বাংলাদেশের এক অন্যতম বিখ্যাত তথা পর্যটনের উপযুক্ত স্থান হল বান্দরবান। এটি মূলত একটি পার্বত্য জেলা, যেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যিই অসাধারণ এবং মনমাতানো। অনেকেই ছুটির দিনে এই অঞ্চলে হাওয়া বদল করতে যান এবং নিজের মন সতেজ করে আসেন। এসব ছাড়া বহু চলচ্চিত্র ও নাটকের জন্য এটি একটি আদর্শ লোকেশন হিসেবে গণ্য। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা এই বিশেষ জেলার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে আলোচনা করবো।
বান্দরবান পার্বত্য জেলার নামকরণের ইতিহাস, Why Bandarban Hill District is named so?
বাংলাদেশে মনমাতানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পূর্ণ বান্দরবান জেলার নামকরণ নিয়ে একটি কিংবদন্তি রয়েছে। এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে এই বিষয়টি নিয়ে গল্প প্রচলিত আছে। প্রচলিত রূপকথা অনুযায়ী অত্র এলাকায় একসময় বাস করত অসংখ্য বানর, আর এই বানরগুলো শহরের প্রবেশ মুখে ছড়ার পাড়ে পাহাড়ে প্রতিনিয়ত লবণ খেতে আসত।
এক সময় অনবরত বৃষ্টির কারণে ছড়ার জল বৃদ্ধি পায়, যার কারণে বানরের দল ছড়া পেরিয়ে পাহাড়ে যেতে না পারায় তারা একে অপরকে ধরে সারিবদ্ধভাবে ছড়া পাড় হয়। বানরদের এই ছড়া পারাপারের দৃশ্য দেখতে পায় স্থানীয় জনপদের মানুষ। তখন থেকে এই জায়গাটির পরিচিতি লাভ করে “ম্যাঅকছি ছড়া ” হিসাবে; মার্মা ভাষায় ম্যাঅক অর্থ বানর আর ছিঃ অর্থ বাঁধ। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ কালের প্রবাহে বাংলা ভাষাভাষির সাধারণ উচ্চারণে এই এলাকাটির নাম এক নতুন রূপ লাভ করে বান্দরবান হিসাবে পরিচিত হয়। তবে মার্মা ভাষায় বান্দরবানের নাম “রদ ক্যওচি ম্রো”।
বান্দরবানের অবস্থান, Location of Bandarban
বাংলাদেশে তিনটি পার্বত্য জেলা রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো বান্দরবান। পার্বত্য এই জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে রয়েছে কক্সবাজার, উত্তর-পশ্চিমে আছে চট্রগ্রাম জেলা, উত্তরে রয়েছে রাঙামাটি ও পূর্বে মায়ানমার দেশ। ভৌগলিক অবস্থান এমন হওয়ার কারণেই হয়তো বান্দরবানে অনেকগুলো দর্শনীয় স্থান রয়েছে। পাহাড়, নদী ও ঝর্ণার মিলনস্থলে বান্দরবান জেলা এক অপরূপ সুন্দর রূপের অধিকারী হতে পেরেছে।
বান্দরবান জেলার দর্শনীয় স্থান সমুহের বিবরণ, Details of places to visit in Bandarban district
বান্দরবান জেলায় দেখার মত বেশ কিছু এলাকা রয়েছে। যেমন :
নীলগিরি
বাংলার দার্জিলিং নামে পরিচিত নীলগিরি বান্দরবান জেলায় অবস্থিত। এই স্থানের দিগন্ত জুড়ে সবুজ পাহাড় আর মেঘের লুকোচুরি যে কাউকে এর রূপ দিয়ে বিমোহিত করতে পারে। নীলগিরি পাহাড়টি বান্দরবান জেলা সদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে। পাহাড়টি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২০০ ফুট উঁচুতে। নীলগিরিতে সেনাবাহিনীর চেক পোস্ট আছে বলে সেখানে গেলে সবাইকে চেক করে ভ্রমণের অনুমতি দেওয়া হয়।
নীলাচল
