চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের চট্টগ্রামে অবস্থিত। আয়তনের দিক থেকে এটি দেশের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয়। এটি বাংলাদেশের সরকারি বহু-অনুষদভিত্তিক স্বায়ত্বশাসিত গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলায় স্থাপিত হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে ঝুলন্ত সেতু, ১২টি আবাসিক হল, ৩.৫ লক্ষ বইয়ের সুবিশাল গ্রন্থাগার, মসজিদ, ক্যাফেটেরিয়া, জিমনেশিয়াম, মেডিকেল সেন্টার, শহীদ মিনার সহ বিভিন্ন নান্দ্যনিক স্মৃতিস্তম্ভ ও ভাস্কর্য, ৩টি পৃথক জাদুঘর এবং পাহাড়ি ঝর্ণা।
স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বে, Before independence :
পাহাড়ে বেষ্টিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। তাই একে পাহাড়ি রাজকন্যা বা প্রকৃতির রাণী বলেও আখ্যায়িত করা হয়।
অন্যদিকে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি গানের ক্যাম্পাস নামে খ্যাত। এই বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। ওই সময়কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছিল।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাঙ্গন সম্পর্কে তথ্য, Information about university campuses :
- শিক্ষায়তনিক ব্যক্তিবর্গ সংখ্যা ৯০৭
- প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ সংখ্যা ৩১১ (পুরুষ ২৭৭, নারী ৩৪)
- শিক্ষার্থী সংখ্যা ২৭,৫৫০
- চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাঙ্গন ২,১০০ একর (৮৫০ হেক্টর) জুড়ে বিস্তৃত।
বর্তমান সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অর্ন্তভূক্ত রয়েছে। অন্যদিকে এখানে দেশের অন্যতম বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম আকর্ষণ হল শাটল ট্রেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান, Location :
চট্টগ্রাম শহর থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় ২২ কিলোমিটার (১৪ মা) উত্তরে হাটহাজারী থানার ফতেহপুর ইউনিয়নের জঙ্গল পশ্চিম-পট্টি মৌজার পাহাড়ি এবং সমতল ভূমির উপর অবস্থিত।
পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়তন ছিল ১,৭৫৩.৮৮ একর (৭০৯.৭৭ হেক্টর), যা ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে প্রায় ৯ কোটি ৭১ লক্ষ টাকা ব্যয়ে সীমানা প্রাচীর নিমার্ণের মাধ্যমে বর্ধিত করা হয়। ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরসমূহ, Museums :
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের কার্যক্রম ১৯৭৩ সালের ১৪ জুন, মধ্যযুগের চারটি কামান নিয়ে শুরু হয়। বর্তমানে এই জাদুঘরটিতে বেলে পাথরের একাধিক ভাস্কর্যসহ প্রাচীন পাথরের বেশকিছু ভাস্কর্য এবং একটি কামান রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘর ভবনটি পাঁচটি গ্যালারিতে বিভক্ত। যেখানে আছে : প্রাগৈতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গ্যালারি, ভাস্কর্য গ্যালারি, ইসলামিক আর্ট গ্যালারি, লোকশিল্প গ্যালারি এবং সমসাময়িক আর্ট গ্যালারি।
১) প্রাণিবিদ্যা জাদুঘর :
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা জাদুঘর ১৯৭৩ সালে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের পাঠক্রমের সমর্থনে সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্থাপিত হয়। উক্ত জাদুঘরে প্রায় ৫৪০ টি নমুনা সংরক্ষিত করা আছে, এখানে প্রাণীর সংখ্যা ৫৭ টি এবং ফরমালিন নমুনার সংখ্যা ৪৮৫ টি।
২) সমুদ্র সম্পদ জাদুঘর :
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের একটি কক্ষে গড়ে তোলা হয়েছে সমুদ্র সম্পদ জাদুঘর। সামুদ্রিক প্রাণী এখানে ৫৫০ টি সংরক্ষণ করা হয়েছে। অসংখ্য বিস্ময়কর জীববৈচিত্রের সংরক্ষণ যেমন হাঙ্গর থেকে শুরু করে বৈদ্যুতিক মাছ আজব বাণাকেল, অক্টোপাস, শামুক, বিভিন্ন প্রজাতীর সাপ রয়েছে।
বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ, Intellectual monument :
বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিপরীত পাশে অবস্থিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ভাষ্কর্যটি স্থাপন করা হয়। প্রথিতযশা শিল্পী রশিদ চৌধুরী স্মৃতিস্তম্ভের নকশা প্রণয়ন করেন। ১৯৮৫ সালে স্থাপিত হয় এই স্মৃতিস্তম্ভটি।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, Shaheed Minar :
ষাটের দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার পর, একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছিল তিনটি স্তম্ভের আদলে।
পরবর্তীতে প্রাকৃতিক দূর্যোগে তা ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ায়, ১৯৯৩ সালে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভের বিপরীত পাশে বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক ও ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ এর নকশা প্রনয়ন করেছিলেন।
স্মরণ স্মৃতিস্তম্ভ, Memorial monument :
