রেণীবিহীন: সপুষ্পক উদ্ভিদ
- শ্রেণীবিহীন: Monocots
- বর্গ: Alismatales
- পরিবার: Araceae
- উপপরিবার: Aroideae
- গোত্র: Colocasieae
- গণ: Colocasia
- প্রজাতি: C. esculenta
কচুর পুষ্টি উপাদান, About the nutritional content of taro :
কচুর বহু আয়ুর্বেদীয় গুণাগুণ আছে বলে দাবি করা হয়। প্রজাতিভেদে কচুর মূল, শিকড় বা লতি, পাতা ও ডাটা সবই মানুষের খাদ্য। কচুর মূল উপাদান হলো :
- আয়রন (Fe),যা রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রেখে শরীরে অক্সিজেনের সরবরাহ ঠিক রাখে।
- প্রোটিন,
- শর্করা,
- চর্বি,
- ক্যালশিয়াম,
- আয়রন ও
- খাদ্যশক্তি
- ক্যালসিয়াম
- ম্যাগনেসিয়াম
- ম্যাঙ্গানিজ
- ফসফরাস
- পটাশিয়াম
- জিংক
- ভিটামিন ইত্যাদি।
কচুর উপকারিতা কি কি? What are the benefits of taro?
কচু শাকে প্রচুর পরিমাণে “ভিটামিন এ” থাকায় রাতকানা রোগ প্রতিরোধে এটি অত্যন্ত উপকারী। কচু আঁশ জাতীয় হওয়ায় এটি কোষ্ঠ-কাঠিন্য দূর করে। কচুতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আয়রন ও ক্যালসিয়াম যা আমাদের হাড় শক্ত করতে সহায়তা করে। চুলের ভঙ্গুরতাও বন্ধতেও কচুর উপকারিতা অনেক। মানকচুতে আছে দরকারি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও বিটা ক্যারোটিন, যা শরীরে রোগ সৃষ্টিকারী ফ্রি র্যাডিকেলসকে দূরে রাখে। পুষ্টিবিদদের মতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের ক্যালসিয়াম ও লৌহের চাহিদা কচুশাক সহজেই মেটাতে পারে।
কচু খাদ্যতালিকাগত ফাইবার এবং ভাল কার্বোহাইড্রেটের একটি চমৎকার উৎস, যা উভয়ই আপনার পাচনতন্ত্রের কার্যকারিতা উন্নত করে এবং স্বাস্থ্যকর ওজন হ্রাসে অবদান রাখতে পারে । এর উচ্চ মাত্রার ভিটামিন সি, ভিটামিন বি 6 এবং ভিটামিন ই একটি স্বাস্থ্যকর ইমিউন সিস্টেম বজায় রাখতে সাহায্য করে।
সবজি হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও কচুর কিছু প্রজাতির সৌন্দর্যের কারণে টবে ও বাগানে চাষ করা হয়। এদের মধ্যে কতগুলোর রয়েছে বেশ বাহারী পাতা, আবার কতগুলোর রয়েছে অত্যন্ত সুন্দর ফুল।
কচুর শাক খেলে কি হয়? What happens if you eat taro leaves?
কচুতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, বি , সি ক্যালসিয়াম ও লৌহ রয়েছে। কচু শাক নিয়মিত খেলে শরীরে রক্তশূন্যতা দূর হয়। গর্ভবতী মহিলারা যদি এই শাক খায়, তাহলে তাদের শরীরে ভিটামিন এবং আয়রনের চাহিদা সহজে পূরণ হয়। কচুতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, ফোলেট ও থায়ামিন থাকে।
কচুর লতি খেলে কি উপকার হয়? What are the benefits of eating taro vine?
কচুর লতি হাড় শক্ত করে ও চুলপড়া রোধ করে। কুচুর লতিতে ডায়াটারি ফাইবার বা আঁশের পরিমান খুব বেশি। যা খাবার হজমে সাহায্য করে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। কচুর লতিতে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি আছে, যা সংক্রামক রোগ থেকে আমাদের দূরে রাখে।
কচু কয় প্রকার ও কি কি? What are the types of taro?
