চন্দ্রমল্লিকা ফুল আমাদের সকলেরই খুব পরিচিত একটি ফুল। কিছু কিছু মানুষ একে চন্দ্রমুখী বলেও চেনেন। আমাদের আশেপাশে থাকা ফুলের দোকানগুলোতে এই ফুল প্রায়ই সারি সারি সাজিয়ে রাখতে দেখেছি সবাই। ফুলের মালা হোক কিংবা ফুলদানিতে সাজানোর জন্য, এই ফুল সকলেরই পছন্দ।
কবি লিখেছেন, “চাঁদের দেশের পথ-ভোলা ফুল চন্দ্রমল্লিকা॥” সত্যিই কি এটি চাঁদের দেশের পথ-ভোলা? আসুন তবে জেনে নিই চন্দ্রমল্লিকা ফুল সম্পর্কে।
চন্দ্রমল্লিকার বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস, Scientific classification of chrysanthemum :
- বিভাগ: Magnoliophyta
- শ্রেণী: Magnoliopsida
- বর্গ: Asterales
- পরিবার: Asteraceae
- গোত্র: Anthemideae
- গণ: Chrysanthemum
- বৈজ্ঞানিক নাম: Chrysanthemum indicum L.
চন্দ্রমল্লিকার নামকরণ, Naming of chrysanthemum :
চন্দ্রমল্লিকার নামকরণ নিয়ে কবি লিখেছেন,
“চাঁদের আলো চুরি করে
আনলি তুই মুঠি ভরে,
দিলাম চন্দ্র-মল্লিকা নাম,
তাই তোরে আদর করে।”
চন্দ্রমল্লিকার ইংরেজি প্রতিশব্দ ক্রিস্যানথিমাম। এটি একটি গ্রীক শব্দ থেকে এসেছে। ক্রিসস কথাটির অর্থ হল ‘সোনা’ এবং এনথিমাম কথাটির অর্থ ‘ফুল’।
এই গাছটি ৫০ থেকে ১৫০ সেমি পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। চন্দ্রমল্লিকা ফুলগুলো সচরাচর সাদা, হলুদ অথবা পটল বর্ণের হয়। ফুলটির অপর একটি নাম হল ‘সেবতি’ ।
চন্দ্রমল্লিকা প্রজাতি, Chrysanthemum species :
সাধারণত চন্দ্রমল্লিকা প্রজাতি আমাদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। সেগুলি হল :
- তিন রঙা চন্দ্রমল্লিকা,
- তোরা চন্দ্রমল্লিকা,
- মালীর চন্দ্রমল্লিকা।
চন্দ্রমল্লিকার বিভিন্ন জাতের রয়েছে। তবে চাষের দিক থেকে বাণিজ্যিকভিত্তিতে একে প্রধানত দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয় – ছোট ও বড়।
- ছোট প্রজাতি – বাসন্তী (জলদি জাত) – উজ্জ্বল হলুদ, মেঘামী (ঐ) – হালকা বেগুনী, উনা (নাবিজাত) – হালকা গোলাপী
- বড় প্রজাতি – চন্দমা, স্নোবল, সোনার বাংলা, রোজডে, পুইসা পকেট
চন্দ্রমল্লিকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমূল্য, International Trade Price of Chrysanthemum :
চন্দ্রমল্লিকার ফুলগুলোর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমূল্য রয়েছে প্রথম সারিতে। চন্দ্রমল্লিকা ফুলগুলো গাছে তাজা থাকে ২০ থেকে ২৫ দিন৷ শীতকালীন ফুলের মধ্যে চন্দ্রমল্লিকার মতো দীর্ঘস্থায়ী ফুল আর একটাও নেই।
বাহারি বর্ণ-বৈচিত্র্য, পাপড়ির দৃষ্টিনন্দন বিন্যাস ও বড় আকারের জন্য এটি একটি সবার কাছেই জনপ্রিয় ফুল। চন্দ্রমল্লিকার ফল তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা আবহাওয়া এবং রৌদ্রজ্জল জায়গায় ভালো হয়।
চাহিদার পাশাপাশি দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে চন্দ্রমল্লিকার। তাই দিন দিন নার্সারীতে এ ফুলের কদর বাড়ছে।
সাহিত্যের অঙ্গ হিসেবে চন্দ্রমল্লিকা, Chrysanthemum as a part of literature :
আপনাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন যে, এমন বহু কবিতা রয়েছে যেখানে চন্দ্রমল্লিকার উল্লেখ পাওয়া যায়। তাছাড়া বহু গল্পেও এই বিশেষ ফুল নিজের স্থান করে নিয়েছে। সাহিত্য প্রেমী হোক কিংবা প্রকৃতি প্রেমী, সকলের কাছেই এই ফুল আকর্ষণীয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরে-বাইরে’তে নিখিলেশ উল্লেখ করেছিলেন, সে তার বাগান নানা টবে নানা রঙের চন্দ্রমল্লিকায় সাজিয়েছিল; আর গাছে যখন ফুল ফুটতো, তখন মনে হত যেন, ‘সবুজ সমুদ্রে ঢেউ লেগে নানা রঙের ফেনা উঠেছে।’
চন্দ্রমল্লিকা ফুল কত প্রকার? What are the types of chrysanthemum flower?
