নিম যার বৈজ্ঞানিক নাম Azadirachta indica একটি বহুবর্ষজীবী ও চিরহরিৎ বৃক্ষ। এটি একটি ঔষধি গাছ যার ডাল, পাতা, রস সবই মানুষের দৈনন্দিন জীবনে বহুবিধ কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। নিমের একটি পাতা ২.৫-৪ ইঞ্চি লম্বা হয়। আয়ুর্বেদ শাস্ত্র প্রায় ৫০০০ বছর ধরে নানা রকমের রোগের হাত থেকে বাঁচাতে নিম পাতাকে কাজে লাগানো হচ্ছে। এই গাছটির প্রতিটি অংশ, তা পাতা হোক, কি ডাল, এমনকি নিম ফুলও নানাভাবে উপকারী। নিমের পাতা থেকে আজকাল প্রসাধনীও তৈরি হচ্ছে।
নিম গাছের বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস, Scientific Classification of Neem Tree :
- জগৎ: উদ্ভিদ
- বিভাগ: Magnoliophyta
- বর্গ: Sapindales
- পরিবার: Meliaceae
- গণ: Azadirachta
- প্রজাতি: A. indica
নিম পাতায় কি কি উপাদান আছে? What ingredients are there in neem leaves?
বিশেষজ্ঞদের মতে, নিম পাতায় রয়েছে ভিটামিন ও খনিজের ভাণ্ডার। এছাড়াও এই পাতায় প্রচুর পরিমাণে উপকারী অ্যান্টিঅক্সিডেন্টও মজুত রয়েছে। ফ্ল্যাভোনয়েড-এর উৎকৃষ্ট উৎস হচ্ছে নিম পাতা, আর এই উপাদান আমাদের একাধিক প্রাণঘাতী রোগের হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম। নিমের অন্যান্য উপাদানের মধ্যে আছে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, বিভিন্ন আকরিক যেমন ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এবং ক্যারোটিন। এছাড়া এটি গ্লুট্যামিক অ্যাসিড, প্র্যালাইন এবং অন্যান্য ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ।
নিম পাতার উপকারিতা, Benefits of Neem :
সাধারণ গৃহস্থ বাড়িতে নিম খুব পরিচিত একটা নাম। এর গাছের ছাল, পাতা, বীজ ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। নিম পাতার কিছু উপকারিতা হল :
- নিম পাতা কুষ্ঠ, চোখের রোগ, রক্তাক্ত নাক, কৃমি, পেট খারাপ, খিদে কমে যাওয়া, ত্বকের আলসার, হৃদপিণ্ড এবং রক্তনালীর রোগ, জ্বর, ডায়াবিটিস, মাড়ির সমস্যা এবং লিভারের সমস্যা সমাধানে ব্যবহৃত হয়।
- নিম গাছের ছাল ম্যালেরিয়া, পেট এবং অন্ত্রের আলসার, চর্মরোগ, ব্যথা এবং জ্বর নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়।
- নিম ফুল পিত্ত কমাতে, কফ নিয়ন্ত্রণে এবং অন্ত্রের কৃমির চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়।
- নিম ফল অর্শ্বরোগ, কৃমি, মূত্রনালীর রোগ, রক্তাক্ত নাক, কফ, চোখের রোগ, ডায়াবিটিস, ক্ষত এবং কুষ্ঠ রোগের জন্য ব্যবহৃত হয়।
- অন্ত্রের কৃমির সমস্যা নিরাময়ে নিমের বীজ ও তার তেল ব্যবহৃত হয়।
- নির্দিষ্ট পরিমাণে নিমের ব্যবহার প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য নিরাপদ।
- নিম পাতায় উপস্থিত অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল, অ্যান্টিভাইরাল এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রপাটিজ দেহের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে তোলে।
- নিমপাতা খাওয়ার ফলে একদিকে যেমন পেট খারাপ হওয়ার আশঙ্কা কমে, তেমনি গ্যাস-অম্বলের মতো সমস্যার প্রকোপ কমতেও সময় লাগে না।
- খালি পেটে নিম পাতা খেলে রক্তে উপস্থিত ক্ষতিকর উপাদানগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। সেই সঙ্গে টক্সিক উপাদানও বেরিয়ে যায়।
- নিমে রয়েছে ‘নিম্বিদিন’ নামক একটি উপাদান। আর এই উপাদান কিন্তু জয়েন্টের প্রদাহ দূর করতে সিদ্ধহস্ত।
- নিম পাতার নির্যাস খেলে মানসিক চাপ ও মানসিক অশান্তি কমে যায়।
- নিমের নির্যাস ব্যবহারে ম্যালেরিয়া প্রশমিত হয়।
- নিম পাতার রস একটু মধুর সাথে মিশিয়ে সকালে খালি পেটে খেলে জন্ডিস আরোগ্য হয়।
- নিম নির্যাস ব্লাড প্রেসার ও কোলেস্টোরল কমায়।
- কৃমিনাশক হিসেবে নিমের রস খুবই কার্যকরি।
- নিমের মধ্যে যে অ্যালার্জিরোধী যে গুণ রয়েছে তার জন্যই এটি অ্যাজমার চিকিৎসায়ও কার্যকরী।
নিম পাতার সংস্কৃত নাম কি? What is the Sanskrit name of neem leaf?
