সংস্কৃতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হল বই। জ্ঞান ও আনন্দ লাভের প্রকৃত উৎস হল বই। বইয়ের মত অমূল্য সম্পদ সংগ্রহ করতে গিয়ে যে অর্থ ব্যয় করা হয়, তা কারও আর্থিক অসচ্ছলতা কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, এমন আশঙ্কার কোনো কারণ নেই।
তাই সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না। ‘ আজকে আমাদের এই প্রতিবেদনে আমরা এই উক্তির ভাবসম্প্রসারণ আলোচনা করবো।
‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।’ – এর মূলভাব, ‘Buying a book does not make you bankrupt’– original meaning :
আমাদের এই পৃথিবীতে বই হল অপরিসীম জ্ঞানের আধার। একটি সৃজনশীল বই ক্রয় করতে গিয়ে যে অল্প পরিমান অর্থ ব্যয় হয়, সেটা হয়তো বই পড়ে অর্জিত জ্ঞানের সাথে তুলনা করতে গেলে খুবই নগণ্য।
কোনো বিষয়ে জ্ঞান তথা বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তথ্য নিয়ে পরিপূর্ণ কোনো সৃজনশীল পুস্তক অধ্যয়ন করাই হল জ্ঞানার্জনের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম।
তাই বলা যায় যে, প্রকৃত জ্ঞানার্জনে বইয়ের কোন বিকল্প নেই। বই কিনতে গিয়ে যত বেশি অর্থ ব্যয় করা হবে, জীবনের জন্য তা তত বেশি কল্যাণ বয়ে আনবে।
‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।’ – এর সম্প্রসারিত ভাব, ‘Buying a book does not make you bankrupt’ – explanation :
সমগ্র বিশ্বে যত মনীষী আছেন তাদের অসাধারণ চিন্তা-চেতনা ও সৃষ্টির অন্যতম আধার হল বই। এক যুগের মানুষকে পরবর্তী যুগের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম হল বই।
অতীতের অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান-বিজ্ঞানকে এনে নেওয়ার ভালো সুযোগ করে দিতে পারে একটি বই। কিন্তু অধিকাংশ সময় দেখা যায় যে, অকারনেই আমরা এই সত্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়ে যাই।
বর্তমান যুগে প্রায়ই দেখা যায় যে, বহু মানুষ বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ সিনেমা কিংবা কখনো স্টেডিয়ামে খেলা দেখার টিকেট কিনতে গিয়ে অকপটে অর্থ ব্যয় করতে পারে, অন্যদিকে বই কেনার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে চূড়ান্ত কৃপণতা দেখা যায় ।
আজকের সময়ে বই কেনার জন্য অর্থ ব্যয় করার ব্যাপারকে যেন মানুষ বাহুল্য বলে মনে করে। কিছু কিছু ব্যক্তি এমনও আছেন যারা বইয়ের অগ্নিমূল্য বা আর্থিক অসচ্ছলতার অজুহাত দিয়ে বই কেনা এড়িয়ে যান। তবে এসব বিষয় শুধু অযৌক্তিকই নয়, বরং অনাকাঙ্ক্ষিতও বটে।
বলাই বাহুল্য যে, বই পড়ার মাধ্যমে চিত্তের যে পরম সুখ লাভ করা সম্ভব হয়, তা এইসকল মানুষ হয়তো কখনও অনুভব করতে পারে না।