২০০৯ সালের ৫ নভেম্বর মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশ পথেই স্মৃতিস্তম্ভ স্মরণ স্থাপন করা হয়। এর স্থপতি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ সাইফুল কবীর।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষক সহ সর্বমোট ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগ আর বীরত্বের স্মৃতিস্বরূপ ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন মুক্তিযোদ্ধার নাম ও ছবি রয়েছে।
স্বাধীনতা স্মৃতি ম্যুরাল, Independence Memorial Mural :
বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সামনে স্বাধীনতা স্মৃতি ম্যুরাল ভাস্কর্যটির অবস্থান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক তথা খ্যাতিমান শিল্পী মুর্তজা বশীরের একক প্রচেষ্টায় এটি নির্মিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক সৈয়দ সাইফুল কবীর ভাস্কর্যটির নকশা তৈরি করেন।
বাঙালির ছয় দফা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্রমধারা ভাস্কর্যটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এবং ২১টি পাথরের টুকরায় লিপিবদ্ধ হয়েছে বাহান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি।
জয় বাংলা, Jay Bangla :
বুদ্ধিজীবী চত্ত্বরে নির্মিত জয় বাংলা ভাস্কর্যটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপন করা হয় ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে। ভাস্কর্যটির নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৮ সালের মার্চ মাসে। এটি ছিল সৈয়দ মোহাম্মদ সোহরাব জাহানের নকশাকৃত এবং এটি তৈরি করতে সময় লাগে নয় মাস।
২০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ভাস্কর্যটি ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর উদ্বোধন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭তম উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী।
আবাসিক হল সমূহ, Halls of residence :
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমানে ১২টি আবাসিক হল রয়েছে। আবাসিক হলগুলোর মধ্যে ৮টি ছাত্র হল ও ৪টি ছাত্রী হল। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে ১টি হোস্টেল রয়েছে।
ছাত্র হল :
- আলাওল হল ১৯৬৭ সালে স্থাপিত হয়।
- এ. এফ. রহমান হল ১৯৭০ সালে স্থাপিত হয়।
- শাহজালাল হল ১৯৭১ সালে স্থাপিত হয়।
- সোহরাওয়ার্দী হল ১৯৭৪ সালে নির্মিত হয়।
- শাহ আমানত হল ১৯৭৭ সালে নির্মিত হয়।
- শহীদ আবদুর রব হল ১৯৯৪ সালে নির্মিত হয়।
- মাষ্টারদা সূর্যসেন হল ২০১০ সালে নির্মিত হয়।
- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ২০১৫ সালে নির্মিত হয়।
ছাত্রী হল :
- শামসুন্নাহার হল
- প্রীতিলতা হল
- দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া হল
- জননেত্রী শেখ হাসিনা হল, ২০১৫ সালে নির্মিত
- বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা হল
ছাত্রাবাস :
গোবিন্দ গুণালংকার ছাত্রাবাস, ১৯৯৬ সালে নির্মিত হয়।
এছাড়াও ক্যাম্পাসে বিশ্ব শান্তি প্যাগোডা নামে একটি বৌদ্ধ প্যাগোডা অর্থাৎ বৌদ্ধদের মন্দির আছে। এই প্যাগোডাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বৌদ্ধ শিক্ষার্থীরা থাকে, আর বর্তমানে ক্যাম্পাসটিতে আরো দুটি হলের নির্মাণ কাজ চলছে; ছেলেদের জন্য নির্মাণাধীন হলের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, আর মেয়েদের জন্য নির্মাণাধীন হলের নাম জননেত্রী শেখ হাসিনা হল।
শিক্ষকদের যাতায়াত ব্যবস্থা, Transport arrangements for teachers :
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে বাস এবং মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাটল ট্রেন, Shuttle train :
প্রতিদিন প্রায় ৯ থেকে ১০ হাজার শিক্ষার্থী শাটল ট্রেনে যাতায়াত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য ১০টি বগি বিশিষ্ট দুইটি শাটল ট্রেনের ব্যবস্থা রয়েছে।
বর্তমানে ট্রেন দুটো দৈনিক সাতবার নির্ধারিত সময়সূচী অনুযায়ী চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন ও ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশন থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রেলওয়ে স্টেশন এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন থেকে পুনরায় বটতলি ও ষোলশহর স্টেশন পর্যন্ত যাতায়াত করে। ১৯৮০ সালে শাটল ট্রেনের প্রথম যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে শাটল ট্রেনের পাশাপাশি ডেমু ট্রেনের ব্যবস্থাও রয়েছে।
শেষ কথা, Conclusion :
শহরের কোলাহল আর যান্ত্রিকতা থেকে দূরে সবুজ পাহাড়ে ঘেরা নৈসর্গিক প্রকৃতির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস যেন শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের তীর্থক্ষেত্রের পাশাপাশি জীববৈচিত্রের এক সমৃদ্ধ লাইব্রেরী। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আকাঁবাকাঁ পথ, বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা ও বন্যপ্রাণী যে কাউকে আকৃষ্ট করবে। প্রকৃতিপ্রেমী শিক্ষার্থীরা শিক্ষালাভের পাশাপাশি প্রায় প্রতিদিনই উপভোগ করতে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়নাভিরাম সৌন্দর্য্য।
Frequently Asked Questions
বাংলাদেশের চট্টগ্রামে অবস্থিত।
বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলায় স্থাপিত হয়
শিক্ষাঙ্গন ২,১০০ একর (৮৫০ হেক্টর) জুড়ে বিস্তৃত