বাংলাদেশের একমাত্র আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা হল বাংলাদেশ পুলিশ। উক্ত সংস্থাটি দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। বাংলাদেশ পুলিশের প্রধান অধিকর্তা মহা পুলিশ পরিদর্শক বলে পরিচিত। দেশ তথা শহরে চুরি-ডাকাতি রোধ করা, ছিনতাই প্রতিরোধ করা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি সমাজ বিরোধী সকল কর্মকাণ্ডের প্রতিরোধ করা সহ বিভিন্ন জনসভা, তথা নির্বাচনী দায়িত্বে অংশগ্রহণ করে থাকে বাংলাদেশ পুলিশ। এ দেশের পুলিশ বাহিনীতে পুরুষ-নারী উভয়ই কর্মরত।
বাংলাদেশ পুলিশ সংগঠন, Bangladesh Police Organization
বাংলার মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ পুলিশ সংস্থা সংগঠিত হয়। বাংলাদেশ পুলিশ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের পুলিশ বাহিনীর মতো আইন পালন আর অপরাধ প্রতিরোধ বা দমন করার পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে। জঙ্গীবাদ দমন এবং নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ পুলিশ দীর্ঘমেয়াদি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।
বাংলার পুলিশের সদস্যরা নিজের উদ্ভাবনী ক্ষমতা তথা পেশাদরিত্ব দিয়ে অপরাধ মোকাবিলায় প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। জনগনের প্রতি দায়িত্ববোধের পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ জনগনের গর্বের বাহিনীতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ পুলিশ সংগঠনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব থাকে মহা পুলিশ পরিদর্শকের (আইজিপি) উপর। তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ পুলিশকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করা হয়।
বাংলাদেশ পুলিশের ইউনিটগুলি হল, Bangladesh Police units are:
- পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স (পুলিশ সদরদপ্তর)
- রেঞ্জ পুলিশ
- মেট্রোপলিটন পুলিশ
- বিশেষ শাখা (এসবি)
- অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)
- আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)
- র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)
- রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি)
- শিল্প পুলিশ
- হাইওয়ে পুলিশ
- পুলিশ ইন্টারনাল ওভারসাইট (পিআইও)
- পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)
- ট্রেনিং ইন্সটিটিউটস
- ট্যুরিস্ট পুলিশ
- নৌ পুলিশ
- এন্টি টেররিজম ইউনিট
- পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স :
ঢাকার গুলিস্তানে অবস্থিত পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে বাংলাদেশ পুলিশ নিয়ন্ত্রিত হয়।
রেঞ্জ ও জেলা পুলিশ :
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এবং অন্যান্য সকল মেট্রোপলিটান শহরগুলো ছাড়া সমগ্র পুলিশ বাহিনীকে পৃথক রেঞ্জে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক রেঞ্জের নেতৃত্বে থাকেন একজন ডিআইজি বা ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ। তিনি নিজের অধীনে থাকা জেলা পুলিশের নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। বর্তমানে আটটি প্রশাসনিক বিভাগের জন্য আটটি রেঞ্জ তথা রেলওয়ে ও হাইওয়ে পুলিশ হিসেবেও দুটো স্বতন্ত্র রেঞ্জ রয়েছে।
আট বিভাগের আট পুলিশ রেঞ্জের নাম–
- ঢাকা রেঞ্জ
- ময়মনসিংহ রেঞ্জ
- চট্টগ্রাম রেঞ্জ
- সিলেট রেঞ্জ
- রাজশাহী রেঞ্জ
- রংপুর রেঞ্জ
- খুলনা রেঞ্জ
- বরিশাল রেঞ্জ
অন্যদিকে জেলা পুলিশের অধিকর্তা হলেন সুপারিটেনডেন্ড অব পুলিশ বা এসপি। তবে প্রতিটি জেলায় এসপিকে সহযোগিতা করার জন্য এক বা একাধিক অতিরিক্ত এসপি পদায়ন করা হয়। পুলিশ বাহিনীর প্রত্যেকটি পুলিশ সার্কেল কয়েকটি থানার সমন্বয়ে গঠিত হয়। থানার অফিসার ইনচার্জ হিসাবে একজন পুলিশ পরিদর্শক দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
