খেলা মানব মনের বিকাশ ঘটায়, চিন্তার গণ্ডিকে প্রসারিত করে এবং সর্বোপরি একজন সুষ্ঠু মানুষ হয়ে উঠতে সহায়তা করে। আমাদের দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে সকলের মনেই ক্রিকেট খেলার নামটা সবার আগে আসে।
অন্য বেশ কিছু দেশে ফুটবল খেলা বেশি জনপ্রিয় হলেও আমাদের দেশে এই খেলার জনপ্রিয়তা ফুটবলকেও ছাড়িয়ে গেছে। তবে শুধু ভারত বা বাংলাদেশেই নয়, ক্রিকেট হল ফুটবলের পরেই সমগ্র বিশ্বের একটি অন্যতম জনপ্রিয় খেলা। পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন দেশের অসংখ্য মানুষ নিয়মিত ক্রিকেট খেলা টিভি তে উপভোগ করেন, আবার অনেকেই নিজেও খেলে থাকেন।
ক্রিকেট খেলার ইতিহাস, History of cricket
ক্রিকেট খেলার উৎপত্তি সম্পর্কে তেমন কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি, কিন্তু এই খেলার ইতিহাস নিয়ে নানা স্তরে ভিন্ন মতামত প্রচলিত রয়েছে। তবে একটি বিষয়ে নিয়ে প্রায় সকলেই একমত যে ক্রিকেট খেলার উৎপত্তি ইংল্যান্ডে হয় ষোড়শ শতকের সময়কালে। অন্যদিকে ক্রিকেট শব্দটি নিয়ে সাধারণভাবে এক প্রচলিত মত রয়েছে যে, ওলন্দাজ শব্দ ‘ক্রিক’ থেকে ক্রিকেট শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।
বর্তমান সময়ে ক্রিকেট খেলা রাজ্যস্তরের হোক কিংবা জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক, প্রাপ্ত বয়স্কদের খেলা হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু এই খেলা পূর্বে বহুকাল ধরে শুধুমাত্র ছোটদের খেলা হিসেবেই সুপ্রচলিত ছিল। প্রাথমিকভাবে এই খেলায় খড় দিয়ে তৈরি বল এবং খামারবাড়ির কোন পরিত্যক্ত লাঠি বা ডান্ডা দিয়ে ক্রিকেট খেলা হত। ক্রমে সময়ের সাথে সাথে ক্রিকেট সুসংহত রূপ পায়। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসনের যুগে ইংরেজদের হাত ধরে সমগ্র পৃথিবীর পাশাপাশি ভারতেও ধীরে ধীরে ক্রিকেট খেলা ছড়িয়ে পড়ে।
ক্রিকেট খেলার সরঞ্জাম, Cricket equipments
ক্রিকেট খেলায় ব্যবহৃত সরঞ্জামগুলো হল :
একজােড়া ব্যাট, তিনটি করে দুই পাশে বসানোর ছয়টি স্টাম্প, চারটি বেট ও একটি বল।
ক্রিকেট খেলায় মাঠের মাঝখানে ২২ গজ পিচ মেপে নিয়ে দু দিকে তিনটে করে স্টাম্প পোঁতা হয়ে থাকে, এই দুইদিকের মধ্যে একদিকে থাকে ব্যাটসম্যান, অন্য প্রান্তে বোলারI বোলার ব্যাটসম্যান ভিন্ন দলের হয়।
বোলার বল ছুঁড়লে ব্যাটসম্যানকে তা ব্যাট দিয়ে মেরে রান নিতে হয়। দুই দলের মধ্যে যে পক্ষ বেশি রান করে সেই পক্ষ জয়ী হয় I আগেকার সময়ে ক্রিকেট পাঁচ দিনের খেলা ছিল যাকে ‘ টেস্ট’ বলা হত I কিন্তু ক্রমে একদিনের ক্রিকেট ( ৫০ ওভার) বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ৷ তবে বর্তমানে ২০ ওভারের ক্রিকেট খেলা জনপ্রিয়।
ক্রিকেট খেলার জরুরী কিছু বিষয়, Some important things to play cricket
বর্তমান নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী ক্রিকেট খেলায় বেশ কিছু সাধারণ বিষয় মেনে চলতে হয়। ক্রিকেট খেলার জন্য নির্ধারিত মাঠের কোন নির্দিষ্ট আয়তন নেই। বিভিন্ন মাঠ বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। তবে ২২ গজের একটি পিচ থাকা আবশ্যক। ক্রিকেট খেলার দুটি দল থাকে এবং প্রতি দলে ১১ জন করে খেলোয়াড় সহ দুজন আম্পায়ার থাকে।