খাবার উপযোগী জাতগুলোর অন্যতম হচ্ছে মুখীকচু, পানিকচু, পঞ্চমুখী কচু, পাইদনাইল, ওলকচু, দুধকচু, মানকচু, শোলাকচু ইত্যাদি।
হরেক রকম কচু, Different types of Taro :
হরেক রকমের কচু আছে, যেমন –
- বন কচু : বনে জঙ্গলে যেসব কচু আপনা আপনি জন্মায় সেগুলোকে সাধারণত বুনো কচু বা বন কচু বলা হয়। এরা সবগুলো মানুষের খাবারের উপযোগী নয়।
- মুখী কচু : মুখী কচু একটি সুস্বাদু সবজি। কচুরমুখি কচু গাছের মুকুল থেকে সংগ্রহ করা হয়। এতে ভিটামিন বি, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফাইবার রয়েছে। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই এর চাষ হয়। মুখী কচু বাংলাদেশে গুঁড়া কচু, কুড়ি কচু, ছড়া কচু, দুলি কচু, বিন্নি কচু, ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত। মুখী কচুতে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন ‘এ’ এবং লৌহ থাকে, যা আমাদের দেহের আয়রনের অভাব দূর করতে সহায়ক।
- ওল কচু : এতে পুষ্টি ও ঔষধি মূল্য উভয়ই বিদ্যমান এবং সাধারণত রান্না করে তরকারি হিসেবে খাওয়া হয়। আজও গ্রামাঞ্চলে ওল কচুর রস, উচ্চরক্তচাপের রোগীকে প্রতিষেধক হিসেবে খাওয়ানো হয়।
- মান কচু : মানকচুতে আছে ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন, ফাইবার, পটাশিয়াম ও ম্যাংগানিজের মতো দরকারি পুষ্টি উপাদান। শরীরে আয়রনের ঘাটতি পূরণে ও দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে মানকচু কার্যকর। সর্দি–কাশি দূর করতেও এটি কার্যকরী। সব রকম কচুর মাঝে মানকচুর মান বেশি। মানকচু মল ও মুত্র বৃদ্ধি করে। শরীর ঠাণ্ডা রাখে। বাতের রোগ সারতে মানকচু খুবই কার্যকারী। মানকচুর শেকড়ের এক টুকরো থেতলে বের করা রসনালী ঘায়ে দিলে পুজ, রক্ত, দুষিত রস সব বেরিয়ে যায়।
- পানি কচু : পানি কচু বা জল কচুর বিভিন্ন নাম রয়েছে যেমন নারিকেল কচু, জাত কচু, বাঁশকচু ইত্যাদি। সবজি হিসেবে পানি কচুর গুরুত্ব ব্যাপকভাবে সমাদৃত, কারণ এর স্বাদ এবং পুষ্টিমান ও অত্যধিক, রান্না করাও সহজ।
- দুধ কচু : জ্বরের সময় রোগীকে দুধকচু রান্না করে খাওয়ালে জ্বর দ্রুত ভালো হয়ে যায়। নিয়মিত কচু খেলে কোলন ক্যান্সার ও ব্রেষ্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে।
এছাড়াও আছে শোলা কচু, বিষ কচু, কাঁটা কচু, সাল কচু, দুধ কচু, ঘেঁটু কচু, রক্ত কচু, পঞ্চমুখী কচু, মৌলবী কচু, গাঢ় কচু, ছাতি কচু ইত্যাদি।
কচুর ঔষধি গুণ, About the medicinal properties of taro :
কচুতে আছে প্রচুর ফাইবার, ফোলেট ও থায়ামিন যা মানব শরীরের জন্য অনেক দরকারি উপাদান। কচু খেলে রক্তের কোলেস্টরল কমে তাই উচ্চরক্ত চাপের রোগীদের জন্য ওল কচুর রস বেশ উপকারী। নিয়মিত কচু খেলে কোলন ক্যান্সার ও ব্রেষ্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে। কচুতে আছে অক্সলেট নামক উপাদান।
কচু দিয়ে বিভিন্ন রান্না, Various dishes with taro :
প্রজাতিভেদে কচুর মুল, শিকড় বা লতি, পাতা ও ডাটা সবই খাওয়া হয়। কচুর লতি দিয়ে চিংড়ি মাছ অনেকেরই পছন্দের খাদ্য। এছাড়াও কচুর লতি চচ্চড়ি, কচুর লতির ভুনা, কচুর লতি দিয়ে ইলিশ, কচুর লতির কোরমা, সরিষা বাটায় কচুর লতি ইত্যাদি হরেক রকম রান্নার রেসিপি রয়েছে। কচুর পাতা দিয়ে শাক, কচুর ডাটা দিয়ে ডাল, কচুর মুল দিতে চচ্চড়ি বা ডাল খাওয়া হয়।
কচু বা ওল খেলে গলা চুলকায় কেন? Why does the throat itch after eating Taro?