যারা বই পড়ার ক্ষেত্রে আদৌ আগ্রহী নয় বা জ্ঞানার্জনের পক্ষপাতি নয় তারা বেশি দামের অজুহাতে বই কিনতে চায় না; অথচ বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয়ে গেছে বলে কোনো নজির খুঁজে ইতিহাসে পাওয়া যায়নি এখন অবধি।
জ্ঞান পিপাসা মিটানোর উপযোগিতার তুলনায় বইয়ের দাম খুবই তুচ্ছ।
মানব জীবনকে সমৃদ্ধ করতে বইয়ের অবদান, Contribution of books to enrich human life :
মানব জীবনকে সমৃদ্ধ ও সফল করে তোলার জন্য বইয়ের অবদানের কোনো তুলনা হয় না। বইয়ের সাহচর্য লাভ করলেই জীবনের বিকাশ ঘটতে পারে। আমাদের জীবনে বইয়ের এইরূপ প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে অর্থ ব্যয় করা আবশ্যক।
মানুষ বইয়ের সান্নিধ্যে আসলে তাদের মনের যে প্রসার ঘটে এবং সে ব্যক্তি যে আনন্দ লাভ করে তার সাথে তুলনা করতে গেলে বইয়ের জন্য ব্যয়িত অর্থ খুবই অকিঞ্চিৎকর।
তাছাড়া বইয়ের মূল্য কখনোই এত বেশি হয় না যে ব্যক্তির অর্থনৈতিক অবস্থার উপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। বই কিনে কেউ সর্বস্বান্ত হয়েছে এমন নজির পৃথিবীতে নেই।
তাই, যেহেতু বই কিনে কেউ কখনও দেউলিয়া হয় না, তাহলে সকলেরই উচিত বই কিনে সেই বই থেকে জ্ঞানর্জন করা। এতে আর্থিক ক্ষতি কিছু হবে না, বরং জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি পাবে।
বই – জ্ঞানার্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম, Books are one of the main mediums of acquiring knowledge :
জ্ঞানার্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হলো বই। একজন ব্যক্তি যতই পড়বে ততই শিখবে। জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট।
বলাই বাহুল্য যে একবিংশ শতাব্দির বিশ্বে টিকে থাকতে হলে জ্ঞানার্জনের কোনো বিকল্প নেই। তাই সকলকেই বই পরে জ্ঞান অর্জন করে এগিয়ে যেতে হবে।
বই জ্ঞানের আধার, চির যৌবনা, চির অমলিন আনন্দের উৎস। স্বর্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য পারস্য কবি ওমর খৈয়ম যে উপকরণ তালিকা প্রস্তত করেছিলেন সেই তালিকায় বই ছিল অন্যতম একটি উপাদান। অন্যদিকে দার্শনিক টলস্টয় বলেছিলেন, মানব জীবনে তিনটি বস্তুই বিশেষভাবে প্রয়োজন, সেগুলি হচ্ছে বই, বই এবং বই।
মানুষ বই কেন পড়ে? Why do people read books?
বই মানুষ কেন পড়ে? প্রথম কবে বই পড়া শুরু হয়েছিল? কোন আদিকালে মানুষ বইয়ের প্রেমে পড়েছিল? কত প্রশ্নই ওঠে আসে মনে।
তবে একটা কথা বলতেই হয় যে, রম্য রচয়িতা, ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পকার, অনুবাদক ও কবি সৈয়দ মুজতবা আলীর উক্তি ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না’, বইয়ের চিরন্তন গ্রহণযোগ্যতাকে প্রকাশ করে।
বই পড়ার মধ্যেই সেই বইয়ের সার্থকতা। বই মানুষের মনের খোরাক জোগায়। তবে বই পড়া পেটের খোরাক জোগায় না, তাই হয়তো মানুষ বই কিনতে গিয়ে কৃপণতা দেখায়; কারণ মনের খোরাকের চেয়ে পেটের তাগিদই বেশি!
তবে জেনে রাখা ভালো যে, বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন বই পড়া অবস্থায় সচল হয়ে ওঠে মানুষের মস্তিষ্ক। কারণ, মস্তিষ্কের নিউরনগুলোর মধ্যে দ্রুত সিগন্যাল চলাচল করতে থাকে।
দীর্ঘমেয়াদি বই পড়ার অভ্যাস গড়ে উঠলে মস্তিষ্কের নিউরাল নেটওয়ার্ক আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এছাড়াও বই পড়লে জ্ঞান-বুদ্ধি বাড়বে সে বিষয় তো কোনো সন্দেহ নেই।
তাছাড়াও শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে বই পড়ার অভ্যাস দারুণভাবে সাহায্য করে। অন্যদিকে বই পড়লে শব্দভান্ডার বাড়ে, স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধি পায়, চিন্তার দক্ষতা বাড়ে এবং এটি বিনোদনেরও একটি সৃজনশীল মাধ্যম। তাই অনেকে বই পড়তে পছন্দ করেন।
বর্তমান যুগে বইয়ের বদলে প্রযুক্তির উদ্ভাবন, Use of technology in place of books in present day :
আজকের সময়ে মানুষের মধ্যে বই পড়ার ধৈর্যটা কমে গেছে। বইয়ের তুলনায় মানুষ প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ছে বেশি। বিষয়টা এমন যে, একজন ছাত্র মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে যে তীব্র আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে; সেই আগ্রহ যদি বইয়ের পৃষ্ঠার প্রতি থাকত তাহলে কত ভালোই না লাগত।
লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, বইয়ের বদলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই টিভি সিরিয়াল দেখে, মোবাইল বা ট্যাবে গেমস খেলে বা অপ্রয়োজনীয় কিছু ওয়েবসাইটে ঢুকে সময় কাটাচ্ছে।
এমনটা হওয়া হয়তো স্বাভাবিক, কারণ এ যুগ প্রযুক্তির যুগ। কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে, প্রতিদিন বই পড়লে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ে এবং মস্তিষ্ক আরও সক্রিয় হয়।
কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তি মস্তিষ্কের কার্যকলাপ সীমিত করে দিচ্ছে। তাই মানুষের মধ্যে সৃজনশীলতার অভাব দেখা দিচ্ছে।
একসময় ভোরে প্রতি বাড়িতে সংবাদপত্র বিলি করা হত, কিন্তু বর্তমানে মানুষ মোবাইলে পিডিএফ এর মাধ্যমে পত্রিকা পড়ছে। বইও আজকাল পিডিএফ আকারে প্রকাশ করা হচ্ছে।
এভাবে মানুষ ক্রমে প্রযুক্তির সাথে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই ক্রমে বইয়ের কাগজের খসখস শব্দ কোথায় যেন হারিয়ে যেতে বসেছে।
কিন্তু পূর্বে একসময় এমনও কিছু মানুষ ছিলেন যাদের ঘুম আসতো না বই না পড়ে। বইমেলায় বই প্রেমীদের ভিড় দেখা যেতো। কিন্তু বর্তমান যুগে সব যেন বিলুপ্তির পথে।
পরিশেষে, Conclusion :
বই নিজে নিরব কিন্তু মানুষের মনকে সরব করতে প্রধান ভূমিকা রাখে। মানুষ জীবনে দুই ভাবে জ্ঞানার্জন করে। প্রথমতঃ বই পড়ে, দ্বিতীয়তঃ অভিজ্ঞতা থেকে। অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান হয়তো আপনি যখন- তখন পাবেন না।
তবে বই যেকোনো সময় পড়ে বিশ্বের অনেক কিছু জানা যায়। বই পাঠ করে যে পরিমাণ জ্ঞান আহরণ করা সম্ভব সেই তুলনায় অর্থঃ নগন্য। এর কারণ হল জীবনের সব সম্পদ ভাগ বা নষ্ট হয়ে গেলেও জ্ঞান কখনও নষ্ট হয় না।
বই যুগের সাথে যুগের বন্ধন তৈরি করে। প্রাচীন কাল থেকে বর্তমানের সাথে সংযোগ স্থাপন করে বই। বই থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান আপনার কাছে আজীবন থেকে যায়। তাই তো বলা হয় যে, বই কিনে কেউ কখনও দেউলিয়া হয় না।