আমাদের দেহে সঠিক পরিমাণ পুষ্টি নিশ্চিত করতে হলে দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় নানা ধরনের ফল ও শাক-সবজি রাখা জরুরী। এই রকম একটি উপকারী ফল হলো ড্রাগন। ড্রাগন ফল, হাইলোসেরিয়াস নামক ক্লাইম্বিং ক্যাকটাসে বৃদ্ধি পায়, যা মূলত গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে পাওয়া যায়। ড্রাগন ফলের বাইরের আবরণ গোলাপী বা হলুদ রঙের হয়।
ড্রাগন ফলের ভিতরের অংশ সাদা বা বেগুনি হয়, এটি একটি রসালো ফল এবং ফলের ভেতরের অংশে অসংখ্য ছোটো ছোটো বীজ দেখতে পাওয়া যায়। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা এই ফলের পুষ্টি এবং স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
ড্রাগন ফলের পুষ্টির মান, Nutritional value of dragon fruit
১৭০ গ্রাম ড্রাগন ফলে রয়েছে:
- ক্যালোরি: 102
- কার্বোহাইড্রেট: 22 গ্রাম
- প্রোটিন: 2 গ্রাম
- ফ্যাট: 0 গ্রাম
- ফাইবার: 5 গ্রাম
- চিনি: 13 গ্রাম
- এই ফলে যে পরিমাণ ভিটামিন এবং খনিজ রয়েছে :
- ভিটামিন এ: 100 আন্তর্জাতিক ইউনিট (IU)
- ভিটামিন সি: 4 মিলিগ্রাম
- ক্যালসিয়াম: 31 মিলিগ্রাম
- আয়রন: 0.1 মিলিগ্রাম
- ম্যাগনেসিয়াম: 68 মিলিগ্রাম
তবে ড্রাগন ফলের সাদা ও লাল অংশের উপর ভিত্তি করে পুষ্টিমান ভিন্ন হয়।
- সাদা মাংসযুক্ত ড্রাগন ফল : প্রতি ১০০ গ্রাম সাদা ড্রাগন ফলে রয়েছে প্রায় ৬০ গ্রাম ক্যালরি, ৯-১৪ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ৮-১২ গ্রাম চিনি, ১-২ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার, ১-২ গ্রাম প্রোটিন, ১ গ্রামের কম চর্বি।
- লাল মাংসযুক্ত ড্রাগন ফল : প্রতি ১০০ গ্রাম লাল ড্রাগন ফলে রয়েছে ৫০-৬০ গ্রাম ক্যালরি, ৯-১৪ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট, ১-২ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার, ৮-১২ গ্রাম চিনি, ১-২ গ্রাম প্রোটিন, ১ গ্রামের কম চর্বি।
ড্রাগন ফল খাওয়ার স্বাস্থ্য উপকারিতা, Health Benefits of Eating Dragon Fruit
রসালো ও ফাইবার যুক্ত ড্রাগন ফল খাওয়ার বেশ কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে, কারণ এটি মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টে সমৃদ্ধ ফল। তবে এর স্বাদ অনুভব করতে গিয়ে অনেকেই বুঝতে পারেন না যে এটা মিষ্টি না টক জাতীয়, ঠিক যেন দুটো স্বাদের খুব ভালো মিশ্রণের স্বাদে এই ফল। ড্রাগন ফলের অত্যাবশ্যক কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে জেনে নিন :
১) ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কম করে :
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ড্রাগন ফলের মধ্যে থাকা ফাইবারের অংশ খুব উপকারী। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে ড্রাগন ফল খাওয়ার ফলে অগ্ন্যাশয় কোষ অগ্ন্যাশয় ইনসুলিন তৈরি করে যা চিনিকে ভেঙে দেয়। তাই ড্রাগন ফলকে দেহে শর্করা নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়ী করা হয়।
২) ক্যান্সারের ঝুঁকি কম করে :
ড্রাগন ফলে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফ্ল্যাভোনয়েড, ফেনোলিক অ্যাসিড এবং বিটাসায়ানিন, যা ফ্রি র্যাডিকেল দ্বারা ক্ষতি প্রতিরোধ করে। ফ্রি র্যাডিক্যাল আমাদের দেহের জন্য ক্ষতিকর, এটি এমন পদার্থ যা ক্যান্সার এবং অকাল বার্ধক্য সৃষ্টি করে।