চন্দ্রমল্লিকা ফুল বিভিন্ন বর্ণ ও রঙের হয়ে থাকে। এর মধ্যে তামাটে, সোনালি, হলুদ, বেগুনি, লাল, খয়েরি এবং “গ্রিন গডেস” নামের সবুজ চন্দ্রমল্লিকা অত্যন্ত জনপ্রিয়। চন্দ্রমল্লিকা ফুলের বাজারে চাহিদা থাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।
চন্দ্রমল্লিকা ফুল চাষের পদ্ধতি, Chrysanthemum Flower Cultivation Method :
রোপণ করার সঠিক সময়ঃ
জমি অথবা টবে চারা রোপণের উপযুক্ত সময় অক্টোবর থেকে নভেম্বর।
চন্দ্রমল্লিকা ফুল গাছ চাষ পদ্ধতিঃ
চন্দ্রমল্লিকা ফুল চাষ করার জন্য উর্বর হালকা দোআঁশ মাটি, উঁচু, শুষ্ক ও সহজে জল নিস্কাশিত হয় এমন জমি উত্তম। জমির মাটি তৈরী করার সময় জমিতে পরিমাণ মতো পাতাপচা সার, পচা গোবর সার, সুপার ফসফেট সার প্রয়োগ করতে হবে।
জমিকে ভালোভাবে কর্ষণ করতে হবে যাতে মাটি ঝুরঝুরে ও নরম হয়। এরপর ১ ফুট বা ৩০ সেমি. দূরত্ব রেখে চারা বসাতে হবে। চারা রোপণের পর জমিতে নিয়মিতভাবে সেচ প্রদান করতে হবে।
চন্দ্রমল্লিকার পরিচর্যা কিভাবে করবেন ? How to take care of chrysanthemum ?
- পানি সেচঃ চন্দ্রমল্লিকার চারা বিকেলে রোপণ করে গোড়ার মাটি চেপে দিতে হবে। চারা লাগানোর পর হালকা সেচ দিতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন গোড়ায় বেশি পানি জমে না যায়। চারা রোপণের পর নিয়মিতভাবে পরিমানমতো সেচ দিতে হবে।
- সার প্রয়োগঃ চন্দ্রমল্লিকা চাষ করতে যেসব সার ব্যবহার করতে পারেন, সেগুলির নাম হল : পচা গোবর/কম্পোস্ট, ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, বোরিক এসিড ইত্যাদি। সার মাটির সাথে মিশিয়ে সেচ প্রদান করতে হবে।
- চন্দ্রমল্লিকা গাছের গোড়ার মাটি নিয়মিত খুঁড়তে হবে এবং ঘাস আগাছা ইত্যাদি তুলে ফেলতে হবে।
- বড় ফুল পেতে হলে আগার মুকুল রেখে অন্য মুকুল ও ডালপালা ভেঙ্গে দিতে হয়।
- চারা লাগানোর মাস খানেক পর গাছের অগ্রভাগ কেটে দিতে হবে। এতে করে গাছ লম্বা না হয়ে ঝোপালো হয়।
- পোকামাকড় দমন করতে প্রয়োজনীয় সার প্রয়োগ করতে হবে।
চন্দ্রমল্লিকার জাতভেদে ফলন কম বেশি হয়। তবে প্রতি গাছে বছরে গড়ে ৩০-৪০টি ফুল পাওয়া যায়।
বীজ থেকে চন্দ্রমল্লিকা জন্মাতে কতদিন সময় লাগে? How long does chrysanthemum take to grow from seed?
ক্রাইস্যান্থেমাম বীজ থেকে ফুলের জন্য 16 সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগে। বেশির ভাগ চাষি একমত যে ঘরে বীজ শুরু করা – তুষারপাতের সমস্ত সম্ভাবনা পেরিয়ে যাওয়ার আগে – সেরা পছন্দ।
জীবাণুমুক্ত বীজের শুরুর মিশ্রণ দিয়ে ছোট অঙ্কুরোদগম পাত্রগুলি পূরণ করুন।
চন্দ্রমল্লিকা চায়ের উপকারিতা? Benefits of chrysanthemum tea?