বৈজ্ঞানিক নাম: অ্যাজাডিরাকটা ইন্ডিকা
সংস্কৃত নাম: নিম্ব বা অরিষ্ট।
প্রতিদিন সকালে নিম পাতা খেলে কি হয়? What happens if you eat neem leaves every morning?
খালি পেটে নিম পাতা খাওয়ার উপকারিতা :
- রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণ
- রক্ত পরিষ্কার রাখে
- ত্বকের সৌন্দর্য বাড়াতে সাহায্য করে
- পেটের সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে
- শরীরের টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে উপকারী।
নিম পাতা বেটে মুখে দিলে কি হয়? What happens if you grind neem leaves and apply it on your face?
অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদান থাকায় নিমপাতা ত্বকের অনেকগুলো সমস্যা দূর করে। ব্রণ, ব্ল্যাকহেডসের মতো ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে এটি বেশ কার্যকরী। সেইসঙ্গে পরিষ্কার করে ত্বকের অতিরিক্ত তেল। লোমকূপে লুকিয়ে থাকা ময়লা পরিষ্কার করতেও সাহায্য করে এই উপকারী পাতা।
নিমের জুস কি ত্বকের জন্য ভালো? Is neem juice good for skin?
প্রতিদিন নিমের রস পান করা ত্বক ও চুল উভয়ের জন্যই অত্যন্ত উপকারী। এটি টক্সিন, ব্যাকটেরিয়া এবং ব্রণ থেকে মুক্তি দেয়, ত্বক পরিষ্কার করে পিগমেন্টেশনও কমায়। নিমের কচি পাতার রস প্রতিদিন সকালে খালি পেটে পান করুন, এতে উপকার পাওয়া যায়। সকালে খালি পেটে ৫টি গোলমরিচ ও ১০টি নিম পাতা বেটে খেলে তা ডায়াবেটিস কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও রক্ত নালীকে প্রসারিত করে রক্ত সংবহন উন্নত করে। চর্মরোগের চিকিৎসার জন্যেও এটি প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয়।
নিম পাতা খেলে কি কিডনির ক্ষতি হয়? Does eating neem leaves cause kidney damage?
কিডনির কার্যকারিতা উন্নত করতেও নিম পাতা ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলিতে এমন যৌগ রয়েছে যা কিডনির স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে এবং কিডনিতে পাথর প্রতিরোধে সহায়তা করে। কিডনির স্বাস্থ্যের জন্য নিম পাতা ব্যবহার করতে, আপনি তাজা পাতা পানিতে ফুটিয়ে নিম চা তৈরি করতে পারেন। তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিমের সেবন কিডনি ও লিভারের পক্ষে ক্ষতিকর।
নিম পাতা বাটা চুলে দিলে কি হয়? What happens if you apply neem leaf paste to your hair?