উক্ত ইনচার্জের অধীনে কয়েকজন সাব-ইন্সপেক্টর মিলে পুলিশের সামগ্রিক কার্যক্রমকে পরিচালনা করেন। বাংলাদেশী আইন অনুসারে কারও বিরুদ্ধে একমাত্র সাব-ইন্সপেক্টর পদধারী অফিসারই আদালতে চার্জশীট দাখিল করতে পারেন।
প্রত্যেকটি রেঞ্জের অধীনে নিজস্ব আরআরএফ বা রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স থাকে। অন্যদিকে জেলা পুলিশের অধীনে থাকে নিজস্ব স্পেশাল আর্মড ফোর্স বা এসএএফ; যারা জরুরী অবস্থা, বেআইনি সমাবেশ বা দাঙ্গা মোকাবেলা ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।
সশস্ত্র কনস্টবলদের এই বাহিনী পুলিশ সুপার অথবা তদোর্ধ কর্মকর্তার নির্দেশে মোতায়েন হয় এবং এরা সাধারণ পুলিশি কর্মকাণ্ড পরচালনার কাজে ব্যবহৃত হয় না; বরং ভিআইপিদের নিরাপত্তা রক্ষা সংক্রান্ত কর্তব্য, খেলাধুলোর ঘটনা, মেলা, নির্বাচন, উৎসব এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এদের মোতায়েন করা হয়।
তাছাড়াও ছাত্র বা শ্রমিকদের অসন্তোষ প্রকাশ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামা এবং সন্ত্রাস বিরোধী অভিযানেও এদের ব্যবহার করা হয়।
পুলিশ সংগঠনের অন্তর্গত ইউনিট, Unit belonging to the police organization
মহাপরিদর্শক এর নেতৃত্বে বাংলাদেশ পুলিশকে কয়েকটি ইউনিটে বিভক্ত করা হয়েছে।
- ইউনিট :
- উপজাতীয় ইউনিট
- রেঞ্জ পুলিশ
- মেট্রোপলিটন পুলিশ
- বিশেষায়িত ইউনিট
- ট্রাফিক পুলিশ
- বিমানবন্দর আর্মড পুলিশ (এএপি)
- কূটনৈতিক নিরাপত্তা বিভাগ ( [1] )
- ট্যুরিস্ট পুলিশ ( ওয়েবসাইট )
- হাইওয়ে পুলিশ
- শিল্প পুলিশ (আইপি)
- নদী পুলিশ
- রেলওয়ে পুলিশ (জিআরপি) ( ওয়েবসাইট )
- পুলিশের এয়ার উইং
- মাউন্টেন পুলিশ
- গণ র্যাপিড ট্রানজিট (MRT) পুলিশ ফোর্স
- বিশেষায়িত ব্যাটালিয়ন
- বিশেষ নিরাপত্তা ও সুরক্ষা ব্যাটালিয়ন (SPBn)
- বিশেষ সশস্ত্র বাহিনী (SAF)
- রেঞ্জ পুলিশ এবং রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স (RRF)
- র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)
- আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)
- বিশেষায়িত দল
- বিশেষ অস্ত্র ও কৌশল (SWAT)
- ক্রাইসিস রেসপন্স টিম (CRT)
- সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিট (ATU)
- বোমা ডিসপোজাল ইউনিট
- ক্যানাইন ইউনিট
- বুদ্ধিমত্তা
- বিশেষ শাখা (এসবি)
- গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)
- কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটি)
- পুলিশ অভ্যন্তরীণ তদারকি (পিআইও)
- সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ বিভাগ
- টেলিযোগাযোগ ও তথ্য ব্যবস্থাপনা (T&IM)
- তদন্ত ইউনিট
- অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)
- পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)
পুলিশ কর্মচারীদের পোশাক, Clothing of Police Officers
সার্ভিস ইউনিফর্ম : মিডনাইট ব্লু, খাকি
কমব্যাট ইউনিফর্ম : মেট্রোপলিটান: টিফানি ব্লু, মিডনাইট ব্লু।
রেঞ্জ পুলিশ: নেভি ব্লু, মিডনাইট ব্লু
ইমিগ্রেশন পুলিশ, Immigration Police
বিদেশের উদ্দেশ্যে গমনরত বাংলাদেশী এবং বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আগত তথা বিদেশী যাত্রীদের ইমিগ্রেশন এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত পরিসেবা প্রদান করার জন্য ইমিগ্রেশন পুলিশ নিযুক্ত করা রয়েছে। এটি বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখা।
বাংলাদেশ পুলিশে নারীদের যোগদান, Joining of women in Bangladesh Police
বাংলাদেশ পুলিশে মহিলারা প্রথম যোগদান করেন ১৯৭৪ সালে। তখন পুলিশের বিশেষ শাখায় ১৪ জন মহিলা পুলিশ অফিসার নিয়োগ করা হয়, তাদের মধ্যে : সাতজন সাব-ইন্সপেক্টর পদে নিযুক্ত হন এবং সাতজন কনস্টেবল পদে ছিলেন। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ পুলিশে কনস্টেবল থেকে শুরু করে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কর্মী মিলিয়ে ২২৪০ জনের বেশি মহিলা পুলিশকর্মী রয়েছেন।
নির্বাচন এবং প্রশিক্ষণ, Selection and training