ক্রিস্যানথেমাম চায়ে পটাসিয়াম থাকে যা হৃদপিণ্ড, কিডনি এবং অন্যান্য অঙ্গগুলিকে কার্যকরীভাবে পরিচালনা করতে সাহায্য করে । শরীরে পর্যাপ্ত পটাশিয়ামের মাত্রা থাকলে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি কমে।
আয়রন, রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন পরিবহনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, ক্রিস্যান্থেমাম চায়ে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে।
কোন ধরনের চন্দ্রমল্লিকা ভোজ্য? What types of chrysanthemums are edible?
সমস্ত চন্দ্রমল্লিকা ফুল ভোজ্য। ক্রিস্যানথেমাম চা হিসাবে উপভোগ করা যেতে পারে, তবে এগুলি সালাদে এবং গার্নিশ হিসাবেও খাওয়া যেতে পারে।
পাতা এবং কোমল অঙ্কুরগুলিও ফ্রাই, স্যুপ, স্ট্যু এবং গরম পাত্রের স্বাদ নিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। তিল, সয়া সস, লেবু, রসুন, চালের ভিনেগার এবং অন্যান্য শাক-সবজির সাথে ক্রাইস্যান্থেমামসের জুড়ি সত্যিই ভালো।
চন্দ্রমল্লিকা ফুলের ভেষজ উপকারিতা জেনে নিন, Know the herbal benefits of chrysanthemum flower :
চন্দ্রমল্লিকা ফুলের বেশ কিছু ভেষজ উপকারিতা রয়েছে, সেগুলি হল :
- চন্দ্রমল্লিকার রস ঠান্ডা, জ্বর, সর্দি ইত্যাদি রোগে সরাতে ভালো কাজ করে।
- চোখের কিছু সমস্যায়, যেমন চোখ ফোলা সারাতে চন্দ্রমল্লিকার রসে ভালো উপকার পাওয়া যায়। এর জন্য তুলার সাহায্যে চন্দ্রমল্লিকার রস ভিজিয়ে চোখের পাশে মাখালে চোখের লালচে ভাব দূর হয়ে যায়।
- চন্দ্রমল্লিকায় রয়েছে এন্টিবায়োটিক বৈশিষ্ট্য যা ক্ষত সারাতে সাহায্য করে থাকে।
- আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চন্দ্রমল্লিকা ফুলের রস ভালো কাজ করে।
- চন্দ্রমল্লিকাতে রয়েছে এন্টিঅক্সিডেন্ট তাই এটি মুখের ভেতরে হওয়া ঘা, মাড়ি ফুলে যাওয়ার সমস্যা এবং মুখে ফোসকা পড়া প্রতিরোধ করতে কাজে লেগে থাকে।
- চন্দ্রমল্লিকা ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রেও উপকারী ভূমিকা পালন করে।
- হৃদরোগ প্রতিরোধ করতে চন্দ্রমল্লিকার রস সাহায্য করে।
- চন্দ্রমল্লিকার রস মাথার চুল কালো করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। নিয়মিত এর ব্যবহার করলে উপকার পাবেন।
- চন্দ্রমল্লিকার রস আমাদের ত্বককে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে থাকে।
- ঠাণ্ডাজনিত কোনো রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে চন্দ্রমল্লিকার রস জনপ্রিয় ঔষধি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
পরিশেষে, Conclusion :
চন্দ্রমল্লিকার নানান রঙ আমাদের মন ভালো করে দেয়। তাইতো অনেকেই বাড়িতে উঠান না থাকলেও বারান্দার টবে এই গাছ চাষ করে। সঠিক পরিচর্যায় টবে লাগানো গাছও রঙিন ফুল ভরে ওঠে, যা বাড়ির সৌন্দর্য্য বাড়ানোর পাশাপাশি সকলের মন ভালো রাখতেও সহায়ক।
Frequently Asked Questions :
Chrysanthemum indicum L.
হ্যাঁ, চন্দ্রমল্লিকা ভোজ্য
চন্দ্রমল্লিকা ফুল বিভিন্ন বর্ণ ও রঙের হয়ে থাকে। বাণিজ্যিকভিত্তিতে একে প্রধানত দুই প্রজাতিতে ভাগ করা হয় – ছোট ও বড়৷
ছোট প্রজাতিতে রয়েছে- বাসন্তী (জলদি জাত) – উজ্জ্বল হলুদ, মেঘামী (ঐ) – হালকা বেগুনী, উনা (নাবিজাত) – হালকা গোলাপী
বড় প্রজাতিতে রয়েছে- চন্দমা, স্নোবল, সোনার বাংলা, রোজডে, পুইসা পকেট