ড্রাগন ফলের প্রধান অ্যান্টিঅক্সিডেন্টগুলির মধ্যে একটি হল ভিটামিন সি যা দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে সহায়ক, এছাড়াও আল্জ্হেইমের, পারকিনসন্স ইত্যাদি রোগ থেকে দূরে রাখার ক্ষেত্রে ড্রাগন ফল সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
৩) অনাক্রম্যতা বাড়াতে সহায়ক :
পূর্বে উল্লিখিত তথ্য অনুযায়ী, ড্রাগন ফল হল ভিটামিন সি এর একটি প্রধান উৎস, আর আমরা সকলেই জানি যে ভিটামিন সি একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে এবং আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে রোগ প্রতিরোধের জন্য প্রতিদিন 200 গ্রাম ড্রাগন ফল খাওয়া উচিত।
৪) হজমের উন্নতি ঘটায় :
ড্রাগন ফলে অলিগোস্যাকারাইডের মতো প্রিবায়োটিক রয়েছে যা অন্ত্রের ভালো ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করে। এই বিশেষ ফলে উপস্থিত প্রিবায়োটিকগুলি খাদ্য হজম করতে সাহায্য করে। অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া খাদ্যকে সহজে শোষিত করে ভেঙ্গে ফেলতে সাহায্য করে, আর এই ফল খাওয়ার কারণে ভালো ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি হয় বলে খাদ্যের পুষ্টি শোষণের কাজ সঠিকভাবে হয়।
৫) হার্টের স্বাস্থ্য উন্নত করে :
আমাদের শরীরে থাকে হিমোগ্লোবিন (Hb) যা রক্তে অবস্থিত আয়রন সমৃদ্ধ কোষ। হৃৎপিণ্ড থেকে শরীরের অন্যান্য অংশে এই Hb কোষগুলি অক্সিজেন পরিবহন করে। ড্রাগন ফলে আয়রনে উপস্থিতি আছে বলে এটি হিমোগ্লোবিনের মাত্রা সঠিক রাখতে সাহায্য করে। ড্রাগন ফলের মধ্যে রয়েছে বেটালাইন, যা অনন্য নাইট্রোজেনযুক্ত রঙ্গক। বেটালাইন শরীরের খারাপ কোলেস্টেরল কম করতে অনন্যভাবে পরিচিত।
এছাড়াও, ফলে থাকা কালো ছোটো ছোটো বীজগুলোতেও রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ওমেগা -3 এবং ওমেগা -9, যা হার্টের জন্য খুব ভাল এবং কার্ডিওভাসকুলার রোগের সম্ভাবনা কম করে দেয়।
৬) বার্ধক্যজনিত ত্বকের বিরুদ্ধে লড়াই করে
ড্রাগন ফলের মধ্যে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট স্ট্রেস ও বার্ধক্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। ড্রাগন ফলের ভিটামিন সিও ত্বক উজ্জ্বল রাখতে সহায়তা করে।
৭) চুলের জন্য ভালো :
গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রতিদিন দুধের সাথে ড্রাগন ফল খেলে চুলের স্বাস্থ্য ভালো থাকে। এছাড়াও এটি আমাদের চুলকে নরম ও চকচকে করে তোলে এবং সৌন্দর্য বাড়ায়।
৮) হাড়কে সুস্থ রাখে :
ড্রাগন ফলের মধ্যে থাকা ম্যাগনেসিয়াম হাড়কে শক্তিশালী করে, বার্ধক্যজনিত আঘাত এবং ব্যথা এড়াতে সাহায্য করে। তাই, যাদের হাড়ের রোগের ঝুঁকি বেশি তাদের নিয়মিত ড্রাগন ফল খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে হাড়ের স্বাস্হ্য উন্নত হবে।
৯) চোখের জন্য ভাল :
ড্রাগন ফলে আছে বিটা-ক্যারোটিন, যা ভেঙ্গে ভিটামিন এ-তে পরিণত হয়। অনেকেই হয়তো জানেন যে মানুষের চোখের লেন্সে প্রচুর পরিমাণে লুটেইন, জিক্সানথিন এবং মেসো-জেক্সানথিন থাকে, যা চোখের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে এবং চোখে যেকোনো রোগ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। চক্ষু সংক্রান্ত রোগ নিয়ে গবেষণা করে দেখা গেছে যে চোখের রোগ প্রতিরোধে মানুষের প্রতিদিন 3 মিলিগ্রাম থেকে 6 মিলিগ্রাম বিটা ক্যারোটিন গ্রহণ করা উচিত।