বিভিন্ন পদে নিয়োগের স্তর অনুসারে নিয়োগ প্রক্রিয়া পৃথক হয় এবং সরাসরি প্রবেশ সম্ভব, নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা পদমর্যাদা অনুযায়ী বৃদ্ধি পায়। সহকারী পুলিশ সুপার, সাব-ইন্সপেক্টর এবং সার্জেন্টের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা হিসেবে স্নাতক ডিগ্রি থাকা প্রয়োজন। কনস্টেবলের চাকরির জন্য চাকরি প্রার্থীর একটি মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট থাকা প্রয়োজন। পুলিশ বিভাবে নিম্নলিখিত তিনটি স্তরে নিয়োগ করা হয়:
- সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে
- সাব-ইন্সপেক্টর (এসআই) বা সার্জেন্ট পদে
- কনস্টেবল পদে
প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, Training institute
পুলিশ বাহিনীতে নিযুক্ত হওয়ার পর, সকল নতুন কর্মীকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ পুলিশের প্রধান প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান হল বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি , যা সারদায় ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এএসপি থেকে ডিআইজি পর্যন্ত পুলিশ স্টাফ কলেজ সকল অফিসার পদপ্রার্থীদের প্রশিক্ষণ দেয়, উক্ত কলেজ 2000 সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়। তাছাড়াও প্রশিক্ষণের জন্য ঢাকায় ১৯৬২ সালে ডিটেকটিভ ট্রেনিং স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় ।
প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের তালিকা নিম্নে উল্লেখ করা হল :
- পুলিশ স্টাফ কলেজ , ঢাকা।
- বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমী , সারদা, রাজশাহী।
- পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার, টাঙ্গাইল।
- পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার, রংপুর।
- পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার, খুলনা।
- পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার , নোয়াখালী।
- ডিটেকটিভ ট্রেনিং স্কুল (ডিটিএস), রাজারবাগ, ঢাকা।
- ফরেনসিক ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, মালিবাগ , ঢাকা।
- স্পেশাল ব্রাঞ্চ ট্রেনিং স্কুল , মালিবাগ , ঢাকা।
- পুলিশ পিসকিপার্স ট্রেনিং স্কুল, রাজারবাগ , ঢাকা।
- পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং স্কুল (PSTS), বেতবুনিয়া , রাঙ্গামাটি।
- ট্রাফিক অ্যান্ড ড্রাইভিং স্কুল (টিডিএস), মিল ব্যারাক , ঢাকা।
- মোটর ড্রাইভার ট্রেনিং স্কুল (MDTS), জামালপুর।
- টেলিকমিউনিকেশন ট্রেনিং স্কুল, টিএন্ডআইএম, রাজারবাগ , ঢাকা।
- আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, খাগড়াছড়ি।
- র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন ফোর্সেস ট্রেনিং স্কুল, গাজীপুর।
- আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ট্রেনিং স্কুল।
তাছাড়া বিভিন্ন জেলায় রয়েছে ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টার।
বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগের বিভিন্ন পুরস্কার, Various awards of Bangladesh Police Department
- বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (BPM)
- বাংলাদেশ পুলিশ পদক – সেবা (বিপিএম-সেবা)
- রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম)
- রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক – সেবা (PPM-Seba)
উপসংহার, Conclusion
মিছিল, সভা, সমাবেশে সঠিকভাবে নিরাপত্তা প্রদানের কাজ হোক কিংবা হারানো মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, মোটরসাইকেল প্রভৃতি উদ্ধার সংক্রান্ত বিষয় হোক, এমনকি ইভ টিজিং, মোবাইল ফোনে নানা কারণে উত্যক্তকরণ, বা কোনও হুমকি প্রদানের প্রেক্ষিতে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি সকল প্রকার জনসেবামূলক কাজে সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশ পুলিশ সর্বদাই তৈরি।
সময়ের সাথে বাংলার পুলিশ বাহিনী নিজেদের দক্ষতা ক্রমে আরো উন্নত করে তুলছে, তাই আশা করা যায় যে পুলিশী তৎপরতায় দেশ একদিন অপরাধ মুক্ত হবে।