নিমের মধ্যে থাকা অ্যান্টি-ফাঙ্গাল উপকরণ খুশকি দূর করে এবং চুলকানির সমস্যা কমায়। নতুন চুলের বৃদ্ধি- চুলের বৃদ্ধি বা গ্রোথের পাশাপাশি নতুন করে চুল গজাতেও সাহায্য করে নিম। নিমের মধ্যে থাকা ফ্যাটি অ্যাসিড, ভিটামিন ই, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপকরণগুলি হেয়ার ফলিকল এবং চুলের গোড়া শক্ত করে।
নিম পাতা দিয়ে স্নান করার উপকারিতা, Benefits of bathing with neem leaves :
- নিম পাতা দিয়ে স্নান করলে ত্বক ও চুলের উপকার হবে। যেহেতু নিম অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টি ফাঙ্গাল; তাই এটি খুশকি রুখতেও বিরাট ভূমিকা নেয়।
- যেকোনো কারণে ত্বকে কোনো জীবাণু সংক্রমণ হলে নিমপাতা ফোটানো জলে স্নান করা উচিত। এতে কয়েকদিনের মধ্যেই সংক্রমণ পুরোপুরিভাবে সেরে যায়।
- নিমপাতা ভেজানো জলে স্নান করলে শরীরে উপস্থিত ক্ষতিকর সব ব্যাকটেরিয়া মারা যায়।
- নিমপাতায় উপস্থিত জীবাণুনাশক উপাদান চোখের সংক্রমণ কমায়। নিমপাতা ভেজানো জলে স্নান করলে বা চোখ ধুলে চোখে ধুলো- ময়লার কারণে সৃষ্ট সংক্রমণের সমস্যা ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারে না।
- গরমের সময় নিম জল দিয়ে স্নান করলে কাঁটা ফুসকুড়ি, ব্রণ এবং ত্বকের অ্যালার্জি দূরে থাকে।
নিম পাতা থেকে কি কি ওষুধ তৈরি হয়? What medicines are made from neem leaves?
নিমকে অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। নিম ছত্রাকনাশক হিসেবে, ব্যাকটেরিয়া রোধক হিসেবে, ভাইরাসরোধক হিসেবে, কীট-পতঙ্গ বিনাশে, চ্যাগাস রোধ নিয়ন্ত্রণে, ম্যালেরিয়া নিরাময়ে, দন্ত চিকিৎসায় ব্যথামুক্তি ও জ্বর কমাতে, জন্ম নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়।
প্রতিদিন কতটুকু নিম পাতা খাওয়া উচিত? How many neem leaves should be eaten daily?
প্রতিদিন খালি পেটে প্রায় 4-5টি নিম পাতা খাওয়া নিরাপদ। যাইহোক, অল্প সময়ের জন্য (10 সপ্তাহ পর্যন্ত) এই অভ্যাসটি ব্যবহার করার পরামর্শ দেওয়া হয় কারণ দীর্ঘ সময়ের জন্য ভারী ডোজ গ্রহণ আপনার কিডনি এবং লিভারকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।
নিম পাতা খাওয়ার সতর্কতা, Precautions for consuming neem leaves :
নিম পাতা খাওয়ার সময় কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। অনেকে মনে করেন, নিম পাতা বেশি খেলে পুষ্টি পাবেন। তবে, সেটা ঠিক নয়। সীমিত পরিমাণে খাওয়া ভাল। আপনার যদি কোনো রোগ থাকে, তবে নিম পাতা খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। টুথব্রাশের বদলে কেউ কেউ নিম ডাল দিয়ে দাঁত মাজেন। তবে এই অভ্যাস সবসময় ভাল নয়। নিমের ডালগুলি অনেক সময় ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হয়। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় থাকার ফলে স্ব-প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন রোগের লক্ষ্মণ বাড়তে পারে। এমন রোগের লক্ষ্মণ দেহে থাকলে নিম এড়িয়ে চলাই ভাল।
শেষ কথা, Conclusion :
নিম পাতা উপকারী উপাদান, এ বিষয়ে কারও কোনো দ্বিমত থাকার কথা নয়। কিন্তু তাই বলে অতিরিক্ত নিম পাতা সেবন করাও উচিত না। উপরের আলোচনা থেকে আপনারা বুঝতেই পারছেন যে নিম পাতা আমাদের কি কি কাজে লাগে। তাছাড়া নিম গাছের শুধু পাতাই নয়, বরং প্রতিটা অংশই উপকারী। তাই প্রয়োজনে প্রাকৃতিক এই উপাদান ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন।
Frequently Asked Questions :
প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, বিভিন্ন আকরিক যেমন ক্যালসিয়াম, ফসফরাস এবং ক্যারোটিন
অ্যাজাডিরাকটা ইন্ডিকা
ত্বক ও চুলের উপকার হবে।