১০) গর্ভাবস্থায় ভালো :
ড্রাগন ফল গর্ভাবস্থায় খাওয়া উচিত, এটি নিম্নলিখিত উপায়ে স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে: –
চর্বির সমৃদ্ধ উৎস-
এই ফল আমাদের শরীরে ভালো চর্বি বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং ভ্রূণের মস্তিষ্কের বিকাশে সহায়তা করে।
সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে-
ড্রাগন ফল দেহে অভ্যন্তরীণ সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে এবং কোষের পুনর্জন্মে সহায়তা করে।
কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি-
ড্রাগন ফলের মধ্যে থাকা ফাইবার গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে দেখা দেওয়া কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং অন্যান্য গ্যাস্ট্রিক রোগ প্রতিরোধ করে।
হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধি –
ড্রাগন ফলে থাকা আয়রন রক্তের কোষের অক্সিজেন বহন করার ক্ষমতা উন্নত করে, যার ফলে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়, যা গর্ভবতী মহিলাদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
ড্রাগন ফল কিভাবে খাবেন, How to eat dragon fruit
ড্রাগন ফল খেতে হলে, অন্য ফলগুলোর মত এটি ধুয়ে নেওয়া প্রয়োজন। তাই ড্রাগন ফল জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। চামচ ব্যবহার করে চামড়া থেকে মাংস বের করতে পারেন। ফলের ভেতরের অংশে সাধারণত সাদা বা ছোট কালো বীজ থাকে।
যদি ফলের বাইরের অংশের ত্বক পুরু এবং শক্ত হয় তবে আপনি একটি ছুরি দিয়ে কেটে খোসা ছাড়িয়ে নিতে পারেন। তারপর ফলটির ভেতরের অংশ টুকরো করে কেটে খেয়ে নিন। ড্রাগন ফল উপভোগ করা যায় ফলের সালাদে, এছাড়া স্মুদিতে মিশ্রিত করা যায় বা বিভিন্ন খাবারের গার্নিশ হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
ড্রাগন ফল খাওয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, side effects of eating Dragon Fruit
ড্রাগন ফল খাওয়ার ফলে যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলির দেখা যেতে পারে সেগুলোর মধ্যে প্রধান হল অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া। এই ফল খাওয়ার ফলে কারও করো এলার্জি হতে পারে। এতে জিহ্বা ফুলে যাওয়া, আমবাত বা বমি ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। তবে এই সমস্যাগুলো তেমন কোনো বিরাট আকার ধারণ করে না, তাই খুব একটা ভুগতে হয় না।
পরিশেষে , Conclusion
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বুঝতেই পারছেন যে ড্রাগন ফলের রয়েছে অসংখ্য স্বাস্থ্য উপকারিতা। ড্রাগন ফল খাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় হল ফ্রুট সালাদের সাথে খাওয়া, এছাড়া গ্রীক দইয়ের টপিং হিসাবেও এটি ব্যবহার করা যায়। কেউ চাইলে এর জুস বানিয়েও খেতে পারেন। নিয়মিত ড্রাগন ফল খাওয়া আপনাকে রোগ থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করবে এবং আপনার স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটাবে।