প্রতি বছর ৬ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ব পনির দিবস পালিত হয়। এই বিশেষ দিনটি উদযাপন করা হয় পনিরের প্রতি আমাদের ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য। পনির, ভারতীয় উপমহাদেশের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং বহুল ব্যবহৃত খাদ্য উপাদান, তার স্বাদ, গঠন এবং পুষ্টিগুণের জন্য বিশ্বজুড়ে সমাদৃত।
পনির নিঃসন্দেহে ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রিয় খাদ্য উপাদানগুলির মধ্যে একটি। উত্তর ভারতের শাহী পনির থেকে শুরু করে পশ্চিমের পনির নু শাক, পূর্বের পনিরের ডালনা এবং দক্ষিণের পনির চেটিনাদ পর্যন্ত, পনির এমন একটি বহুমুখী খাদ্য উপাদান যা দিয়ে অসংখ্য পদ তৈরি করা যায়।
পনিরের উৎপত্তির ইতিহাস :
পনির ভারতজুড়ে ব্যাপকভাবে জন্যপ্রিয়, কিন্তু আপনি কি জানেন যে পনির ভারতের নিজস্ব খাবার নয়? পনিরের ইতিহাস এবং ষোড়শ শতাব্দীতে কীভাবে এটি উদ্ভাবিত হয়েছিল।
পনিরের উৎপত্তির ইতিহাস বেশ আকর্ষণীয়। মনে করা হয় যে পনির ভারতে এসেছে সম্ভবত পারস্য বা মধ্য এশিয়া থেকে। যদিও এর সঠিক উৎস সম্পর্কে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে, বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ মনে করেন যে পনির কোন এক সময় ভারতে এসেছিলো, এবং তারপর এখানকার স্থানীয় রন্ধনশৈলীতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলো।
কিছু ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, ষোড়শ শতাব্দীতে মুঘল শাসনামলে পনির ভারতে আসে। মুঘলরা যখন ভারত শাসন করছিলো, তখন তাদের সাথে অনেক নতুন খাবার এবং রন্ধনশৈলী ভারতে প্রবেশ করে। পনির তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল। তবে, অন্যান্য কিছু মত অনুসারে, পনির আরও অনেক আগে থেকেই ভারতে পরিচিত ছিল, এবং বিভিন্ন সময়কালে বিভিন্ন পথে এই খাবার ভারতে এসেছে।
আরেকটি জনশ্রুতি আছে যে, পনির আকস্মিকভাবে তৈরি হয়েছিলো। কোন এক সময়, দুধ গরম করার সময় তাতে কিছু টক পদার্থ পড়ে যায়, এবং দুধ জমাট বেঁধে যায়। এইভাবেই প্রথম পনির তৈরি হয়েছিলো বলে অনেকে বিশ্বাস করেন।
পনিরের উৎপত্তিতে পর্তুগিজ প্রভাব :
পনিরের উৎপত্তি সম্পর্কে আরও একটি তত্ত্ব প্রচলিত আছে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলায় বসবাসকারী পর্তুগিজরা দুধ ভাঙার জন্য সাইট্রিক অ্যাসিড ব্যবহার করত। তারা তাদের স্থানীয় তাজা পনির তৈরির জন্য এই কৌশলটি ব্যবহার করত এবং বাঙালিদেরকেও এই কৌশল শিখিয়েছিল। এভাবেই ‘ছানা’ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং বাংলা থেকেই পনিরের ধারণাটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
এই তত্ত্বটি বেশ যুক্তিযুক্ত কারণ সপ্তদশ শতাব্দীতে পর্তুগিজদের বাংলায় আগমন ঘটেছিল এবং তারা বাণিজ্যিকভাবে বেশ প্রভাবশালী ছিল। তারা শুধু বাণিজ্য করত না, বরং তাদের সংস্কৃতি ও খাদ্যাভাসও স্থানীয়দের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিল। দুধ থেকে ছানা তৈরি করার কৌশলটি সম্ভবত তাদের হাত ধরেই বাংলায় আসে।
পর্তুগিজরা দুধ জমাট বাঁধানোর জন্য যে পদ্ধতি ব্যবহার করত, তা ছিল বেশ সরল এবং কার্যকরী। তারা দুধে সাইট্রিক অ্যাসিড যেমন লেবুর রস বা ভিনেগার যোগ করে দুধকে জমাট বাঁধাত। এই পদ্ধতিতে তৈরি হওয়া ছানা থেকেই পরে পনির তৈরির প্রচলন শুরু হয়।
এই তত্ত্ব অনুসারে, বাংলাই হলো পনিরের জন্মস্থান। পর্তুগিজদের কাছ থেকে ছানা তৈরির কৌশল শিখে বাংলার মানুষ এবং পরে এই জ্ঞান দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পরে। একসময় এই ছানাকেই আরও কিছু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আজকের পরিচিত পনিরে রূপান্তরিত করা হয়।
যদিও পনিরের উৎপত্তির সঠিক ইতিহাস এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট নয়, তবে পর্তুগিজদের অবদানের কথা অস্বীকার করা যায় না। তাদের প্রবর্তিত ছানা তৈরির কৌশল যে পনিরের উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, তা বলাই বাহুল্য।
যাইহোক, যেভাবেই পনির ভারতে আসুক না কেন, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে পনির খুব কম সময়েই ভারতীয় খাদ্য সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। আজ পনির শুধু একটি খাবার নয়, এটি আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং রন্ধনশৈলীর প্রতীক। বিভিন্ন উৎসবে, অনুষ্ঠানে এবং দৈনন্দিন জীবনে পনির আমাদের খাবারের টেবিলে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
পনির: ভারতের হৃদয় জয় করা এক বিদেশী খাবার :
ভারতে পনির শুধু একটি খাদ্য নয়, এটি দেশের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিভিন্ন ধরণের ভারতীয় রান্নায় পনিরের ব্যবহার দেখা যায় – যেমন মটর পনির, পালক পনির, পনির টিক্কা, শাহী পনির, এবং আরও অনেক মুখরোচক পদ। এই পদগুলো শুধু স্বাদেই অতুলনীয় নয়, বরং পারিবারিক জমায়েত ও উৎসবের একটা অংশ হয়ে উঠেছে।
তাছাড়া পনির একটি দুগ্ধজাত পণ্য, যা প্রোটিন, ক্যালসিয়াম এবং অন্যান্য পুষ্টিকর উপাদানে সমৃদ্ধ। এটি আমাদের শরীরের জন্য খুবই উপকারী। পনির সহজলভ্য এবং বিভিন্ন ভাবে রান্না করা যায়, যা একে আরও জনপ্রিয় করে তুলেছে। ভেজিটেরিয়ান এবং নন-ভেজিটেরিয়ান উভয় ধরণের খাবারে পনির যোগ করা যায়, এবং এটি সব বয়সের মানুষের জন্যই উপযোগী।