বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর দেশের রাজধানী ঢাকা শহরে অবস্থিত। ব্রিটিশ সরকার এদেশে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে। বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতিটি ধাপের সঙ্গে পরিচিত হবার জন্যে জাতীয় জাদুঘর বিশেষ ভূমিকা রাখে। ক্রমে এই জাদুঘর দেশের ঐতিহ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত সহ বিদেশী দর্শনার্থীরাও এই জাদুঘরে সংরক্ষিত বিভিন্ন নিদর্শন দেখতে আসেন। আজকের এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কোথায় অবস্থিত? Where is the National Museum of Bangladesh located?
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ভবন বাংলাদেশের ঢাকার শাহবাগে অবস্থিত। জাদুঘরটি শাহবাগ মোড়ের সন্নিকটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা পার্ক ও চারুকলা ইন্সটিটিউটের পাশে অবস্থিত। ১৯১৩ সালের ৭ আগস্ট, এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর তারিখে এটিকে জাতীয় জাদুঘরের মর্যাদা দেয়া হয়।
জাতীয় জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা কে? Who is the founder of the National Museum?
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা লর্ড কারমাইকেল। বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড কারমাইকেল তৎকালীন সচিবালয়ের একটি কক্ষে এই ঢাকা জাদুঘর উদ্বোধন করেন। বর্তমানে এই জাদুঘর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অধীনে রয়েছে। দেশের জাতীয় জাদুঘরটি, ১৯১৩ সালের ২০ মার্চ, প্রতিষ্ঠিত হয়।
জাতীয় জাদুঘরের নকশা করেন কে? Who designed the National Museum?
স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন (জন্ম: ৫ মে, ১৯৫২ ঢাকা বিক্ৰমপুর এবং মৃত্যু: ১০ নভেম্বর, ২০১৪) বাংলাদেশের প্রখ্যাত স্থপতি। তিনি জাতীয় স্মৃতিসৌধের ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের স্থপতি।
জাদুঘর এর অর্থ কি? What is the meaning of museum?
বাংলায় “জাদুঘর” কথাটির অর্থ হল, “যে গৃহে অদ্ভুত অদ্ভুত পদার্থসমূহের সংগ্রহ আছে এবং যা দেখিয়া মন্ত্রমুগ্ধবৎ হ’তে হয়।” আকাদেমি বিদ্যার্থী বাংলা অভিধান মতে, “জাদুঘর” শব্দের অর্থ, “যে-ঘরে নানা অত্যাশ্চর্য জিনিস বা প্রাচীন জিনিস সংরক্ষিত থাকে।” ইংরেজি “museum” (“মিউজিয়াম”) শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ থেকে।
জাদুঘরের ৫টি কাজ কি কি? What are the 5 functions of the museum?