উক্ত ২ জন অ্যম্পায়ার সমগ্র ম্যাচ পরিচালনা করেন। বর্তমান আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে চলতে গিয়ে প্রতি দলের সকল ক্রিকেট খেলোয়াড়দের নির্দিষ্ট জার্সি এবং জুতো পরতে হয়। তাছাড়া উইকেট রক্ষক, শর্ট ফিল্ডার এবং ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে খেলায় নামার সময় পায়ের প্যাড, হাতের গ্লাভস এবং মাথায় হেলমেট পরতে হয়।
ক্রিকেট খেলার সাধারণ নিয়ম নীতি, General rules and principles of playing cricket
একটি ক্রিকেট ইনিংসে দুটি দলই অংশগ্রহণ করতে পারে, আর সেই দুটি দল সেই ইনিংসে একবার করে ব্যাট ও বল করার সুযোগ পায়, এক দল যখন ব্যাট করে তখন অন্য দল বোলিং করে। খেলা শুরু হওয়ার আগে একটি টসের মধ্যে দিয়ে ম্যাচের সূচনা হয়। সেই টসে যে দল বিজয়ী হয়, তারা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী ব্যাট কিংবা বল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার সুযোগ পান।
যে দল ব্যাট করে সেই দলের দুজন ব্যাটধারী দুদিকে উইকেটের নিকট পরস্পর মুখোমুখি দাঁড়ায়, আর অন্যদল মাঠের নির্দিষ্ট অংশ ঘিরে দাঁড়ায় যাতে বল খেলার মাঠের আয়ত্তের বাইরে না যেতে পারে, তাদেরকে ফিল্ডার বলে। দলের একজন নির্দিষ্ট দিক থেকে বল নিক্ষেপ করে এবং ব্যাটধারীর উইকেট স্পর্শ বা আঘাত করার চেষ্টা করে।
ব্যাটধারীর উইকেটের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে ‘উইকেট রক্ষক’। একটি দলের দশজন খেলোয়াড় ব্যাটিংয়ে আউট হয়ে গেলে তাদের এক ইনিংস শেষ হয়। তারপর অপর দল ব্যাট করার সুযোগ পায় এবং অন্য দল তখন বোলিং করে। ক্রিকেট খেলায় আউটের সিস্টেম হল, বোল্ড আউট, স্ট্যাম্প আউট, রান আউট, ক্যাচ আউট, লেগ বিফোর আউট ইত্যাদি।
ভারতবর্ষ ও ক্রিকেটের সম্পর্ক, Relationship between India and Cricket
ঔপনিবেশিক যুগে ব্রিটিশদের হাত ধরে ভারতবর্ষে ক্রিকেট খেলার প্রচলন ঘটে। ষোড়শ শতাব্দীতে ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতবর্ষের বুকে প্রথম ক্রিকেট খেলা হয়। তখন থেকে বহু কাল ধরে ক্রিকেট খেলা শুধুমাত্র ব্রিটিশদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে ছিল। পরবর্তীতে ব্রিটিশদের সাথে ভারতীয় হিসেবে প্রথম ক্রিকেট খেলায় অংশগ্রহণ করেছিলেন বোম্বাইয়ের পার্সি সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ।
১৯২৮ সালে আমাদের দেশে প্রথম ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড সংগঠিত হয়। ক্রমে সময়ের সাথে সাথে ভারতবর্ষের ক্রিকেট ইতিহাসে বিভিন্ন তারকার আবির্ভাব ঘটে, যাদের মধ্যে অন্যতম কয়েকজন খেলোয়াড় এর নাম হল : রঞ্জিত সিং, মনসুর আলী খান পতৌদি, কপিল দেব, সুনীল গাভাস্কার, শচীন তেন্ডুলকর, সৌরভ গাঙ্গুলী প্রমুখ।