নীলাচল হল একটি পর্যটন কেন্দ্র, যা বান্দরবান শহর থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। টাইগারপাড়ার পাহাড় চূড়ায় গড়ে তোলা হয়েছে আকর্ষণীয় এই পর্যটনকেন্দ্র। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬০০ ফুট উঁচু এই স্থানে বর্ষা, শরৎ ও হেমন্ত- এই তিন ঋতুতেই ছোঁয়া যায় মেঘ। নীলাচল থেকে সমগ্র বান্দরবান শহর একনজরে দেখা যায়।
স্বর্ণ মন্দির
বান্দরবান জেলা সদর থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে বালাঘ্টা এলাকায় স্বর্ণ মন্দির অবস্থিত। এই স্বর্ণ মন্দিরটি মহাসুখ মন্দির হিসেবেও পরিচিত। এছাড়াও এটি বৌদ্ধ ধাতু জাদী নামেও সমানভাবে পরিচিত। স্বর্ণমন্দির নাম হলেও এখানে স্বর্ণ দিয়ে তৈরি কোন স্থাপনা নেই। তবুও মন্দিরে সোনালি রঙের আধিক্যের জন্য এটি স্বর্ণমন্দির হিসাবে পরিচিত। পাহাড়ের চূড়ায় তৈরী এ সুদৃশ্য প্যাগোডা বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের পবিত্র একটি তীর্থস্থান। সারা বছর ধরে বহু মানুষ এই মন্দির দর্শন করতে আসেন।
কেওক্রাডং
বান্দরবানের রুমা উপজেলায় কেওক্রাডং পাহাড় অবস্থিত। প্রায় ৩১৭২ ফুট উঁচু এ পর্বতকে এক সময় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মনে করা হত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আধুনিক পরিমাপ পদ্ধতিতে এটি দেশের পঞ্চম উচ্চ পর্বত শৃঙ্গ হিসবে স্থান পেয়েছে।
বগালেক
কেওক্রাডং পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সমুদ্রপৃষ্ট থেকে প্রায় ১২০০ ফুট উচ্চতায় ২০০০ বছর আগে প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট এক হ্রদ। বগাকাইন লেক বা বগালেক বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলা থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পাহাড়ের কোলে প্রায় ১৫ একর জায়গা জুড়ে আকাশ, পাহাড় আর নীল জলের পসরা সাজিয়ে বগালেক তাই পর্যটকদের কাছে হয়ে উঠেছে অনন্য।
নাফাখুম জলপ্রপাত
বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নে অবস্থিত নাফাখুম জলপ্রপাত বাংলাদেশের অন্যতম বড় জলপ্রপাত। রেমাক্রী খালের জল নাফাখুমে এসে প্রায় ২৫-৩০ ফুট নিচের দিকে নেমে গিয়ে জন্ম দিয়েছে এই জলপ্রপাতের। দ্রুত গতিতে নিচের দিকে নেমে আসা জল থেকে সৃষ্ট জলীয় বাষ্প সূর্য্যের আলোয় প্রতিনিয়ত এখানে রামধনু সৃষ্টি করে।
আপনি যদি অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় হয়ে থাকেন এবং বান্দরবানে গিয়ে ট্রেকিং করার ইচ্ছে থাকে, তাহলে সবুজের খেলা, আদিবাসীদের জীবন চিত্র, সাঙ্গুর ভয়ংকর রূপ বা শীতের টলমলে পাথুরে জলের খেলা দেখতে একবার হলেও যাওয়া উচিত অনিন্দ্য সুন্দর ঝর্ণায়।
চিম্বুক
বান্দরবান জেলা শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক পাহাড়ের অবস্থান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ২৫০০ ফুট। চিম্বুক বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম পর্বত। চম্বুক পাহাড় চূড়াতেই রয়েছে চিম্বুক পর্যটন কেন্দ্র।
শৈল প্রপাত ঝর্ণা
শৈলপ্রপাত ঝর্ণা বান্দরবান জেলা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে বান্দরবান-থানচি রোডের পাশে অবস্থিত। বাংলাদেশে অতিপরিচিত ঝর্ণা গুলোর মধ্যে শৈলপ্রপাত অন্যতম। পর্যটননগরী বান্দরবানের কাছে হওয়ায় সারা বছরই পর্যটক সমাগমে মুখরিত থাকে স্বচ্ছ ও ঠান্ডা জলের এই ঝরনা।
আলীর গুহা বা আলীর সুড়ঙ্গ