একটি জাদুঘরের কাজ হল সংগ্রহ, প্রদর্শনী, সংরক্ষণ, গবেষণা এবং শিক্ষা । জাদুঘরগুলি প্রদর্শন এবং গবেষণার জন্য নিদর্শন এবং নথি সংগ্রহ করে। তারা সংস্কৃতি, শিল্প, বিজ্ঞান এবং আরও অনেক কিছু সম্পর্কে জনসাধারণকে শিক্ষিত করার জন্য অস্থায়ী এবং স্থায়ী উভয় প্রদর্শনী করে।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের ইতিহাস, History of Bangladesh National Museum :
- ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর “দ্য ঢাকা নিউজ” পত্রিকায় প্রথম এদেশে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়।
- ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ২০ মার্চ তৎকালীন সচিবালয়ে (বর্তমান ঢাকা মেডিক্যাল)-এ দুই হাজার রুপি তহবিল নিয়ে জাদুঘর নির্মাণের কার্যক্রম শুরু।
- ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ আগস্ট সর্বসাধারণের জন্য জাদুঘর উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ঢাকা জাদুঘরের প্রথম অস্থায়ী তথা সূচনাকালীন কিউরেটর বা তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন এন গুপ্ত।
- ১৯১৪ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রথম কিউরেটর নলিনীকান্ত ভট্টশালী দায়িত্ব পালন করেন। শাহবাগ এলাকায় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের জন্য একটি অত্যাধুনিক বৃহদায়তন ভবন উদ্বোধন করা হয়।
- আট একর জমির ওপর নির্মিত চারতলা ভবনটির তিন-তলা জুড়ে রয়েছে ৪৪টি গ্যালারি।
জাতীয় জাদুঘরের কাঠামো, Structure of the National Museum :
বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘরের নিদর্শনাদির বিভিন্ন বিভাগ রয়েছে। সেই বিভাগগুলো হচ্ছে:
- ইতিহাস ও ধ্রুপদী শিল্পকলা
- জাতিতত্ত্ব ও অলঙ্করণ শিল্পকলা
- সমকালীন শিল্পকলা ও বিশ্বসভ্যতা
- প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগ
- সংরক্ষণ গবেষণাগার
এছাড়া রয়েছে জনশিক্ষা বিভাগ।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংগৃহীত নিদর্শন, Artifacts collected at the Bangladesh National Museum :
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে নৃতত্ত্ব, চারুকলা, ইতিহাস, প্রকৃতি এবং আধুনিক ও প্রাচীন বিশ্ব-সভ্যতা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ে প্রদর্শনশালা (গ্যালারি) রয়েছে। এছাড়া এখানে একটি সংরক্ষণাগার, গ্রন্থাগার, মিলনায়তন, সিনেপ্লেক্স এবং চলচ্চিত্র প্রদর্শনালয় রয়েছে।
- জাদুঘরে বৈজ্ঞানিক, শৈল্পিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বস্তুসমূহ সংগ্রহ করে সংরক্ষিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে রক্ষিত আছে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটি।
- বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংগৃহীত নিদর্শনের সংখ্যা প্রায় ৯৪ হাজার। প্রতিটি নিদর্শনের একটি একসেশন নম্বর আছে। নিদর্শনের নাম, সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও ফটো নিয়ে কম্পিউটার ডেটাবেইস প্রণয়ন করা হয়েছে।
- সংরক্ষিত থাকা ৭৫০০ নিদর্শনের বর্ণনামূলক ক্যাটালগ প্রণয়ন ও প্রকাশ করা রয়েছে।সংগৃহীত নিদর্শনসমূহের প্রায় ৫ হাজার নিদর্শন ৪৫টি প্রদর্শন কক্ষে জনসাধারণের দর্শনের জন্য সাজিয়ে রাখা আছে।
- ৩৮ নম্বর প্রদর্শন কক্ষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রদর্শনী প্রকোষ্ঠ করা হয়েছে।
- আইএফআইসি ব্যাংক ও দৃকের সহায়তায় ৩৫ নম্বর গ্যালারিতে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন চিত্রশালা স্থাপন করা হয়েছে।
- ২৬ নম্বর কক্ষটি “সাহিত্য গ্যালারী” হলেও এতে দর্শনার্থীদের জন্য বিভিন্ন নাগরিক সেবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে দর্শনার্থী, Visitors at the Bangladesh National Museum :
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে প্রতিদিন গড়ে ২০০০-এর বেশি দর্শনার্থী আসেন, যারা সংরক্ষিত বিভিন্ন জিনিস পরিদর্শন করে যান। বলাই বাহুল্য যে, এসব দর্শনার্থীদের মধ্যে বিদেশীরাও আছেন।