বাংলাদেশের ভালো ক্রিকেট খেলোয়াড় এর মধ্যে রয়েছে: মোহাম্মদ সেলিম, আনোয়ার হোসেন মনির, রাজিন সালেহ, এনামুল হক জুনিয়র, মানজারুল ইসলাম রানা। উক্ত খেলোয়াড়গণ দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের তারকা খেলোয়াড় হিসেবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কপিল দেবের অধিনায়কত্বে ১৯৮৩ সালে ভারত সর্বপ্রথম ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে বিশ্বকাপ ট্রফি জয় করে, সেই সময় থেকে ভারতীয় ক্রিকেটকে আর কখনও ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে জাতীয় হোক কিংবা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, ভারতীয় ক্রিকেট দল বিশ্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দলের মধ্যে একটি।
বর্তমান আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা, Current international cricket game
উৎপত্তির সময় থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত ক্রিকেট খেলার বিভিন্ন বিষয় ব্যাপক ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। সরঞ্জাম থেকে শুরু করে নিয়ম নীতিও বেশ কিছুটা বদলে গেছে। শুরুর দিকে ক্রিকেটে শুধু টেস্ট ম্যাচ খেলা হতো, যা ছিল ৫ দিন ব্যাপী, কিন্তু পরবর্তী সময়ে এই টেস্ট ম্যাচের জনপ্রিয়তার তুলনায় ক্রিকেটে একদিনের ম্যাচের প্রচলন ঘটেছে।
প্রথমদিকে উক্ত একদিনের ম্যাচগুলো আয়োজিত হতো ষাট ওভারের খেলার মধ্য দিয়ে। তবে কিছু সময় পরে ৬০ ওভারের ম্যাচ ৫০ ওভারের খেলায় পরিণত হয়। পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২০ ওভারের ম্যাচ অর্থাৎ টুয়েন্টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটের প্রচলন ঘটে। পূর্বের সময়ে ক্রিকেটের একটি ম্যাচে দুজন আম্পায়ার থাকতো, পরে সিদ্ধান্তের সুবিধার্থে মাঠের বাইরে একজন থার্ড আম্পায়ার খেলা সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করার ব্যবস্থা করা হয়।
কিন্তু বর্তমানে ক্রিকেটে বিভিন্ন প্রকারের প্রযুক্তির ব্যবহার করেই বিভিন্ন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে ক্রিকেট খেলার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জিম্বাবুয়ে, আফগানিস্তান ও আয়ারল্যান্ড প্রমুখ দল নিজের দেশকে উপস্থাপন করে থাকেন।
ক্রিকেট খেলার সাথে আজকের সময়ে বহু ব্যবসায়ীও যুক্ত আছেন এবং বিভিন্ন অঙ্গনে এই ব্যবসায়ীদের সহায়তায় ক্রিকেট বোর্ড খেলার আয়োজন করে থাকেন, তথা জয়ী দলের জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রযোজকের পাশাপাশি স্পন্সরের ভূমিকা থাকে।
উপসংহার, Conclusion
সমগ্র দেশবাসীর কাছে ক্রিকেট যেন এক আবেগের নাম। সকলের প্রিয় খেলা এটি। আমাদের মধ্যে অনেকেই লক্ষ্য করেছি যে কোনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচে যদি আমাদের দেশ অংশগ্রহণ করে তবে সকল দেশবাসী জাতি-ধর্ম-বর্ণ, ধনী-দরিদ্র সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মেতে ওঠে দলের সমর্থনে। ক্রিকেট খেলা তথা ক্রিকেট খেলোয়াড়দের প্রতি মানুষের বন্দনা দেখলে মনে হয় যেন প্রতিটি দেশবাসীর সাধারণ ধর্ম হল ক্রিকেট।