রহস্যময় আলীর গুহা বা আলীর সুড়ঙ্গ প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট। বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলায় এটি অবস্থিত। আলীর পাহাড় থেকে এর নামকরণ করা হয়। আলীকদম সদর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে মাতামুহুরী-টোয়াইন খাল ঘেঁষে পাহাড়ের চূড়ার এই গুহা নিয়ে রহস্যের শেষ নেই। গুহার ভিতর পুরোটা অন্ধকার। ভিতরে যাওয়ার জন্যে টর্চ লাইট বা মশাল নিয়ে যেতে হবে। গুহার কিছু অংশ বেশ সরু, তাই সেখানে হামাগুড়ি দিয়ে যেতে হবে। ভিতরে স্যাঁতস্যাঁতে গা ছমছমে পরিবেশ। এখানে গেলে এক অন্য অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারবেন।
বান্দরবান ভ্রমণের উপযুক্ত সময় :
বান্দরবান প্রকৃতির এক অপূর্ব লীলাভূমি, এতে হয়তো কারো সন্দেহ নেই, বিশেষ করে যারা এই জায়গা ভ্রমণ করে এসেছেন তারা অবশ্যই এই স্থানের মাধুর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। তাইতো এই স্থানের সৌন্দর্যের টানে সারা বছরজুড়েই এখানে পর্যটকরা ছুটে আসেন। প্রতিটা মরশুমে প্রকৃতি এখানে যেন নিজের রূপ বদলায়। এক এক মরশুমে বান্দরবন একেক রকম রূপ ধারণ করে।
যারা মেঘ আর সতেজ প্রকৃতি দেখতে চান তাদের জন্য বান্দরবান ঘোরার আদর্শ সময় হলো বর্ষার শুরু থেকে হেমন্ত পর্যন্ত, অর্থাৎ জুন থেকে নভেম্বর।
যারা বর্ষা এড়িয়ে শুকনো মৌসুমে বান্দরবানের ভিউ দেখতে চান তাদের জন্য ভালো সময় হচ্ছে ডিসেম্বর থেকে মার্চ।
এপ্রিল-মে – জুন এই তিন মাস প্রচন্ড গরম থাকে বলে তখন বান্দরবান ভ্রমণ পরিকল্পনা না করাই শ্রেয়।
বান্দরবান ভ্রমণ খরচ, Travel expenses to Bandarban
বান্দরবান ভ্রমণ খরচ সম্পর্কে একটু ধারণা দেওয়া যাক-
- বাস ভাড়া আসা যাওয়ায় ৬২০ x ২ = ১২৪০ টাকা। এসি বাসের ভাড়া আসা যাওয়া ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা লাগবে।
- হোটেল ভাড়া জনপ্রতি ৫০০ থেকে ২৫০০ টাকা থেকে শুরু।
- যানবাহন ভাড়া দুইদিনে সিএনজি নিলে ৩০০০ টাকা, জিপ ৫৫০০ ও চান্দের গাড়ি ভাড়া ৮৫০০ টাকা। সিএনজিতে ৪ জন, জিপে ৭ জন এবং চান্দের গাড়িতে সর্বোচ্চ ১৩ জন বসতে পারবেন ।
- খাবার খরচ প্রতিবেলা ১২০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে হয়ে যাবে।
- এন্ট্রি ফি সবগুলো স্পট মিলে জনপ্রতি ২০০ টাকা।
শেষ কথা, To conclude
বাংলাদেশের মধ্যে পার্বত্য অঞ্চল তেমন বেশি না থাকলেও বান্দরবানের পার্বত্য সৌন্দর্য্য অত্যন্ত মনোরম। ভ্রমণপিপাসুদের মনের সব ধরনের চাহিদা মিটে যায় এই জেলায় ভ্রমণ করলে। পাহাড় প্রেমীদের জন্য এটি একটি আদর্শ স্থান বললেও ভুল হবে না।
Frequently Asked Questions
বাংলাদেশের এক অন্যতম বিখ্যাত তথা পর্যটনের উপযুক্ত স্থান হল বান্দরবান।
যারা মেঘ আর সতেজ প্রকৃতি দেখতে চান তাদের জন্য বান্দরবান ঘোরার আদর্শ সময় হলো বর্ষার শুরু থেকে হেমন্ত পর্যন্ত। অর্থাৎ জুন থেকে নভেম্বর। যারা বর্ষা এড়িয়ে শুকনো মৌসুমে বান্দরবানের ভিউ দেখতে চান তাদের জন্য ভালো সময় হচ্ছে ডিসেম্বর থেকে মার্চ। এপ্রিল-মে – জুন এই তিন মাস প্রচন্ড গরম থাকে বলে তখন বান্দরবান ভ্রমণ পরিকল্পনা না করাই শ্রেয়।
নীলগিরি, নীলাচল, স্বর্ণমন্দির, চিম্বুক, শৈলপ্রপাত ও নাফাখুম, কেওক্রাডং ইত্যাদি।