ওল কিংবা কচুর কান্ডে, মূলে এবং পাতায় ক্যালসিয়াম অক্সালেট নামক একটি যৌগ থাকে৷ এই যৌগ র্যাফাইড নামে বেশি পরিচিত। র্যাফাইডের গড়ন সূঁচালো, তারকা আকৃতির, বা গোলাকার হয়। এসব আকৃতির র্যাফাইড গলায় আটকে চুলকায় বা ব্যথা করে।
কচু খেয়ে গলা চুলকালে কি করা উচিত? What should be done when the throat itches after eating Taro?
র্যাফাইড অনেক সময় রক্তে মিশে কিডনি পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে যার থেকে কিডনিতে স্টোন পর্যন্ত হতে পারে। গলা চুলকানো আটকাতে কচু খাওয়ার আগে লেবু বা তেঁতুলের রস মাখিয়ে নিন। এগুলিতে যথাক্রমে সাইট্রিক এবং টার্টারিক অ্যাসিড থাকে যা র্যাফাইডকে গলিয়ে দেয়। ফলে গলা চুলকানির আশঙ্কা থাকে না।4
কচু খেলে কি এলার্জি হয়? Is taro allergic?
কচুতে আছে অক্সলেট নামক উপাদান। তাই কচু শাক বা কচু খেলে অনেক সময় গলা চুলকায়। তাই কচু রান্না করার সময় লেবুর রস বা সিরকা ব্যবহার করা উচিত। তবে যাদের শরীরে অ্যালার্জির সমস্যা আছে তাদের কচু না খাওয়াই ভালো।
কচু ধরলে হাত চুলকায় কেন? Why does the hand itch if you hold or touch taro?
কচু কাটতে বসার আগে হাতে সরষের তেল লাগিয়ে নিন। কচুর থেকে যে কষ বা আঠা বেরোয় তা হাতে লেগে থাকার ফলেই চুলকায়।
কচু কিভাবে রান্না করলে গলা চুলকাবে না? How to cook taro so it doesn’t cause an itchy throat?
ওল বা কচু গরম জলে আধ সেদ্ধ করে, সেই জল ফেলে দিতে পারেন। এছাড়াও রান্না করার সময়ে অনেকটা রসুন কুচি এবং সামান্য তেঁতুল বা লেবুর রস দিন। লেবু বা তেঁতুল রান্না শেষ করার ৫ মিনিট আগে ওল বা কচুতে দেবেন। এই পদ্ধতিতে রান্না করলে খাওয়ার সময়ে গলা ধরবে না।
কচু খেলে কি কি ক্ষতি হয়? / কচু শাক এর অপকারিতা, Disadvantages of consuming taro :
অনেক সময় কচু খেলে গলা চুলকায়। এর কারণ হচ্ছে, কচুতে অক্সালেটের যে দানা থাকে, তা খাওয়ার সময় গলায় কাঁটার মতো বিঁধে যায়। তাই বলে কচু কিন্তু স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। তবে যাদের শরীরে অ্যালার্জির সমস্যা আছে তাদের কচু না খাওয়াই ভালো।
শেষ কথা, Conclusion :
আজকের এই পোস্টে আমরা কচু সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। কচু শাক, কচুর ডাটা, কচুর মুল ইত্যাদি সবকিছুর উপকারিতা আপনাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে এখানে। আশা করি প্রতিবেদনই আপনাদের মনোগ্রাহী হয়েছে।