- প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দর্শনীর পরিমাণ ৪০ টাকা।
- অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য দর্শনীর পরিমাণ ২০ টাকা।
- বিদেশীদের জন্য দর্শনীর পরিমাণ ৫০০ টাকা।
- সার্কভুক্ত দেশের দর্শনার্থীরা ৩০০ টাকার টিকেটে প্রবেশাধিকার পান।
- ০৩ বছরের কম বয়সের শিশু ও শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবর্গের জন্য টিকিট প্রয়োজন নেই, তারা বিনামূল্যেই প্রবেশ করতে পারবেন।
জাতীয় জাদুঘরের ব্যবস্থাপনা কাঠামো, Management Structure of the National Museum :
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর হল একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। এটি আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং একটি বোর্ড অব ট্রাস্টিজের নিয়ন্ত্রণাধীন। তবে একজন মহাপরিচালক এই জাদুঘরের প্রধান নির্বাহী হিসেবে সামগ্রিক দায়িত্ব পালন করে থাকেন, যিনি সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হন। বর্তমানে ৩৩০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে কর্মরত আছেন। জাদুঘরের বৎসরিক ব্যয়ের পরিমাণ প্রায় ২৯ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের নিয়ন্ত্রণাধীন জাদুঘর সমূহ, Museums under the control of Bangladesh National Museum :
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের নিয়ন্ত্রণে সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত অবস্থিত জাদুঘরগুলো পরিচালিত হচ্ছে। সেই জাদুঘরগুলো হলো:
- আহসান মঞ্জিল জাদুঘর, ঢাকা।
- শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা, ময়মনসিংহ।
- ওসমানী জাদুঘর, সিলেট।
- জিয়া স্মৃতি জাদুঘর, চট্টগ্রাম।
- স্বাধীনতা জাদুঘর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা।
- পল্লী কবি জসীম উদ্দীন সংগ্রহশালা ফরিদপুর, ফরিদপুর।
- সাংবাদিক কাঙ্গাল হরিনাথ স্মৃতি জাদুঘর, কুষ্টিয়া।
- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর, গণভবন, ঢাকা।
- জাতীয় চার নেতা স্মৃতি জাদুঘর, কেন্দ্রীয় কারাগার, ঢাকা।
এছাড়াও বাংলাদেশের সেগুনবাগিচায় প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর নির্মাণের কাজ চলছে।
জাদুঘর গ্যালারি পরিদর্শনের সময়সূচি, Schedule of Visiting the Museum Gallery :
সাধারণ সময়সূচি :
- শনিবার-বুধবার: সকাল ১০.৩০- বিকাল ০৪.৩০ পর্যন্ত
- শুক্রবার: বিকাল ০৩.০০ – রাত ৭.০০ পর্যন্ত
সাপ্তাহিক বন্ধ :
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের সাপ্তাহিক বন্ধ থাকে বৃহস্পতিবার।
টিকিট বিক্রয়ের সময়সূচি :
- শনিবার-বুধবার: সকাল ১০.৩০- বিকাল ০৪.০০ পর্যন্ত
- শুক্রবার: বিকাল ০৩.০০ – রাত ৬.৩০ পর্যন্ত
এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত অর্থাৎ গ্রীষ্মকালে জাতীয় জাদুঘর সকাল ১০ টা ৩০ মিনিট থেকে বিকাল ৫ টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত এবং শুক্রবার বিকাল ৩ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
শেষ কথা, Conclusion :
জাতীয় জাদুঘর বাংলাদেশের যুগ যুগ ধরে বেড়ে উঠার সমস্ত স্মৃতি চিহ্ন ধারাবাহিকতার সাথে আগলে রেখে চলেছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য শিক্ষাভ্রমণের এক উপযুক্ত স্থান হতে পারে বাংলাদেশ জাদুঘর। বিশেষ করে নতুন প্রজন্ম আমাদের দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরিচিত হবার জন্যে জাতীয় জাদুঘরে যাওয়া উচিত।
Frequently Asked Questions :
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে অবস্থিত দেশের জাতীয় জাদুঘর। এটি ২০, মার্চ, ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং ৭ আগস্ট, ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে অবস্থিত দেশের জাতীয় জাদুঘর।
স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন